Ameen Qudir

Published:
2020-02-11 23:08:30 BdST

গোয়েন্দা যেমন খুনী বের করে: তেমনি ডিজিজ ডায়াগনোসিস করার রহস্যময় ও অপার আনন্দ


 


ডা. মোরশেদ হাসান
মননশীল লেখক
____________________

দেড়টা পর্যন্ত যখন হাসপাতালে রোগী দেখি দারুণ ভালো লাগে। রোগী দেখায় এতটা আনন্দ আমি আগে কখনও অনুভব করিনি। তাহলে এত বছর কী করেছি। হ্যাঁ সেসময়ও চেম্বারে রোগী দেখেছি। কিন্তু গোয়েন্দারা যেমন আসামি বা খুনী বের করে ঠিক তেমনি ডিজিজ ডায়াগনোসিস করার যে রহস্যময় ও অপার আনন্দ সেটা আমি এবারই অনুভব করলাম। এর আগে আমি পাবলিক হেলথ লাইনে চাকরি করেছি। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে কম্যুনিটি মেডিসিন সাবজেক্টটি পড়িয়েছি, কিন্তু ক্লিনিক্যাল টাচে ছিলাম না। হঠাৎ করেই পরিবর্তনটি নিয়ে এলাম। আমার সহকর্মীরা প্রথমদিকে অবাক হয়েছে, এখন দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে, আমিও নিয়েছি কারণ জীবন আমাকে মানুষের সঙ্গে মিশতে শিখিয়েছে। আমার তিনজন ছাত্র-ছাত্রীও এখন সমপোস্টে আমার কলিগ। আমি খুব সহজভাবে ওদের সঙ্গে গল্প করি। দেড়টা বাজে রোগী দেখা শেষ হলে ডক্টরস ক্লাবে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করি। টেবিল টেনিস খেলতে। একসময় চিনতাম, এখন খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে না।

একদিন কাজের সময় বলেই ফেললাম, কোথায় খেলা যায়? একজন বলল, আপনি মেডিকেল কলেজে গিয়ে খেলে আসেন। সোজা গিয়ে হাতের বামে গিয়ে ডানে গেলেই কলেজ কমনরুম। আগেও গিয়েছিলাম একদিন। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ পেপার পড়েছিলাম। ছাত্র-ছাত্রীদের খেলতে দেখেছিলাম। বেশ ভালো খেলে তারা। এই বয়সে কী আমি খেলতে পারব? যখন ছাত্র ছিলাম তখন এখানে খুব কম এসেছি। দেশের সেরা মেডিকেল কলেজ। দুএকবার এলেও এদেরকে রাজপুত্র মনে হয়েছে, অসাধারণ মেধাবী মনে হয়েছে। পেপার পড়ে চলে এসেছিলাম। কাউকে মুখ ফুটে আমাকে ব্যাট দিতে বলতে পারিনি। আজ মনে হল সাহসী হতে হবে, সঙ্কোচ ভাঙতে হবে। বললাম, আমি একটু খেলতে পারি।
তারা বলল, শিওর।
খেললাম। ছাত্রজীবনে ভালো খেলতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নজর কেড়ে ফেললাম। ফোরহ্যান্ড ও ব্যাকহ্যান্ড দুটোই ভালো আমার। ব্যাকহ্যান্ডে ভালো প্লেয়ার কম আছে। আমার দরকার ঘাম ঝরানো। দারুণ একটি সুযোগ পেয়ে গেলাম। খেলা শেষে ব্যাগ হাতে করে হেঁটে হেঁটে শাহবাগে আসি। ট্রাস্টের বাসে চড়ে বাসায় ফিরি। একদিন টিএসসিতে ঢুকে গেলাম। এখানকার বোর্ডগুলো দারুণ ফাস্ট। বহু বছর আগে যখন ছাত্র ছিলাম তখনও এখানে আসতাম। কিন্তু মনে হত এরা অনেক ভালো খেলে। পরিচিতও কেউ নয়। খেলতে সঙ্কোচ বোধ করতাম। এখন খেলার সুবাদে প্লেয়াররা সবাই আমাকে চেনে। খেলা শেষে পরিচিত হতে আসে। আগে কোথায় খেলতাম জিজ্ঞেস করে।
নিপসম থেকে এমপিএইচ করার সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে হেলথ ইকনোমিক্সেও ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। ক্লাস হত খোদ অপারজেয় বাংলার পেছনে আর্টস ফ্যাকাল্টির তিনতলায়। মেডিকেল কলেজে পড়ানো শেষ করে উত্তরা থেকে বেড়িবাঁধ ধরে বাসে চড়ে মিরপুর ১ নম্বরে এসে আবার বাস পালটে নীলক্ষেতে নেমে হেঁটে চলে যেতাম আর্টস ফ্যাকাল্টি। ক্লাস শেষ করে আবার বাস ধরে মীরপুরে এসে চেম্বারে ঢুকতাম। ২০০৬ থেকে ২০০৯ তিন বছরে হেলথ ইকোনোমিক্সে ডিপ্লোমা করলাম, মাস্টার্স করলাম। এমপিএইচ তো আগেই হয়েছিল। তখন শরীরে কুলোত। কিন্তু এখন!

আজ খেলা শেষে নির্জন আমার সঙ্গে বেরিয়ে এল। সে এপ্লাইড ম্যাথের ছাত্র। বাবা-মা দুজনেই কুষ্টিয়াতে স্কুলের শিক্ষক। আমার গন্তব্য কোথায় জানতে চাওয়াতে বললাম, বইমেলা। নির্জন মনে হল আমার সঙ্গ ছাড়তে চাইছে না। টিএসসি থেকে বেরিয়ে আসার সময় একপলক মনে এল আমার এইচএসসির পর এখানে ভর্তি হলে সেটি হত ১৯৮৭-৮৮ সাল। মন বড়ো রহস্যময়। নির্জন রাইন-লরেলের চেয়ে বছর আটেকের বড়ো হবে। কার কথা মনে নেই- "It's not the years in your life that count. It's the life in your years!"

করোনা ভাইরাস নিয়ে আলাপ করতে করতে এগিয়ে চললাম। সঙ্গী থাকাতে সুবিধাই হল। বইমেলা একা একা ঘোরার জায়গা নয়। আমাকে দেখলেই লোকজন এগিয়ে আসবে বিষয়টি এমন নয়। যদিও মেলায় আমার দুটো বই আছে। নির্জনের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ফটকে চলে এলাম। চায়নাতে করোনা ভাইরাসের ইফেক্ট এবং বাকি বিশ্ব নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম। এপিডেমিওলজি, ইনকিউবেশন পিরিয়ড, সোর্স অব ইনফেকশন, ট্রান্সমিশন, প্রিভেনশন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন-- বিষয়গুলো পাবলিক হেলথের অন্তর্ভুক্ত। আট বছর কম্যুনিটি মেডিসিন পড়িয়েছি আমি। নির্জন সম্ভবত কিছুটা অবাক আমার বই আছে জেনে। বলাকা প্রকাশনের সামনে এলাম। ব্যাগে দুকপি বই আছে। স্টলে মিষ্টি শান্ত চেহারার যে মেয়েটি বসে আছে তার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলাম, বই কেমন চলছে?
বলল, এক কপি বিক্রি হয়েছে।
মেলার আজ দশম দিন। এককপি বিক্রি হয়েছে!
বললাম, দুকপি বই রেখে যাই।
মেয়েটি শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের কোনো স্টলেই পাঠক বা ক্রেতা নেই। সে একা বসে থেকে থেকে নিজেই বিরস বদন হয়ে আছে। অবাক হয়ে হয়তো ভাবছে নতুন কপি রেখে কী হবে!
স্মিত হেসে বলল, শিওর। রেখে যান।
আমার মনে হল মেয়েটি তো ভদ্র, মিষ্টি। সমস্যা মনে হয় আমারই মধ্যে। নির্জনকে নিয়ে এবার যাব বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রিপোর্টাস ইউনিটির স্টলে। দ্রুত পা চালালাম।
ফিরোজ সাহেব, কেমন আছেন? বইয়ের কী অবস্থা?
এখানেও একই অবস্থা। মাছি তাড়ানোর কাজ। অথচ ঢোকার সময় মেলার ভেতরে দেখলাম কয়েকজন নেতা ও পেছনে বিশাল কর্মীবাহিনি। মেলায় আওয়ামী লীগ এবং তার ছাত্র সংগঠনের স্টল আছে।
ফিরোজ বলল, দুকপি না তিনকপি বিক্রি হয়েছে। ব্যাগের বই আবার বাসা পর্যন্ত টেনে নিয়ে কী হবে!
বললাম আর তিনকপি রেখে যাই।
নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই ফ্যাসফ্যাঁসে মনে হল। কোনোকিছুই ব্যাপার না। পৃথিবীটা বড্ড সুন্দর।
লেখক জীবন বড়ো কষ্টের। নির্জন বিদায় নেওয়াতে নির্জনতা ঘিরে ধরল আমায়। দ্রুত শাহবাগের দিকে পা চালালাম।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়