Ameen Qudir

Published:
2020-02-04 02:59:43 BdST

কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে: ডা. সজল আশফাকের কিশোর উপন্যাস তুলে দিন সন্তানের হাতে


 

ডেস্ক
_____________

প্রখ্যাত ছড়াকার, বিজ্ঞান লেখক ডা. সজল আশফাক এবার কিশোর উপন্যাস লিখে সাড়া ফেললেন। বাংলাদেশে মান সম্পন্ন লেখা কিশোর উপন্যাস নেই বললেই চলে। কিন্তু ডা. সজল আশফাকএর মুন্সিয়ানায় ভরা এই   কিশোর লেখা সেই শূণ্যতাকে ভরিয়ে তুলবে পূর্ণতায়। যারা সন্তানকে কিশোর উপন্যাস উপহার  দিতে চান, তাদের জন্য দারুণ সুখবর। নিশ্চিন্তে বইটি আপনার সন্তানের হাতে তুলে দিন।
উপন্যাসের নাম : কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে। এখানে কিশোর উপন্যাসের কয়েক কিস্তি প্রকাশ হল। পড়েই দেখুন কেমন জবরদস্ত লিখেছেন এই সবার প্রিয় লেখক।


কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে-১

 

আরিফ বরিশালে থাকে। গতরাতে তাকে ফোন করে জানানো হয়েছে চাকরির ইন্টারভিউয়ের কথা। বরিশাল থেকে তড়িঘড়ি করে বাসে ঢাকার গাবতলীতে নেমে সোজা কল্যাণপুর সেই অফিসে এসে শোনে ইন্টারভিউ শেষ। রিসিপসনিস্ট তেমনটিই বললো। কিন্তু ইন্টারভিউ কেন শেষ হবে? সে তো ঠিক সময়েই এসেছে। এখন বেলা আড়াইটা, তার জন্য ইন্টারভিউয়ের সময় বেলা ৩টা। তাই সে ডিরেক্টরের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিরেক্টর আশরাফ সাহেব এসে কুশল বিনিময়ের পর আরিফকে বললেন- ফলো মি। আশরাফ সাহেবের সাথে এই অফিসে আরো কয়েকবার তার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আশরাফ সাহেব আরিফকে ইতোমধ্যে ভাল করেই চেনার কথা। আরিফ তাকে চেনামানুষ মনে করেই অনুসরণ করে আরো একতলা ওপরে উঠলো। আরিফের মন-মেজাজ আজ ভাল নেই। এতদূর থেকে ডেকে এনে বলছে -ইন্টারভিউ শেষ।
আরিফ, ডিরেক্টর সাহেবকে বিষয়টা পরিষ্কার করতে যেয়ে বললো- স্যার, আমি কিন্ত ঠিক সময়েই এসেছি। ডিরেক্টর সাহেব আরিফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন- হোয়ার ইজ ইয়োর ফ্রেন্ড? কী যেন নাম?
আরিফ বললো- পারভেজ।
ময়মনসিংহের ছেলে, এ্যাংরি ইয়াং পারভেজ আসে নি? আরিফকে পাল্টা প্রশ্ন ডিরেক্টটরের।
আমি তো জানি না স্যার- উত্তর দিল আরিফ। ডিরেক্টর আর কথা বাড়ালেন না। তিনি এখন যে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে তার দরজায় একজন ভিনদেশী মানুষের নাম লেখা নেমপ্লেট লাগানো। বেশ লম্বা নাম, লাস্ট নেমটা- ‘সুরাইকী’ এর তার নিচের লাইনে ‘কান্ট্রি ডিরেক্টর’ লেখাটি চোখে গেঁথে গেল আরিফের। রুমের সামনে অপেক্ষমানদের জন্য রাখা সোফায় আরিফকে বসতে বলে সুরাইকী সাহেবের রুমে ঢুকলেন আশরাফ সাহেব। কিছুক্ষণ পরই তিনি বেরিয়ে এলেন। মুখ গম্ভীর। আরিফ ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আশরাফ সাহেব ইন্টারভিউয়ের কথা কিছু না বলে, আবার বললেন- ফলো মি। আরিফ আবার তাকে ফলো করে ঠিক একতলা নিচে তার রুমে ঢুকে বললেন- হ্যাভ ইয়োর সিট।
আরিফের মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গেল। এর আগে অনেকবার লোকটা এভাবে অফিসে ডেকে বলেছেন, এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেবেন, কিন্তু দেন নি। বারবার বলেছেন, সরি; আজ হচ্ছে না; কান্ট্রি ডিরেক্টর সই করেন নি; প্রজেক্ট পিছিয়ে গেছে; ইউ আর সিলেক্টেড; এই দেখো এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টাইপ হয়ে গেছে শুধু সই বাকি ইত্যাদি বলে বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিকে আরিফ আর পারভেজ একসাথে যেত ঢাকার এই অফিসটাতে। দুজনকে একসাথে একই কথা বলে আশ্বাস দিতেন এবং হতাশ করতেন। যতবারই দেখা করতে গেছে ততবারই তাদেরকে চা খাইয়েছেন আর হতাশার কথা দিয়ে বিদায় দিলেও ঘটনার তিনি ইতি টানতেন না। প্রত্যেকবারই তিনি বলতেন- কাম নেক্সট টুয়েস ডে, নাইন এ এম শার্প। আরিফ আর পারভেজও মগবাজার মোড় থেকে সকালে রওনা হয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেত অফিসে, কোন কোন দিন আশরাফ সাহেব আসার আগেই। কারণ দুজনেরই চাকরিটা খুব দরকার। দেরি করে যাওয়ায় একদিন রিসিপসনিস্ট দিয়ে বলিয়েছিলেন- আজ দেখা হবে না, স্যার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে মিটিংয়ে ঢুকে পড়েছেন। এভাবে ৭/৮ বার যাওয়া আসার পর একদিন আশরাফ সাহেব তার রুমে বসে আরিফ আর পারভেজকে বলছেন- সুরাইকী সাহেব আজ অফিসে নেই, সকালেই কক্সবাজার সাইট ভিজিটে গেছেন।
আশরাফ সাহেবের এই কথায় হঠাৎই পারভেজ ক্ষেপে গিয়ে বললো- আপনি কী শুরু করেছেন? চাকরি দিলে দিবেন না দিলে নাই, ঘোরাচ্ছেন কেন? ফাজলামো করেন?
পারভেজের এমন ব্যবহারের জন্য আশরাফ সাহেব একবোরেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাছাড়া সুঠাম দেহের পারভেজের মারমুখি অঙ্গভঙ্গিতে হয়তো তিনি শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হতে পারেন এমন ভয়ও পেয়েছিলেন। তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে দ্রুতই বলে উঠলেন- আরিফ, তোমার বন্ধুকে থামাও, এ্যাংরি ইয়াং, মাথা গরম। আরিফ পারভেজের আক্রমণাত্মক মেজাজকে নিবৃত্ত করে ঠান্ডা মেজাজে আশরাফ সাহেবকে বলেছিল- স্যার, ঢাকায় আমরা বন্ধুদের সাথে আছি, এতদিন তো এভাবে থাকা সম্ভব নয়। আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেখে দূরের কোন ডেট দেন।
আশরাফ সাহেব সেদিন আর ‘কাম নেক্সট টুয়েস ডে’ বলেন নি, বললেন- অফিস থেকে ফোন করে জানানো হবে, তোমাদের ফোন নাম্বার দিয়ে যাও আমার কছে।
বোঝা গেল, আশরাফ সাহেব এ্যাংরি ইয়াং পারভেজকে মনে রেখেছেন। আজও আশরাফ সাহেব আরিফকে রুমে বসতে বলে ইন্টারভিউ, এ্যাপয়েন্টমেন্ট বিষয়ে কিছু না বলে, জিজ্ঞাসা করলেন- লাঞ্চ করেছো?
আরিফ মনে মনে রেগে আছে, আজও আগের মত নেগেটিভ কিছু হলে পারভেজের মত আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে যাবে সে। তাই কোন ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো না। আরিফের উত্তরে আশরাফ সাহেব কাউকে ডাকার জন্য কলিংবেল চাপলেন। আরিফের সন্দেহপ্রবণ মন ধারনা করছে, আজ হয়তো আশরাফ সাহেব তাকে লাঞ্চ করিয়ে বিদায় দেবেন্, শেষে বলবেন- সরি, আরিফ...। আরিফের ধৈর্যচূত্যি হলেও রাগ সামলে নিয়ে বললো, আমার ইন্টারভিউ?
- তোমার ইন্টারভিউ লাগবে না। সুরাইকী সাহেবকে বলেছি আমি আগেই তোমার ইন্টারভিউ করেছি। আশরাফ সাহেব হাসি হাসি মুখ করে চেহারা নিয়ে কথাগুলো বলে হাতের ফোল্ডার থেকে একটা প্যাডের কাগজ বের করে দেখিয়ে বললেন- এই যে তোমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, সই করা হয়ে গেছে। তুমিও যাচ্ছো সবার সাথে, আজ রাতেই। পারভেজ এলে ওরটাও আজ সই করাতে পারতাম। ওকে ফোনে পাই নি। মাথা গরম ছেলেটার। এত মাথা গরম হলে কী আর চলে! বাট আই ডিড মাই জব।
আরিফের ধারনাই ঠিক ছিল। এর মধ্যে আশরাফ সাহেব অফিসের ক্যান্টিন থেকে তার রুমেই আরিফের লাঞ্চের ব্যবস্থা করলেন। তারপর বললেন- একটা ফোল্ডিং বিছানা, বালিশ, চাদর ইত্যাদি জরুরি কিছু কিনে নাও। একাউন্টসে বলা আছে, অর্ধেক মাসের স্যালারি এডভান্স পাবে।
অবশেষে আরিফের বেকার জীবনের অবসান হয়েছে। প্রচন্ড ধৈর্যশীল যুবক এই আরিফ। চাকরিটা জোগাড় করতে গিয়ে গত ২মাস ধরে অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষায় তাকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। একটা এনজিও’র মেডিকেল সেন্টারে মেডিক্যাল অফিসারের চাকরি। বেতন মোটামুটি। থাকার ব্যবস্থাও সেখানে করা হয়েছে। তবে কাজটা মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা - শরনার্থীদের নিয়ে। ওদের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এই এনজিও কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত তিনটি মেডিকেল সেন্টার খুলেছে। তারই একটিতে যোগ দিচ্ছে আরিফ।
ডাক্তারদের চাকরিও এখন বেশ দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। ১৯৯০ সালে এমবিবিএস পাশ করার পর একবছর ইন্টার্নশীপ ট্রেনিং, তারপরও প্রায় বছরখানেক সময় বেকার কেটেছে। অবশেষে প্রায় মাসখানেক এই চাকরির পেছনে ঘোরাঘুরি ধরাধরির পর আজই বিকেলেই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেল। এই এনজিওটির হেড অফিস ঢাকার কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে। অনেকবার এসেছে এখানে। তার আগে বাসায় একটা ফোন করে জানাতে হবে। তখন মোবাইল ফোন আসে নি। ল্যান্ড ফোনই ভরসা। আশরাফ সাহেবকে কথাটা বলতেই উনি ওনার রুম থেকেই ব্যবস্থাটা করে দিলেন।-


কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে- ২

 

অনেক্ষণ ধরে আশরাফ সাহেবের রুমেই বসে আছে আরিফ। দেয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ পড়লো। ১৯৯২ সাল, মাস জুলাই তারিখ ১৫, বুধবার। তারিখটা মনে রাখার চেষ্টা করল আরিফ। কিন্তু বাসায় একটা ফোন করে জানাতে হবে সবকিছু। তখন মোবাইল ফোন আসে নি। ল্যান্ড ফোনই ভরসা। আশরাফ সাহেবকে কথাটা বলতেই উনি ওনার রুম থেকেই ফোনের ব্যবস্থাটা করে দিলেন। বাবা-মা খুশি হলেন, কিন্তু পরক্ষণে এখনই যেতে হবে শুনে একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। আরিফ আশ^স্ত করায় কিছুটা দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। বাসায় ফোন করার পর আরিফ এখন কিছুটা স্বস্তিবোধ করছে।
আশরাফ সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে আরিফ এনজিও অফিসের অন্য একটি রুমে অপেক্ষা করছে। কনফারেন্স রুমের মত বড় রুম, অনেক চেয়ার টেবিল। ইতোমধ্যে অনেকেই আরিফকে চিনতে পারছে, অফিসের এমপ্লই হিসাবে সম্মান দেখাচ্ছে, ডাক্তার হিসাবে আরেকটু বেশিই সম্মান পাচ্ছে। এখান থেকেই ৬ জন ডাক্তার একসঙ্গে রওনা হয়েছে যাবে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার শুনে অন্যরকম আনন্দ হলো। সবাই কক্সবাজার যায় বেড়াতে আর সে যাচ্ছে চাকরি করতে। বিশে^র সবচেয়ে দীর্ঘ প্রকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার লম্বা, সৈকতের পিছনেই একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে ঝাউবন। আশেপাশে আরো কতকিছু দেখার মত রয়েছে। সকালবেলা সৈকতে কতকিছু পড়ে থাকে। কত রঙ বেরঙের ঝিনুক, শামুক। লাল কাঁকড়া ,স্টার ফিস, জেলি ফিস। এমন দর্শনীয় জায়গায় চাকরি! এর আগে আরিফ যে কক্সবাজার যায় নি তা নয়। প্রথম এসেছিল যখন সে মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ে। শিক্ষাসফরের অংশ হিসাবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর টেকনাফ দেখেছে সেই সময়ে। প্রথম সমুদ্র দেখার অনুভূতি আজও ভোলে নি আরিফ। রাতের সমুদ্র, সে আর এক রূপ! রাতে সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন একের পর এক সৈকতে আছড়ে , মনে হয় সারিবদ্ধ শে^ত ভালুক গড়িয়ে গুড়িয়ে তীরে আসছে আর চিৎকার করছে। আরিফকে কে একজন বলেছে, সমুদ্রের পানিতে যে শৈবাল এবং ছোট ছোট প্রাণী থাকে ওদের শরীর থেকে নাকি ফসফরাসের মত উজ্জ¦ল সাদা আলোর অবিরাম প্রস্ফুরণ ঘটে। আর তাতেই রাতের ঢেউগুলো অন্ধকারে সাদা জ¦লজ¦ল করে। যেমন কিছু তসবিহ আছে যেগুলো রাতে একইভাবে সাদা উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়, ঠিক তেমন। বিজ্ঞানের ভাষায় বিষয়টিকে বলা হয় ফসফোরেসেন্স।
আস্তে আস্তে এনজিও অফিসের কনফারেন্স রুমে লোকজনের সমাগম বাড়ছে। আরিফ বুঝতে পারছে এদের সবাই ডাক্তার। মনে হলে আরিফ ছাড়া বাকী ডাক্তাররা পরস্পর পরস্পরকে আগে থেকেই চেনে। তাই তারা নিজেদের মধ্যে নানারকম গল্পে জড়িয়ে পড়ছে সহজেই। কিছুটা ইয়ার্কি ফাজলামোও করছে একে অন্যের সাথে। ওদের কথার সূত্রধরেই জানা গেল, প্রতিটি মেডিকেল সেন্টারে সিস্টার, মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্ট, দারোয়ানসহ পুরো স্টাফ থাকবে। বাকী স্টাফরা তিনদিন আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে। আরিফের সাথে ইতোমধ্যে দু’একজনের পরিচয় আর করমর্দন হয়েছে। কনফারেন্স রুমের চেয়ারে ছয়জন ডাক্তারসহ আরো কয়েকজন লোক ডিম্বাকৃতির টেবিল ঘিরে রাখা চেয়ারের একপাশের চেয়ারগুলোতে বসে নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা সেরে নিচ্ছিলো। ঠিক তখন রুমে এসে ঢুকলেন এই এনজিওর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর ডাক্তার আশরাফ। আরিফের চোখে আশরাফ সাহেবকে এখন অন্যরকম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লাগছে। হয়ত চাকরিটা পাওয়ায় তার প্রতি বাড়তি শ্রদ্ধার কারণেও এমনটি হতে পারে। আরিফ লক্ষ্য করল ডা. আশরাফ বেশ লম্বা, কাঁচাপাকা চুল, চোখে বড় ফ্রেমের পুরু গ্লাসের চশমা। তাকে দেখে সবাই দাঁড়ালো আর তিনি সবার উদ্দেশ্যে একটা লেকচার ঝেড়ে দিলেন- তোমরা আজই রওনা হয়ে যাচ্ছ রাতে, সন্ধ্যে ৫টার মধ্যে সবাই এখানে আসবে। প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র, কাপড় চোপড় নিতে হবে সঙ্গে। এখন বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে আসো। একাউন্টস থেকে এডভান্সটা স্যালারিটা তুলে নাও। নিচে তোমাদের জন্য মাইক্রোবাস অপেক্ষায় আছে। আমার মনে হয় তোমরা নিউমার্কেট গেলেই সব পাবে।
১৯৯২-৯৩ সালের দিকে সব ধরনের জিনিস কেনার জন্য নিউ মার্কেটই ছিল বেস্ট প্লেস।

***************************

রাত ৯টার দিকে ওরা ঢাকা থেকে কক্সবাজারের পথে রওনা হলো। অফিসের এই মাইক্রোবাসে ওরা ৬ জন আর একজন সুপার ইনটেনডেন্ট, যার নেতৃত্বে ওরা যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে সবার সঙ্গে পরিচয়পর্ব সেরে দিয়েছে আরিফ। সঙ্গী ডাক্তারদের বাকী সবাই বরিশাল মেডিকেল থেকে পাশ করা। একমাত্র আরিফই ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়াশুনা করেছে। সঙ্গী ডাক্তারদের প্রায় সবাই বিবাহিত, দুএকজনকে দেখা গেল তাবলীগের পোশাক পরা। একমাত্র আরিফই প্যান্ট-শার্ট পরা। কলেজ জীবনেও আরিফের বেশি কিছু তাবলীগ বন্ধু ছিল, ওরা ধর্মকর্মটা একটু বেশি করে। আরিফের সাথে ওদের খুঁনসুটিটা একটু বেশি, মজা করে। বিশেষ করে ওরা যখন বলে এটা করা ঠিক না, এটা করা উচিত নয়। তখন ওদের সাথে আরিফের তর্কটা বেশ জমে ওঠে, একেবারে তথ্য ও যুক্তি নির্ভর তর্ক। আর এই তর্কটা শেষ হয় তখনই, যখন তাবলীগের কোন এক বন্ধু বলে ওঠে- আচ্ছা আরিফ আমরা এই বিষয় নিয়ে আর তর্ক না করি। নতুন এই সহকর্মীদের সাথেও নিশ্চয়ই এই রকম বন্ধুত্ব জমে উঠবে বলে মনে করছে আরিফ।
সামনের ড্রাইভিং সিটে দাঁড়িওয়ালা এক তরুণ, মাথায় কারুকাজ করা গোলটুপি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, বুকের ওপর সুন্দর কারুকাজ করা। আল্লাহওয়ালা লোক, পথের মাঝে একটা মসজিদে গাড়ি থামিয়ে সংক্ষেপে এশার নামাজ আদায় করে নিল। গাড়িতে ফিরেই বললো, সফরে আছি তাই সব রাকাত নামাজ পড়ার দরকার নাই। আল্লাহ সব ব্যবস্থা কইরা রাখছে। কে একজন পিছনের সিট থেকে বলল, কসরের নামাজ পড়ার মত দূরত্বে কি আমরা এসেছি? ড্রাইভার এই কথার উত্তর দিল না। যেতে যেতে নানা রসিকতা করলো, নিজের জীবনের টুকটাক গল্পও করল। তারপর একপর্যায়ে বলে রাখলো, কুমিল্লায় একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে হাইওয়ের পাশে, সেখানে তারা হালকা কিছু খেয়ে নেবে। খাবার খুব ভাল; রুটি মাংস, ভাত, বিরায়ানি, চা, দই, কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই সবই আছে।
ঢাকা শহরের কোলাহল পেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর মুন্সিগঞ্জের মেঘনা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় চারিদিকে জ্যোৎ¯œার আভা চোখে পড়লো। এতক্ষণ চাঁদটা চোখে পড়ে নি। শহরের চারিদিকে এত বৈদ্যুতিক আলোর মধ্যে চাঁদের আলো সহসা চোখে পড়ার কথা নয়। হয়তো অনেক আগে থেকেই চাঁদটা আমাদের সাথে আছে, আমরাই খেয়াল করি নি, মাইক্রোবাসের জানালার কাছে বসে বাইরের চাঁদটা দেখতে দেখতে এমন কথাই মনে হল আরিফের। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখের পাতা ঘুমেরভারে ক্রমশ বুঁজে আসছে আরিফের। মাইক্রোবাসে আশেপাশের সিটের অন্যান্যদের একই অবস্থা। হালকা, রসিকতায় এতক্ষণ সবাই মেতে ছিল। এখন সবাই চুপচাপ, যে যার সিটে নেতিয়ে পড়েছে, বলতে গেলে সবাই চোখেবুঁজে জেগে আছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে অল্প তথায় হু, হা করে জবাব দিচ্ছে। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে র্ফর্ফ করে বাতাস ঢুকছে সেই সাথে গাড়ির জানালার কাঁচের ঝন্ঝন্ শব্দে ঘুম আসার কথা না থাকলেও, ক্লান্তির ডাকে সাড়া দিয়ে যে যার মত ডানে-বামে কাত হয়ে নিদ্রার জগতে হারিয়ে গেছে।

***************************

সারারাত গাড়ি চলার পর ভোরে কোন একটা বড় বাজারে গাড়ি থেমেছে। ড্রাইভার তরুণটি নামাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। বাকীরা কেউই গাড়ি থেকে নামছে না, চোখবোঁজা অবস্থা থেকে একটু তাকিয়ে আবার চোখ বুঁজে ঘুমের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। ঠিক তখন ড্রাইভার এসে বলল, কেউ কি চা-পানি কিছু খাবেন? খাইলে নাইমা আসেন, হোটেল আছে।
গাড়ি থেকে কে একজন জিজ্ঞাসা করলো- বাথরুমের ব্যবস্থা আছে?
মসজিদে আছে- উত্তর করলো ড্রাইভার
কে একজন পিছনের সিট থেকে বললো- লাবলু ভাই মসজিদের ব্যবস্থাটা কেমন?
ড্রাইভার এগিয়ে এসে উত্তর দিল- মতিন ভাই, ব্যবস্থা খারাপ না আসেন, দুইটা বাথরুম, সাবান-পানি সব আছে।
আরিফ বুঝলো এরা অনেকেই পূর্ব পরিচিত। হালকা চাপ দাঁড়িওয়ালা ডাক্তারের নাম মতিন আর ড্রাইভারের নাম লাবলু। আরিফের পাশে যে বসে আছে ডাক্তারদের মধ্যে তার বয়স একটু বেশিই হবে। হালকা পাতলা গড়ন, থুতনির নিচে সামান্য দাঁড়ি। এই দাঁড়ির একটা বিশেষ নাম আছে। এই দাঁড়ির জন্য তার চেহারায় একটা চাচাভাব এসেছে। লাবলুর কথায় বিড়বিড় করে বললো, লাবলুর কাছে তো দুনিয়ার সবই ভাল। মতিন গাড়ি থেকে নেমে মসজিদের দিকে যাচ্ছে দেখে তাকে বললো- মতিন মসজিদের কাছে ইশারা করে জানিও তো ব্যবস্থা কেমন,একবার গেলে ভাল হতো, কক্সবাজার আসতে তো এখনো ২/৩ ঘণ্টা।
- ঠিক আছে সাঈদ ভাই, উত্তর করল মতিন।
আরিফ এবার জানলো পাশের চাচাগোছের লোকটির নাম সাঈদ। সবার কথা শুনতে শুনতে আরিফও ফ্রেশ হওয়ার তাগিদ অনুভব করল। বামদিকে তাকাতেই পাশে বসা সাঈদের সাথে চোখচোখি হলো। সাঈদ যে নিজেই একটু চাচাগোছের তার প্রমাণ পেলো তার কথায়। প্রথম সংলাপেই একেবারে তুমি সম্বোধন করে বললো -কী আরিফ নামতে চাও, ফ্রেশ হলে হয়ে নাও, পথে আর কোথা কী ব্যবস্থা আছে কে জানে।
আরিফ দেখলো মতিন, সাঈদকে হাত তুলে ইশারা করে আসতে বলছে। সাঈদের পিছু পিছু আরিফও নেমে পড়লো মাইক্রোবাস থেকে। সে ভাবলো, এই লোকটা তো যেচেই তার সাথে কথা বলছে, অপরিচিতজনদের মাঝে একে অনুসরণ করাই ভালো। আরিফ নেমে দেখলো মসজিদটা রাস্তা থেকে একটু দূরে সামনে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে মসজিদেরই ইমাম কিংবা মুয়াজ্জিনের সাথে খুবই পরিচিতিজনের মত করে কথা বলছে ড্রাইভার লাবলু । ডা. সাঈদ দেখে বললো- আসেন স্যার, এই হলো ফরহাদ এই মসজিদের ইমাম। আর ফরহাদ ভাই এই হইলো সাঈদ স্যার, আমাগো টিমের একজন ডাক্তার। ডা. সাঈদ এবং ফরহাদের মধ্যকার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই সাঈদ আরিফকেও পরিচয় করিয়ে দিলো ফরহাদের সাথে। পরিচয়ের ফাঁকে লাবলুও আরিফের সাথে হাত মেলালো। ইতোমধ্যে মসজিদের ইমাম মসজিদের ভিতরে তার কাজে চলে গেছে। সাঈদও গেছে ফ্রেশ হতে। বাকীরা এদিক ওদিক পায়চারি করছে যে যার মত। আরিফ আর লাবলুই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তাই আরিফই নিরবতা ভেঙ্গে বললো- আপনি কি প্রায়ই আসেন এই পথে।
- হ স্যার, প্রতিমাসে একবার আসা পড়েই। সকালে এই মসজিদে ফ্রেশ হই, অর লগে ভাল পরিচয় হইয়া গ্যাছে। এই লাইগ্যাই এখানে থামাইছি।
- কক্সবাজার যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞাসা করলো আরিফ।
- ঘণ্টা দুই-তিন, উত্তর করলো লাবলু।
এর মধ্যে মতিন ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে, হাতে নীল টাওয়েল, টুথপেস্ট-ব্রাশ। আরিফের হাতেও একই জিনিসপত্র। সাঈদের দেখোদেখি সেও একই জিনিস ব্যাগ থেকে নিয়ে বের হয়েছে।
লাবলুকে দেখে মতিন বললো- এখানকার হোটেলগুলোর কোনটা ভালো?
- ঐ যে, মায়ের দোয়া। অইডাই ভালো মতিন ভাই। উত্তর দিল লাবলু।
আরিফ লক্ষ্য করলো লাবলু মতিনকে ‘ভাই’ বলে ডাকছে আর সাঈদ এবং তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করছে। এই নিয়ে আরিফের মনে দ্বিধা উদয় হতে না হতেই তাকে দমিয়ে দিয়ে মতিনই বললো- লাবলু আমার গ্রামের ছেলে। এই অফিসে দুইবছর ধরে কাজ করে। এখানে চাকরির খবরটা ওই আমাকে দিয়েছে।
মতিনের কথায় আরিফ শুধু মতিনের চোখে চোখ রেখে একটু হেসে টেনে বললো-ও...। তারপর আরিফ আর মতিনের মধ্যে কে কোন মেডিকেলের তা নিয়ে কিছু কথাবার্তা পর দেখো গেলো। মতিন ও আরিফ একই ব্যাচের। তারপর আরিফকে মতিন আরো একটু ফ্রি করতে যেয়ে বললো- আরে আমরা সবাইতো একই ব্যাচের, কী অবাক ব্যাপার, ভালোই হলো। শুধু সাঈদ ভাই আমাদের তিনবছর সিনিয়র, সমস্যা নেই উনি আমাদের মেডিকেলেরই, আগে থেকেই চিনি। একটু অন্য রকম, তবে লোক ভাল।
মতিনের সাথে কথা সেরে আরিফ ফ্রেশ হয়ে ফিরছে। আরিফ দেখলো মতিন আর সাঈদ ভাই মসজিদের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মতিনের কথায় আরিফও সাঈদকে ইতোমধ্যে মনে মনে সম্মানের জায়গায় বসিয়েছে। সিনিয়র বলে কথা।
আরিফ দেখেই সাঈদ বলল- তুমি কি এখানে নাস্তা করতে চাও? আরিফ বললো, সবাই যেখানে করবে আমিও সেখানে করবো?
আরিফের কথা শেষ হতে না হতেই মতিন বললো- শোনেন সাঈদ ভাই, আমার এক স্যার একটা কথা বলছিলেন, যাত্রাপথে সেই হোটেলেই খাবে, যেখানে ড্রাইভাররা খায়। কারণ ড্রাইভাররা বেশিরভাগে সময়েই পথে খাওয়া দাওয়া করে, ওরা কখনো খারাপ হোটেলে খায় না।
এতক্ষণ কোথায় নাস্তা করবে তা নিয়ে মতিনের সাথে দ্বিমত চলছিল বলে মনে হলো আরিফের। মতিনের কথায় এবার সাঈদ মত পরিবর্তন করেছে।


কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে- ৩

 

পরদিন দুপুরের দিকে কক্সবাজার পৌঁছানোর পর খাওয়া দাওয়া সারলো একটি হোটেলে। হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে মাইক্রো বাসে ওঠার পূর্বমুহূর্তে সুপার ইনটেনডেন্ট সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললেন- এখন আমরা উখিয়ায় যাব, সেখানে ডাঃ আরিফ আর ডাঃ সাঈদকে কুতুপালং সেন্টারে নামিয়ে দেব। আবেগহীনভাবে কথাগুলো বললেন তিনি। বিষয়টা এমন যেন আরিফ আর সাঈদকে আগে থেকেই জানানো হয়েছে। সুপার ইনটেনডেন্ট পদের এই লোকটা সারাপথে কারো সাথেই কোন কথা বলেন নি। কোন প্রশ্ন করলে উত্তরে শুধু ‘জ্বী, হ্যাঁ-হুঁ, ঠিক আছে, দেখা যাক’ জাতীয় কয়েকটি শব্দ ছাড়া আর কোন কিছু বলেন নি। লোকটার মাথায় ছোট করে ছাটা কাঁচা-পাকা চুল, একই দৈর্ঘ্যে ছোট করে ছাটা চাপদাড়ি। চেহারাটা বেশ গম্ভীরপার্সোনালিটি সম্পন্ন, কিছুটা ভুঁড়িও আছে তবে চোখ দুটোতে কেমন শীতল একটা শীতলভাব। অনেকক্ষণ পর পর যেন চোখে পলক পড়ে। মানুষ সাধারণত মিনিটে ১৫বার পলক ফেলে কিন্তু এই লোকটা মিনিটে এক থেকে দুইবারের বেশি পলক ফেলে বলে মনে হল না। আরিফ কোথায় যেন পড়েছে, সাইকোপ্যাথরা সাধরণের চেয়ে কম সংখ্যকবার চোখের পলক ফেলে। তবে তাদের হাতের নড়াচড়া একটু বেশি থাকে। আরিফ লোকটার হাতের দিকে তাকায়। কী অদ্ভুত, লোকটার মুষ্টিবদ্ধ ডানহাতের তর্জনি এবং বুড়ো আঙ্গুলটি অনবরত পরস্পরকে ঘষে যাচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছিল হাতে তসবিহ আছে তাই এমনটি করছেণ। কিন্তু না, হাতে কোন কিছু নেই। রাতের বেলায় লোকটাকে ঠিকভাবে দেখার সুযোগ হয় নি, দেখার দরকারও হয় নি। এখন উনি যা বললেন তাতে ওনার দিকে না তাকিয়ে উপায় কী। গলার স্বরটাও কেমন ভাঙ্গা, ফ্যাসফেসে। আর যখন অন্যের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন তখন তাকে ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে হয় আরিফের। সে আরেকটা বিষয়ও লক্ষ্য করে, লোকটা কারো দিকে সরাসরি না তাকিয়ে কথা বলে; যেন ১০০ হাত দূরে দাঁড়ানো কারো সাথে কথা বলছেন। মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ থাকলেই সে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। হয়তো লোকটা নিজেও জানে তিনি ওদের সাথে অন্যায় করছেন। এপয়েন্টমেন্ট লেটারের কোথাও উখিয়ার কথা বলা নেই, বরং লেখা আছে কক্সবাজার। উখিয়া, কক্সবাজার জেলারই একটি উপজেলা। আরিফ একবার ভাবলো, বিষয়টা সুপাইনটেনডেন্ট সাহেবকে জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু চাকরির শুরুতেই কোন রকম তর্কে জড়াতে মন সায় দিল না। তবে তার শেষ লেকচারটায় আরিফের মন ভীষণ খারাপ হয়েছে। ভেবেছিল কক্সবাজারে চাকরি, এখন দেখছে উখিয়া, আরো দূরে। জায়গার এই নাম সে আগে শুনছে বলে মনে হয় না। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের পথে মাঝামাঝি অবস্থানে উখিয়া। বাসে ঘন্টা দুয়েকের পথ। আরিফদের মাইক্রোবাস যখন উখিয়া এসে পৌঁছতেই ড্রাইভার লাবলু বললো- উখিয়া বাজার আইসা পড়ছি। ঠিক লাবলুর কথার উত্তরে নয়, নিস্পৃহভাবেই সুপারইনটেনডেন্ট সাহেব একটা মনোহারী দোকান দেখিয়ে লাবলুকে বললেন- অইখানে দাঁড়াও। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করতে করতে লাবলুর পাল্টা প্রশ্ন- কিছু কিনবেন, স্যার?
- হ্যাঁ, ব্যাটারি কিনতে হবে। টর্চলাইটের ব্যাটারি লাগবে। রাতে তো টর্চলাইট লাগে অনেক সময়। আস্তে আস্তে ভারী গলায় কাউকে উদ্দেশ্যে না করেই কথাগুলো বলে গেলেন সুপারইনটেনডেন্ট
সুপারইনটেনডেন্ট সাহেবের নামটা এখনও জানা গেল না। সবাই শুধু স্যার, স্যার করছে, নাম বলছে না। আরিফ মনে মনে ভাবছে উখিয়া তো এসে গেছে, এখানেই হয়তো সাঈদ আর তাকে নামতে হবে। কিন্তু সুপাইনটেনডেন্ট সাহেব ব্যাটারি কিনে গাড়িতে উঠে সে বিষয়ে কিছু না বলে লাবলুকে বললেন- কুতুপালং ক্যাম্পে যাও।

কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে- ৪

 

সুপারইনটেনডেন্ট সাহেবের নির্দেশনা শুনে সাঈদ আর আরিফ একই সময়ে এক অপরের মুখের দিকে তাকালো। সাঈদ আরিফের দিকে তাকিয়ে বন্ধমুখে নিচের ঠোঁট আর ভুরু একসঙ্গে উপরে তুলে সংশয় প্রকাশ করলো। উখিয়া থেকে আরো দশ পনেরো মিনিটে যাওয়ার পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামলো। আশেপাশে বাজার-ঘাট কিছুই নেই। কাছে একটা মসজিদ চোখে পড়লো তার পেছনে টিলার ওপর একটা বাড়ি। কক্সবাজার থেকে আসার পথে এমন অনেক টিলা আর পাহাড় চোখে পড়েছে। শুধু পাহাড়-টিলাই নয় তাদের গাড়িটা মাঝেমধ্যে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছিলো। কোথাও ঢালু আর কোথাও উপরের দিকে উঠে যাওয়া সড়ক। কোথাও কোথাও অনেক বাঁক, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাঁকের জন্য উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসছে কী না বোঝা যায় না। এই ধরনের পথে নিয়মিত গাড়ি চালানোর অভ্যাস না থাকলে গাড়ি চালানো সহজ নয়। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথেও এমন অনেক বাঁক আছে। আসলে পাহাড়ি পথগুলো এমনই হয়।
যাই হোক গাড়িটা যেখানে থেমেছে সেটাই কুতুপালং। জায়গার এমন বিচিত্র নাম আগে শোনেনি আরিফ। কুতুপালংয়ের আগে কোন একটা মাদ্রাসার সাইনবোর্ড থেকে আরও একটি জায়গার নাম চোখে পড়েছে ‘মরিচ্যাপালং’। কুতুপালংয়ের যে জায়গায় ওরা এসেছে সেটি একটি ছোট পাহাড়ের পাদদেশ। সড়ক থেকে একশ ফুটের মত দূরে পাহাড়। পাহাড়টি ঢালু হয়ে ধীরে ধীরে সড়কের সাথে সমতল হয়ে মিশেছে। সড়ক থেকে প্রায় ত্রিশ ফিট দূরে যেখানে পাহাড়ের পাদদেশ সমতল হয়েছে সেখানে বাঁশের বেড়া আর ছাউনি দেয়া দোচালা লম্বা একটা বাঁশ-ছনের চালা ঘর। এই ধরনের ঘর গ্রামে দরিদ্র গৃহস্থেদের বাড়িতে অনেকে দেখেছে আরিফ। ছনের চালার মধ্যে ত্রিপল দেয়া আছে যাতে পানি না ঢোকে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ এই লম্বা ঘরের সামনের রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আরিফ ও তার সঙ্গী সাঈদ। স্কুলের মত লম্বা এই ঘরটি তাঁদের মেডিকেল সেন্টার প্লাস থাকার জায়গা। ঘরটিকে ঘিরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা আছে। মূল সড়ক থেকে ঘর পর্যন্ত ইট-সুড়কি বিছানো সরু পথ। রাস্তার সাথে বেড়ার মাঝখানটায় একটা গেট, সেটিও বাঁশের। সেই গেটের পাশে দাড়োয়ানের বসার জন্য ছোট্ট ছাউনিও আছে। বয়ষ্ক তবে সুঠাম দেহের অধিকারী, দাঁড়িওয়ালা একজন লোক এসে সেই গেট খুলে দিলেন। তার গেট খোলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল বাকিংহাম প্যালেসের গেট খুলছেন। আর্মি কায়গায় একটা স্যালুটও দিলেন। আরিফ চিন্তার জগত এতক্ষণ আকাঙ্খা এবং বাস্তবতার ব্যবধান দূর করতে ব্যস্ত ছিল। ভেবেছে কী আর হচ্ছে কী! কোথায় কক্সবাজারের চাকরি আর কোথায় কুতুপালং! গ্রামের বাড়ি ছাড়া কখনো টিনের চালার ঘরে থাকে নি আরিফ, গ্রামের ঘর টিনের চালার হলেও মেঝের অংশটা পাকা, কোন কোন ঘরের দেয়ালও পাকা ইটের। আর এখানে ছনের ঘর, মাটির ঢিবির ওপর, দেয়াল হচ্ছের বাঁশের বেড়া, মেঝে ইটও বিছানো নেই, একবোরে মাটি। তবে পারটা ইট দিয়ে গাঁথা, ভেতরে মাটি, মেঝটা মসৃন করে কাদা দিয়ে লেপে দেয়া। দাড়োয়ানের আর্মি কায়দার স্যালুটে আরিফের চিন্তায় ছেদ পড়ল। স্যালুট দেয়ার সময় পা যেভাবে সজোড়ে মাটিকে আঘাত করেছে সেখান থেকে এখনও ধূলা উড়ছে।

কুতুপালংয়ের ভূতপাহাড়ে- ৫

 

আশাহত আরিফ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নির্জন এক ছোট্ট পাহাড়ের পাদদেশে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মেডিকেল সেন্টারটির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। বিকেলের জাফরানী রোদ পুরো ঘরটিকে সোনালী রংয়ে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। পুরো পাহাড়টা হালকা-গাঢ় বিভিন্ন ধরনের সবুজ কচিকচি ডালপালায় মোড়ানো। খুব নির্জন এই কুতুপালং। অজান্তেই মনের মধ্যে বেজে উঠল- আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাশে! গাড়ী থেকে নামার পর মনে হচ্ছিল কানে কিছুই শুনছে না। কেমন একটা স্তব্ধভাব। সেন্টারের আশেপাশে কোন বাড়ীঘর নেই। সেন্টারের সামনে একটা পতাকা উড়ছে। এই এনজিও’র নিজস্ব পতাকা। চারিদিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়ার কাজ এখনো চলছে। সেন্টারের সামনে উঠোনের মতো খালি জায়গা। ঘরটা একদম নতুন, ভেজামুলি বাঁশের গন্ধ নাকে লাগলো। এরকম নৈসর্গিক পরিবেশে সেই বাজে গন্ধকে আরিফের কাছে গৌণ ব্যাপার মনে হলা। শহরের পরিবেশ তো অনেক দেখেছে আসিফ। চাকরির সুবাদে এমন একটা প্রাকৃতিক সুন্দর পরিবেশে অন্তত কিছুদিন থাকার সুযোগ হলো। এমন জায়গা দিয়ে মানুষ বাসে কিংবা গাড়িতে চড়ে দেখতে দেখতে মুগ্ধতা নিয়ে চলে যায়। ইচ্ছে থাকলেও থাকা যায় না। আধুনিক সব সুয়োগ সুবিধা বিবর্জিত পার্বত্য জীবন কেমন হতে পারে- সেটিকে জানার আগ্রহ হঠাৎই টুপ করে আরিফের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। যা হোক জায়গাটি ভাল লেগেছে আরিফের কাছে। এতক্ষণ সেন্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ এসব কথাই ভাবছিল। সাঈদ সাহেব এর মধ্যে প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পড়ে নেমে পড়েছে। আরিফও কাপড় ছাড়ার জন্য রুমে ঢুকলো। সেন্টারের উত্তর পাশের এই রুমটিতে দু’জন ডাক্তারের থাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। রুমের মধ্যে দু’জনের জন্যে আলাদা খাট একটা করে টেবিল-চেয়ার ও একটা কমন আলনা দেয়া হয়েছে। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে একটা হারিকেন ঝুলছে। আরিফ এতক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভাবে নি। এখন বুঝতে পারলো, এখানে বিদ্যুতেরও ব্যবস্থা নেই। ইলেকট্রিসিটি না থাকার বিষয়টি তাকে আরো বেশি হতাশ করার কথা থাকলেও এখন আর ওসব তাকে স্পর্শ করছে না। বরং হারিকেনের যুগে ফিরে যেতে পেরে ভালই লাগছে। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে দেখেছে, শেষ বিকেলে বাড়ির কাজের মেয়েরা কাঁচের চিমনিসহ হারিকেনগুলোকে পরিষ্কার করে সারিবদ্ধভাবে রেখে দিত। তারপর মাগরিবের আযান পড়ার কিছুক্ষণ আগে সেগুলোতে আলোক সংযোগ করে বিভিন্ন কক্ষে রেখে আসা হতো। এখানেও এখন সন্ধ্যা হবে হবে ভাব তাই হারিকেন জ্বালানো প্রস্তুতি চলছে। কে একজন এসে রুম থেকে ঝুলানো হারিকেনটা নিয়ে গেল। সন্ধ্যা হতে না হতেই হুড়মুড় করে গাঢ় অন্ধকারে চারপাশ ঢেকে গেল। সেই সঙ্গে একরাশ নিস্তব্ধতা। বাতাসের একটু আনাগোনাতেই শন্শন্ করে বেজে ওঠা গাছপালার নড়াচড়ার শব্দ সেই নিস্তব্ধতাকে কিছুটা বিরতি দিচ্ছে। চারিদিকের জঙ্গলগুলো রাতের অন্ধকারকে আরো নিকষ কালো করে তুলেছে। সন্ধ্যার পর এদিকে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তাই মানুষের চলাফেরাও তেমন থাকে না। জায়গাটিকে আরো একটু গভীরভাবে দেখার ও জানার ইচ্ছে হলো আরিফের। প্রথমদিন বলে তেমন কিছু জানার সুযোগ হয় নি। এসে তো পৌছালো সেই পড়ন্ত বিকেলে।
জানালার পাশ ঘেঁষে রাখা টেবিলের ওপর হারিকেনটা জ্বলছে। জানালার বিপরীত দিকের বেড়া ঘেঁষে আরিফের খাট। ছোট্ট পাতলা ফোমের হোল্ডার বেড বিছিয়ে ঘাড়ের নিচে বালিশ দিয়ে ক্লান্তি দূর করার জন্য চোখ বুঁজে শুয়ে আছে আরিফ। মনে মনে ভাবছে জীবনের প্রথম এই চাকরির কথা। কোনদিন না দেখা এই পরিবেশের কথা। ভাবতে ভাবতে এইসব পাহাড়ী এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়গুলোকে তার চিন্তায় গেঁথে আনতে লাগলো আরিফ। ঘরের ভিটেটা তো কাঁচা মানে মাটির ভিটে। সামনের দিকটা বাদ দিয়ে তিন দিকেই ছোট পাহাড়। নানান ধরনের গাছগাছালি আর লতাপাতায় আবৃত। এখানে আশেপাশে এমনকি ঘরের কোথাও কোন গর্ত থাকতে পারে। সেখানে সাপ থাকাও বিচিত্র নয়। সাপের কথা মনে হতেই বুকের মাঝখানটায় কেমন একটা খামছি খেলো আরিফ। প্রতিটি মানুষই কোন না কেন কিছুকে ভয় করে। আরিফ সাপকে মারাত্মক ভয় করে।  

বাকি অংশ বইমেলার বইয়ে।

লেখক ডা. সজল আশফাক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়