Ameen Qudir

Published:
2020-02-11 22:16:00 BdST

বিজ্ঞানী বনাম আমলা:বিজ্ঞানী আমলা হতে পারেন: আমলা চাইলে বিজ্ঞানী হতে পারেন না


 

ডেস্ক
______________

ডাঃ সুকুমার সুর রায়। বাংলাদেশের পথিত যশ চিকিৎসক ও সুলেখক। তার লেখা "বিজ্ঞানী বনাম আমলা" অসাধারণ একটি রচনা। লেখাটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ হল।

********""বিজ্ঞানী বনাম আমলা ""********
একজন বিজ্ঞানী আমলা হতে পারেন কিন্তু একজন আমলার পক্ষে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা কঠিন।
উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় প্রথম এশিয় পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর চন্দ্র শেখর ভেংকটেশ্বর রমন ( সি ভি রমন) এর নাম।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের অর্থবিভাগের একজন
জাঁদরেল আমলা।
তিনিই মাত্র দুইশত রুপির যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ' রমন এফেক্ট ' আবিষ্কার করে প্রথম এশিয় হিসেবে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
ব্যাপারটি কি উল্টো মনে হল? একজন আমলা হয়ে গেলেন পদার্থবিজ্ঞানী? ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। তিনি ছিলেন আসলে বিজ্ঞানী, আমলার চাকরি করতেন মাত্র। পাশাপাশি বিজ্ঞানের গবেষণা করতেন।
এই বিষয়টি আলোচনায় আনার উদ্দেশ্যে আমলাতন্ত্র বা ব্যুরোক্র‍্যাসিকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয়।
তবে নিঃসন্দেহে আমলারা যে নিজেদেরকে অতি উচ্চ বর্নের ব্রাম্মন মনে করে তার সমালোচনা করা।
আমলাদের সমালোচনা করে এক অতি বৃহৎ মহাকাব্য রচনা করা সম্ভব সেটি এই ছোট কলেবরে সম্ভব নয়। সেটি উদ্দেশ্যেও নয়।

তবে আমলা এবং বিজ্ঞানীগন যৌথভাবে সমন্বয় করে যার যার ক্ষেত্রকে সম্মান জানিয়ে কাজ করলেই অনেক অনাহুত সংকট এড়িয়ে উল্লম্ফন ঘটানো সম্ভব তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এর ব্যত্যয় ঘটলে বিপর্যয় অনিবার্য।

এত সব ভনিতার মূল কারন ' নভেল করোনা ভাইরাস ' নিয়ে ঘটে যাওয়া চীনের সাম্প্রতিক বিপর্যয়, শুধু চীনের নয় সারা দুনিয়ার বিপর্যয়।

একজন চিকিৎসক বিজ্ঞানী যিনি মূলত চক্ষু চিকিৎসক, একই সাথে ভাইরোলোজিস্ট; তার করুন আখ্যান, সেই সাথে বিশব্যাপী ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, এই আলোচনার মূল বিষয়।

গত ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে চীনের হুব্যেই প্রদেশের উহান শহরে ' উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের' তরুন চিকিৎসক - লি ওয়েনলিয়াং তার হাসপাতালে আগত কিছু সংখ্যক একই ধরনের লক্ষনযুক্ত রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে ভাইরোলোজির জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারেন যে, এই রোগিগন একইধরনের ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার সাথে ২০০৩ সালে চীনে মহামারী আকারে ঘটে যাওয়া
সার্স(severe acute respiratory syndrome) ভাইরাস এবং ২০১৩ সালে মধ্যেপ্রাচ্যে মহামারী আকারে ঘটে যাওয়া মার্স (Middle east respiratory Syndrome) ভাইরাসের সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে।

তিনি এটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে লক্ষ্য করা মাত্র তার সহকর্মীদের বিষয়টি অবহিত করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়েব গ্রুপ ব্যবহার করে এস এস এস এর মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করতে থাকেন এবং এই ধরনের রোগির চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রটেক্টিভ পোশাক পরিধান করার পরামর্শ দিতে থাকেন।

এতে স্থানীয় সবজান্তা সিটি প্রশাসকেরা ক্ষেপে যান। লি ওয়েনলিয়াং কে তলব করা হয়।
তাকে ভ্রান্ত তথ্য ও গুজব ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তাকে শাসানো হয়। তাকে জেলে পোরার ভয় দেখানো হয়। অতঃপর তার কাছ থেকে একটি মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরপর যা ঘটার তাই ঘটতে থাকে।
দ্রুত নতুন নভেল করোনা ভাইরাস বিস্তারলাভ করতে থাকে। উহান শহর ছাড়িয়ে হ্যুবেই প্রদেশ ছাড়িয়ে গোটা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এটি চীনের বাইরে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।
এপর্যন্ত চীনেই ছয়শোর বেশি মানুষ মারা গেছে। চীনের বাইরে ফিলিপাইন্সেও মানুষ মারা পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO) বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে।
শুধুমাত্র চীনেই এপর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

অথচ ডক্টর লি ওয়েনলিয়াং এর কথাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসনের আমলারা যদি ডিসেম্বরের গোড়াতেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে এই ভাইরাসটি উহান শহরেই সীমাবদ্ধ থাকতো, একটি ভয়াবহ মহামারীকে অংকুরেই সমাধীস্থ করে ফেলা যেত।

এখনকার অবস্থা হল পৃথিবীর অন্যতম সুপার পাওয়ার গনচীন এখন বাদবাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা বানিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সব কিছু বন্ধ হয়ে চীন কার্যত অচল হয়ে গেছে।
বিশ্বের অন্যতম আপরাইজিং অর্থনীতির দেশ এক ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবিলা করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাদবাকি দুনিয়াও কম ঝুঁকিতে নেই।

চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং, যিনি মূলত চক্ষু চিকিৎসক, তিনি ইচ্ছে করলেই চক্ষু চিকিৎসাতেই নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি আমলাদের মত প্রটোকল মেনে নিজেকে বাঁচাতে চাননি।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ভূলে যান আমলাদের করা অপমান।
রাতদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে থাকেন, ভয়ংকর করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে তিনিও একসময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
জানুয়ারির মাঝামাঝি তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।

প্রানপন লড়াই করতে করতে অবশেষে 'নভেল করোনা ভাইরাস 'এর বংশীবাদক ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

তার মৃত্যুর ঘোষণা নিয়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়।
একজন বিজ্ঞানী, একজন মানবতাবাদী চিকিৎসক ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং কে দুই দুইবার মেরে ফেলা হয়।
প্রথম গত বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কিন্তু আমলাতন্ত্র মিডিয়ার উপরে চাপ সৃষ্টি করে, তাদেরকে বলতে বাধ্য করে যে, '' লি, মারা যাননি, তাঁর বিশেষ ধরনের চিকিৎসা চলছে "।
পরদিন শুক্রবার আবার বলতে বলা হয় যে, " লি, মারা গেছেন। "

লি, আসলে মারা যেতে পারেন না। তিনি মারা যাননি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে, ভাইরোলোজির ইতিহাসে, শত কোটি চীনবাসির হৃদয়ে,
পৃথিবী ব্যাপী সকল মানুষের বুকের গহীনে, ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
লি'র প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।।

----------------- ডাঃ সুকুমার সুর রায়।

Assistant director at DGHS, Mohakhali, Dhaka
প্রাক্তন শিক্ষার্থী , রংপুর মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়