Ameen Qudir

Published:
2020-02-14 21:58:49 BdST

ভ্যালেনটাইন স্টোরি : বুড়ো পর্ব :ডাক্তারবাবু , আসব?


সুমিত চট্টোপাধ্যায়
কথাসাহিত্যিক,পেশায় চিকিৎসক
________________________

ডাক্তারবাবু, আসব?
আসুন।

তাকিয়ে চমকে গেলাম। আর, খুব বিরক্তও হলাম।
এ তো সেই মহা ছ্যাঁচড়া বুড়োটা।
এখানেও এসে জুটেছে!

বুড়োও বুঝেছে যে কিছু একটা গন্ডগোল আছে, তাই আমতা আমতা করে বলল- আপনি কি আমাকে চেনেন?
আমি তাচ্ছিল্য মেশান হাসি দিয়ে বললাম - আপনাকে চিনব না? আপনি ত মহাপুরুষ মশাই।
বুড়ো ধীরকন্ঠে বলল- না মানে , আমি ত ঠিক আপনাকে আগে দেখিয়েছি বলে মনে হচ্ছে না..
তা চিনবেন কেন? আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম- টাকা মেরে পালালেন আপনি, টাকা মারা গেল আমার। কাজেই আমিই আপনাকে চিনব। আপনি কোন দু:খে আমাকে চিনবেন?

জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়, বুড়ো সেইরকম কুঁকড়ে গেল - আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে কখনো দেখাই নি।
আমি কি বলেছি আপনাকে আমি দেখেছি? আপনার স্ত্রীকে আমি দেখেছিলাম গতবছর।
বুড়ো আরও জড়োসড়ো হয়ে গেল। তারপর জড়ানো গলায় বলল- ও।
তা, এবার কী ব্যাপার?
বুড়ো চুপ করে রইল।
আরে বলুন- আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম - আমার অত সময় নেই। এবার কাকে দেখতে হবে? আপনাকে ?
না, না- বুড়ো মাথা নাড়ল- আমার স্ত্রীকেই আবার ভর্তি করেছি। ১০৮৯ নম্বর বেড। আপনাকে রেফার করা আছে ।
জানি ত। মেসেজ এসেছে।
আমি জানতে এসেছিলাম কখন যাবেন দেখতে। আপনার ত সকালে দেখতে আসার কথা ছিল…
আমার অন্য এক হাসপাতালে একজন পেশেন্ট খারাপ ছিল, তাই সকালে আসতে পারি নি। তবে মাপ করবেন আপনার স্ত্রীকে আমি দেখতে পারব না- অন্য কাউকে দেখান।
বুড়ো একদম ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার হাতদুটো ধরে ফেলল- এরকম করবেন না, ডাক্তারবাবু। আপনারা ভগবান।
নিকুচি করেছে ভগবানের ! দৃঢ়কন্ঠে বললাম - সরি। আমি পারব না।
প্লিজ ডাক্তারবাবু। লোকটা হাঁউমাউ করে কেঁদেই ফেলল।
আরে, এ তো মহা জ্বালা। এ তো দেখছি অভিনেতা নম্বর ওয়ান।

বুড়োর সঙ্গে পরিচয় গতবছর অন্য এক হাসপাতালে।
বুড়োর বউ ভর্তি ছিল আই সি ইউতে। আমাকে রেফার করা হয়েছিল ট্র্যাকিওস্টমি করে দেওয়ার জন্য।
ট্র্যাকিওস্টমি মানে, গলা ফুটো করে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের নল পরিয়ে দেওয়া - অনেকদিন রোগী কোমায় থাকলে করে দিতে হয়। অনেকেরই ধারণা যে অপারেশানটা করে দিলেই বোধহয় রোগীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, পরেরদিনই পারলে বাড়ি চলে যাবে।
তা কিন্তু নয়।
উল্টে অপারেশানটা ইটসেলফ্ বেশ রিস্কি।
সেইকথা বুঝিয়ে বলার জন্যেই আমি রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আগে কথা বলে নিই।
এক্ষেত্রে এই বুড়ো এসেছিল।
বুঝিয়ে সুজিয়ে বলার পর আমার হাতদুটো চেপে ধরে বলেছিল - যা ভাল বোঝেন করবেন, আমার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিন। আমি বন্ডে সই করে দিচ্ছি।
সেদিনই ট্র্যাকিওস্টমি করে দিলাম। একেবারেই ভাজা সুঁটকে বুড়ি। প্রায় মাসখানেক ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর বুড়ি বেঁচেও গেল।
তারপর বাড়ি ফিরে গেল।
পরে শুনি হাসপাতালের বিল না পেমেন্ট করেই ব্যাটারা চলে গেছে!
সে কী! কী করে এরকম করল? হাসপাতালের ম্যানেজার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
আর বলবেন না, স্যার। মহা বদমাইশ পার্টি। অতদিন ভর্তি ছিল, তার তিন লাখ টাকা বিল হবে না? সামান্য কিছু টাকা ভর্তির সময় দিয়েছিল। ছুটির সময় আর একটা পয়সা দিতে পারব না বলল।
কিচ্ছু দিল না?
না। উল্টে সাতআটটা মস্তানকে নিয়ে এসেছিল। তারা এমন হুমকিটুমকি দিল যে আমরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।
বলো কী!
বুঝলাম - আমার সার্জেন ফিজটা মায়ের ভোগে গেল !

তখন থেকেই বুড়োকে আমার মনে আছে। বদের হাঁড়ি একটি।
বুড়ো অবশ্য কেঁদেই চলেছে- মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কীরকম পাজি মানুষ।
কতক্ষণ এরকম চলবে কে জানে - চেম্বারের বাইরে আরো বেশ ক’জন রোগী আছে। কথাবার্তা শুনে নিশ্চই আমাকেই চামারটামার ভাবছে। গলা খাঁকরে বললাম - আগেরবার হসপিটালের টাকা না দিয়ে পালিয়ে গেছিলেন যে বড়?
লোকটা চোখটোখ মুছে বলল- কী করব ডাক্তারবাবু? অত টাকা বিল হল!
হবে না? আপনার পেশেন্ট কতদিন আই সি ইউতে ভর্তি ছিল সেটা বলুন।
না, না - বিল ত ঠিকই ছিল। কিন্তু আমার অত সাধ্য ছিল না ।
তাই বলে গুন্ডা দিয়ে হামলা করবেন?
আর কী করব?! আমার ত সাধ্যের বাইরে।। মস্তানগুলোকে দিয়ে অনেক কম টাকায় কাজ ফিনিশ করে দিলাম।
নড়েচড়ে বসলাম - মানে?
মানে ডাক্তারবাবু - বুড়ো চোখমুখে রুমাল বুলিয়ে বলল - কুড়ি হাজার টাকায় কাজ মিটে গেল।
সে কী!
হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। পাড়ারই এক ছেলে বুদ্ধিটা দিয়েছিল। আমার তখন মাথার চুল ছেঁড়ার দশা - ডাক্তার ডিসচার্জ দিয়ে দিয়েছে। অথচ আমার হাতে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকার বেশি নেই। পাড়ার ছেলেটিই মস্তানগুলোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
এরকম… এরকম একটা বেআইনী কাজ করতে আপনার বিবেকে বাঁধল না? আমি আবার রেগে গেলাম।
কী করব! আর ত কোনও বুদ্ধি আমার মাথায় এল না।
বাহ্। বেশ। তা থানা পুলিশের ভয় নেই?
নেই আবার? তবে ছেলেগুলো খুব আটঘাট বেঁধে কাজ করে।পুলিশে খবর দিলে ভাল হবে না বলে ভয়টয়ও দেখিয়ে দিয়ে এসেছিল।
ও বাবা। এতো প্রফেশনালদের মত কাজ। রাগে গা রি রি করছিল। বললাম - তা সাধ্য নেই যখন, গরমেন্ট হসপিটালে নিয়ে গেলেই ত হয়।
কী যে বলেন- গভমেন্টে আবার চিকিৎসা হয় নাকি?
যত বাজে কথা। যথেষ্ঠ ভালই হয়, তার ওপর বেঙ্গলে হসপিটাল ট্রিটমেন্ট ত ফ্রি। তবে কুযুক্তির থেকে অকাট্য আর কীই বা আছে- তাই মুখে কিছু বললাম না।
বুড়ো ওদিকে তদ্গত ভাবে বলেই চলল - আমার স্ত্রীকে বাঁচাতেই হবে, ডাক্তারবাবু। যে কোনও মূল্যে…
মূল্যই বটে। একেবারে বিনামূল্য ! মনে মনে ভাবছিলাম। মুখে বললাম - তা, এবারও যদি বিল বেশি হয়…
এবারও তাই করব - বুড়ো আমার মুখের কথা কেড়ে নিল। এতক্ষণ যে মিনমিন করছিল সেই কথা বলার ভঙ্গিই যেন চেন্জ হয়ে গেল। হিসহিসিয়ে বলল - এবারও যদি ওরকম হয়, ত আবার মস্তানদের নিয়ে আসব। মোদ্দা কথা যেভাবেই হোক আমি আর স্ত্রীকে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেব। তাতে যা হয় হোক … আপনি জানেন ,আজ থেকে ষোল সতের বছর আগে আমার মেনিনজাইটিস হয়েছিল। আমার বাঁচার কোনও আশা ছিল না। তখন এই বউই আমার জন্যে দোরে দোরে ভিক্ষে করে আমায় বাঁচিয়েছিল।

বুড়ো আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। এবার আমারই তাকাতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।
আমরা সাধারণ মানুষ , স্ত্রীর প্রতি এরকম তীব্র অনুরাগ আমার কোনওদিন ছিলও না, হবেও না। আমরা হলে বুড়িকে কোনও সাধারণ হাসপাতালে ভর্তি করেই দায় সারতাম।
এই বুড়োটা বউকে বড্ডই ভালবাসে।
চোখ পিটপিট করে বুড়োর দিকে তাকালাম।
আস্তে আস্তে বললাম - ঠিক আছে, আপনি যান। একটু পরে আপনার মিসেসকে দেখে আসব।

কী আর করা যাবে - প্রেমের যুদ্ধে সবই ন্যায়!
__________________

ডা. সুমিত চট্টোপাধ্যায়। লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সহযোগী অধ্যাপক, ইএনটি। কেপিসি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়