Ameen Qudir

Published:
2019-10-01 19:17:41 BdST

বাবার চিঠি: "শেষ জীবনে এর বেশি আমার চাওয়ার পাওয়ার নাই"



অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বাবুল
__________________________

সম্ভবত ১৯৯৫ এর শেষের দিকে বরিশাল থেকে ঢাকা চলে আসি। মাস্ট্রার্স পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, এখন চাকুরির ধান্ধা। '৯৪ তে পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে দাঁড়িয়ে টিকে গেলাম, একজন বললো, দেড় লাখ হলে চাকুরি কনফার্ম। বাবাকে জানালে সে বললেন, এক টাকাও নয়, নিজের যোগ্যতায় কেরানি হওয়াও ভালো। তাছাড়া দারোগার চাকরিটাকে আমি কোনো চাকরি বলেই মনে করিনা, পুলিশে চাকরি যদি করতেই চাও তাহলে বিসিএস করে সরাসরি এএসপি হও।
: তা যদি না হয়?
: না হলে দেশে এসে স্কুলে বা কলেজে মাস্টারি করো, দারোগাগিরির চেয়ে ভালো। তবে তোমার জন্যে বেছে নিতে হবে দু'টোর যেকোনো একটা, হয় বিসিএস নয় শিক্ষকতা।
বাবার চাওয়া পূরণ করতে বিসিএস প্রস্তুতির জন্যে ঢাকাতে মিরপুরে আমার বোন জাহানারা সিদ্দিকীর বাসায় উঠলাম। যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। বোনের হোটেলে ফ্রি থাকা খাওয়া আর দু'টো ভাইগ্না ভাগ্নির দেখভাল আর লেখাপড়াই আমার কাজ।
বিসিএস দেয়ার পুরোদস্তুর প্রস্তুতি চলছে, আমার ভগ্নিপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার সিদ্দিকী প্রতিনিয়ত খোঁজ নিচ্ছেন লেখাপড়ার, সকলের প্রত্যাশা বিসিএস অফিসার হতেই হবে। ফরম ফিলাপ করার জন্যে একদিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতে গেলাম মিরপুরের একটি স্টুডিওতে। স্টুডিওর নাম মনে না থাকলেও মালিকের নাম ছিলো ইসুফ, বাড়ি বরিশালে।
পাসপোর্ট ছবির সাথে একখানা রঙিন আর্টিস্টিক ছবিও তুলে ফেললাম। ইসুফ ভাই, তার নিজ খরচে এক কপি বারতি প্রিন্ট করে ওয়ালে সাঁটিয়ে রাখলো। ঘটনার মাসদেড়েক পরে মার্কেট দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ইসুফ ভাই আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, ভাই আপনাকে তো খুঁজছি।
জিজ্ঞেস করলাম কেনো?
: আপনি সিনেমায় অভিনয় করবেন?
হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে অনেকটা ভ্যাবাচাকা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, হঠাৎ এমন প্রশ্ন?
: না, মানে, একটা সুযোগ আছে।
: কি রকম?
: পরিচালক কাজী হায়াত এর প্রোডাকশন ম্যানেজার আপনার ছবিটা দেখে পছন্দ করেছে, আপনি চাইলে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।
সিনেমা, এক স্বপ্নের জগৎ, প্রেক্ষাগৃহের রূপালি পর্দায় সোনালি চলচ্ছবিগুলো চোখের সামনে খেলা করতে থাকে। মু্হূর্তেই কল্পনার ফ্রেমে অঙ্কিত হতে থাকে সুদৃশ্য কল্পনার অভাবনীয় দৃশ্যপট। প্রকাশ্য দিবালোকে উন্মিলিত নেত্রে দৃশ্যমান অদৃশ্য কিছু স্বপ্নছবি খেলা করতে থাকে অবিরাম।
ইসুফ ভাই বললো, বুজছি ভাই, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ, বাসার ঠিকান আর ফোন নাম্বারটা দিয়ে যান।
পরদিনি সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফোনটা নাকি ধরেছিলো বাসার কাজের মেয়ে কহিনুর। আমি উঠতে উঠতেই ওরা ড্রইংরুমে চলে এলো। ইসুফের সাথের কালো করে ছেলটি নাকি কাজী হায়াতের প্রোডাকশন ম্যনেজার, নামটা ভুলে গেলাম।
বললো, এখনি এফডিসিতে চলেন।
এই জীবনে কোনোদিন এফডিসির গেটের সামনেও যাইনি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এ রেস্ট্রিকটেট এলকায় ছেলেটির সাথে একদম তরতর করে ঢুকে গেলাম, কেউ আটকালো না। কিন্তু কাজী হায়াতের কোনো দেখা পেলাম না, সে পরিচয় করিয়ে দিলো জনাব হারুন অর রশীদের সাথে তিনি নাকি কাজী সাহেবের ক্যামেরাম্যান। নিজে একটি প্রোডাকশন খুলেছে, ছবির নাম হবে নাকী "মায়ের মতো মা" জানালেন মা হবেন ডলি জহুর, সালমান সাহ ফাস্ট হিরো ফাস্ট হিরোইন শাবনুর, আপনি হবেন সেকেন্ড হিরো আপনার সাথে থাকবে শাহানাজ।
সালমান সাহর সাথে আলাপটা বেশ ভালোই হয়েছিলো, অত্যন্ত বিনয়ী সদালাপি মানুষ, বললেন, এডুকেটেডদের ইন্ডাস্ট্রিতে বেশিকরে আসার সুযোগ করে দেয়া উচিত। ওমর সানির সাথে কথা বলতে চাইলেও তিনি বললেন না। অনেকের সাথেই কথা আলাপ হলো, সেকথায় আর না আসি।
একটি রুমে ঢুকিয়ে আমার কণ্ঠস্বর ও ভিডিও সট পরীক্ষা করা হলো, আমি তার মর্মার্থ বুঝলাম না, এরপর আমাকে আরো কিছু স্টিল ছবি তোলার জন্যে পাঠানো হলো ফার্মগেটের মতি স্টুডিওতে। মতি স্টুডিওর মালিক নজরুল ইসলাম খাঁন তখন সিনেমা জগতে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি বহুল আলোচিত রানাপ্লাজা ছবির পরিচালক।
নজরুল ভাই আমাকে সবসময়ই নিরুৎসাহিত করতেন সিনেমায় কাজ না করার জন্যে। খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো নজরুল ভাইর সাথে। প্রায়ই বলতেন, আপনার সোনালি ভবিষ্যত রূপালি পর্দায় আটকে দিয়েন না। আড়াই ঘন্টার সিনেমার ভেতরের আড়াই বছর কষ্ট ক্লেদ আর পিচ্ছিলতার, টিকে থাকার সিমাহীন সংগ্রামের। তবুও মন মানছে না। হারুন অর রশীদ নিয়োমিত খোঁজ নিচ্ছেন। শেষমেস বললেন, সব ঠিক আছে, আপনাকে তৈরি করতে আমাদের অনেক সময় ও ফিল্ম খেসারত যাবে, সাথের চরিত্রগুলোরও বিড়ম্বনা পোহাতে হবে। আপনার সাথে স্টাম্পে ডিড হবে এবং হাজার পঞ্চাশে টাকা সিকুইরিটি দিতে হবে, আপনি যাতে মাঝপথে চলে না যান। এ টাকা ফেরত পাবেন তবে তিন বছর আমাদের প্রোডাকশনে কাজ করার চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে।
ব্যপারটা সমস্যাসংকুল বটে। বন্ধুরা কেউ বললো, এখন এ বয়সে সিনেমায় গিয়ে কয় বছর অভিনয় করতে পারবি? শেষে সবকূল যাবে। আবার কেউ বললো, যতোবড় চাকরিই করো , তোর খোঁজ কে নেবে? সিনেমার নায়ক হতে পারলে সবাই চিনবে, এটা একটা বিরাট ব্যাপার।
মাথাটা নিয়োমিত চক্কর খাচ্ছে। বাবার কাছে সিনেমা আর টাকা দু'টোই যে মহা দু্ষ্প্রাপ্য!!
এফডিসিতে বসে একদিন পরিচয় হলো প্রযোজক সিদ্দিক আবেদীনের সাথে। তিনি তখন "গহর বাদশা ও বানেছা পরী" ছবির প্রযোজক। গ্রামের বাড়ি মঠবাড়িয়া, বাবা এসপি ছিলেন, মহম্মদপুরে তাদের ডজনখানেক বাড়ি আছে। সিদ্দিক ভাইর ছোটোভাই শামিম আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভাইর কাছে শুনে একদিন আমাকে ফোন করে বললো, দোস্ত তুই নাকি সিনেমায় যাচ্ছো?
তারপর অনেক কথা, শামিম ওর প্রযোজক ভাইয়ের সাথে একান্তে কথা বলিয়ে দিলো। সিদ্দিক ভাই বললো, সবাই কালো টাকা সাদা বানাতে সিনেমায় আসে, আর আমি সাদা টাকা কালো বানাচ্ছি। যাইহোক হারুনদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও, ফোন করে একসময় ফরিদপুর ম্যানসনে আমার অফিসে আসো, আমার পরিচালক জীবন রহমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, পরবর্তী যে কোনো ছবিতে যেনো তোমাকে নিয়ে নেয়। সিদ্দিক ভাইর তখন "আলী কেনো গোলাম" ছবির কাজ চলমান।পরিচালক জীবন রহমানের সাথে পরিচয় হলো। সিদ্দিক আবেদীনের প্রোডাকশনের নাম রাখা হয়েছে তার ছেলে হিমেলের নামে। ম্যানেজার শাহজাহান ভাই বললেন, এরকম একটা জ্যাক পাওয়া সহজ ব্যাপার না, লেগে থাকেন কাজে আসবে।
হারুন ভাইর ছবিতে অফারের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে রেগে বললো, বাদ দেন তো! ওসব হারুন ফারুন, টাউট বাটপার, সিদ্দিক ভাই বাজে লোক না, তার একটা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, তাছাড়া সে কথার বরখেলাপ করেনা।
বিয়ে করেছেন?
বললাম, না, কেনো?
: বিয়ে করলে ইমেজ থাকেনা, আগে হিরো হন।
আজ মনে পড়লে খুব হাসি পাচ্ছে সেসব কথা। কোথায় বিসিএস কোথায় কি? প্রতিনিয়ত এফডিসি, কাকরাইলের ফরিদপুর ম্যনসন। বাহিরে পলেস্তারা বিহীন এক অগোছালো সুউচ্চ ভবন, ভেতরে বিলাসবহুল সাজসজ্জাময় প্রোডাকশনের দামি অফিসগুলো। প্রতিদিন অসংখ্য তরুণ তরুণীদের আনাগোনা সিনেমা নামক এক কুৎসিৎ রঙিন জগতে নাম লেখানোর অভিপ্রায়ে।
আমার একটি ইয়ামাহা বাইক ছিলো। আমার সাথে পরিচয় হবার পর সিদ্দিক ভাই আর ঝোটোখাটো প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে বের হয়না, আমাকে ফোন দিলেই মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির হই। আস্তে আস্তে সিদ্দিক ভাইর পরিবারের সাথেও একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি।
বিষয়টি আর গোপন থাকলো না, নানান কান হয়ে একসময় অসুস্থ বাবার কানে গিয়েও পৌঁছলো সে বার্তা। সরল ধর্মপ্রাণ বাবা, যে একদিন আমার হাতে কোরান শরীফ তুলে দিয়েছিলেন আমি যেনো বাম ছাত্রসংগঠন না করি। চট্রগ্রাম থাকতে মা একটা সিনেমা দেখার জন্যে বাবাকে অনেক অনুরোধ করলেও বাবা তা রাখেননি, অনেক ধরে বলে সবাই মিলে একটা ছবি তুলতে রাজি করিয়েছিলাম বটে কিন্তু বাবা নিজে সে ছবিতে থাকেননি। সেই বাবা আমার এহেন মতিভ্রমে ব্যথিত হয়ে আমার বোনের কাছে চিঠি লিখলেন, যার কথাগুলো ছিলো নিম্মরূপ-
"তোমরা ভালো থাকো সেটাই আমার চাওয়া, আমার তো জীবনের শেষ কখন কি হয় জানিনা, যেকোনো সময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারি। হার্টের সমস্যাটা আগের চেয়ে বেশি, যেখানে সেখানে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকি। মাকে চাচাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, এ লক্ষণ ভালো না। কিন্তু জীবনের এ অন্তিমলগ্নে আমার একমাত্র ছেলেকে দোযোখের আগুনে জ্বলতে দেখে যাওয়া যে কতোটা কষ্টের তা তোমাদের বোঝা উচিত। শুনছি বাবুলকে সিনেমায় পাঠাচ্ছো, তোমরাই এখন ওর অভিভাবক। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্যটা যেনো থাকে। শেষ জীবনে এর বেশি তোমাদের কাছে আমার চাওয়ার পাওয়ার নাই....।"
চিঠিটা আমার বোন আমার হাতে দিয়ে বললেন, দরকার নাই, ওসব বাদ দিয়া চাকরি বাকরির চিন্তা কর।
বাবার অসুস্থতাটা আরো বেড়ে গেলো। প্রথমে বরিশাল তারপর ঢাকা আবার বরিশাল হয়ে বাড়িতে। সোহরায়ার্দী হাসপাতালের বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ ডা. সিরাজুল ইসলাম বললেন, এ বয়সে, এ শরীরে অপারেশনের ঝুঁকি নেয়া যাবেনা। ঔষধে যতোদিন বেঁচে থাকে ততোদিনই লাভ, তবে যেকোনো সময়ের যেকোনো অবস্থার জন্যে আপনারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন।
বাবা হাত ধরে বললেন, আমার একটা অনুরোধ... ।
বাবার অনুরোধ গৃহীত হলো, সিদ্দিক আবেদীনকে আমি সবিস্তারে জানিয়ে দিলাম। সিদ্দিক ভাইও বললেন, তুমি শখ করেছো তাই, সিনেমা জগতে খুব ভালো করতে পারলে ভালো, না করতে পারলে তার কোনোই দাম নেই।
ওবছরই ৩০ সেপ্টম্বর ১৯৯৬ রাত আনুমানিক ৩-৪৫ এ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমার না হলো সিনেমা না হলো বিসিএস। অবশেষে বাবার চাওয়া অনুযায়ী শিক্ষকতাই জীবনবৃত্তি হয়ে জীবনবৃত্তের বৃন্ত হয়ে জড়িয়ে গেলো। আজ বাবার মৃত্যুদিন। কতো না লেখা চিঠি তোমার কাছে জমা হয়ে আছে বাবা। এ জীবনের চলার পথে সেগুলো যে পরতে পরতে দরকার। খুব মনে পড়ছে তোমাকে বাবা। ভালো থেকো, অনেক অনেক ভালো থেকো, সেই কামনায়।
____________________
মাসুদ আলম বাবুল। পেশায় শিক্ষক । কলেজ অধ্যক্ষ ও লেখক হিসেবে দু বাংলায় সমাদৃত ।
সবুজবাগ, পটুয়াখালী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়