Ameen Qudir

Published:
2019-09-25 20:38:20 BdST

কাহিনিপ্রেমজীবনের স্বাভাবিক প্রেমের ঠিক উল্টো উদ্ভট ও বৈচিত্র্যময় সব ঘটনা


লেখকের ফাইল ছবি।

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
সুলেখক


_______________________

 

ইডেন মহিলা হোস্টেলের পাশের রাস্তায় ড্রেনের উপর উপুর হয়ে হড়হড় শব্দে বমি করছি। বমির তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। পথচারীরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পথের মানুষকে ঘরে নেওয়া যায় না। নিতান্তই করুণা করা যায়। সঙ্গত কারণেই মানুষজন বমিরত আমার দিকে করুণাবশত তাকাচ্ছে। অতঃপর কিছুই হয়নি ভেবে চলে যাচ্ছে। এক মহিলা রিক্সা থেকে একবার ‘আহারে’ বলল। রিক্সাওয়ালা নিজেও দু’বার চুকচুক করে শব্দ করল।
বমিরত যুবকের পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। অগুরুত্বপুর্ণ তথ্য হল, আমার নাম রিয়াদ। ঢাকা মেডিকেলে ফোর্থ ইয়ারে পড়ি। ক্লাশে নিয়মিত নই। ইকুলিব্রিয়াম থিউরি অনুযায়ী, প্রকৃতির একাংশ অলস হলে আরেক অংশ পরিশ্রমী হয়। আমার ক্লাশের অনিয়মিত ব্যাপারটি পুষিয়ে দিচ্ছি নিয়মিত গল্প লিখে।প্রতিদিন রাত দশটায় ফেসবুকে গল্প পোস্ট করি। এক্টিভিটির পরম্পররায় আমার পাঠক বা অনুসারী সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছি। ব্যাপারটি নিয়ে আমি কিঞ্চিত আত্মগরিমায় থাকি।
ক্লাশ না করা লেখক-কবিরা খানিকটা হতাশাগ্রস্থ হোন। আমি ব্যতিক্রম হতে পারিনি। দিনের অধিকাংশ সময় আমাকে ঘুমুতে দেখা যায়। বিকেলের একটাসময়ে পলাশী থেকে ইডেন কলেজের সামনে দিয়ে আজিমপুর গোরস্থান ঘুরে আসি। কদাচিৎ ইডেন কলেজের সামনে কাকতাড়ুয়ার মত দাঁড়িয়ে থাকি। রিক্সায় উঠে অসীমের দিকে চলে যাওয়া যুবক-যুবতীর দিকে তাকিয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রেমে বিহব্বল জুটি দেখলে আমি নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করি। চেষ্টা খুব একটা কাজে দেয় না। নিঃসঙ্গতা বা অভাববোধ বা কোন অস্পষ্ট অনুভূতি থেকে আমার হৃদপিণ্ড ঘনঘন বিট দিতে শুরু করে। আমারই অলিন্দ নিলয় থেকে ছিটকে যাওয়া রক্তের কণাদের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হয়, আমি গভীর হতাশায় ডুবতে থাকে এক মানুষ। হতাশা থেকে উদ্ধারের কোরামিন ইঞ্জেকশন হল, আমাকেও একবার রিক্সা উঠতে হবে। আমার পাশে বসে থাকবে সুদর্শনা ললনা। আমি ললনার কোমরে হাত দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলব, টিএসসি চলো মামা।
যেহেতু হতাশা উদ্ধারের আশু ব্যবস্থা নেই, তাই আমার হতাশাগ্রস্থ লেখক বা কবি মস্তিষ্ক মাঝেমাঝে ননসেন্স রাইম বানিয়ে ফেলে।
বমি করবার পূর্বেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া নতুন ও স্বরচিত ননসেন্স রাইমটি ছিল,
কী সুন্দর তাঁরাগুলি, জ্যোৎস্না তার রাতি
আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একপাল হাতি।
শখের বশে পলাশী স্ট্রিট চাইনিজ খেয়ে আমার মরণাপন্ন দশা। প্রজেক্টাইল ভমিটিং। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। দাঁড়াতেও পারছি না, বসতেও পারছি না। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেরেবেলাম তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখনই তালগোল পাকিয়ে ড্রেনের মধ্যে পড়ে যাব। সরু ড্রেনের ভেতর সাপের মত সোজা হয়ে মরে থাকব। যেহেতু পথের জিনিস কেউ ঘরে নেয় না, সেহেতু ড্রেনের জিনিসও কেউ টেনে তুলবে না।
‘লাল গ্যাঞ্জিওয়ালা ভাইয়া, পানি...।’
আকস্মিক ‘ভাইয়া’ ডাকে আমি মাথা তুলে তাকাতে চেষ্টা করলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাকেই ভাইয়া বলে ডাকা হচ্ছে। কারণ আমার পরণে লাল গ্যাঞ্জি। বয়স অনুপাতে আমি ভাইয়া গোত্রীয়। চাচা বা মামা টাইপের না। এবং বমিরত মানুষকেই পানি সাধা যায়।
পানিওয়ালাকে দেখতে মাথা তুললাম। পারলাম না। মাথা ঘুরে ধুপ করে ড্রেনের পাশে পড়ে গেলাম।
ন্যাশনাল ফ্যানের মত মাথা বনবন করে ঘুরছে। আশ্চর্যের ব্যাপার চরম অস্বস্তির মুহুর্তেও মস্তিষ্ক বেশ কাজ করছে। শার্লোকীয় স্টাইলে আমি শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম।
ভাইয়া অথবা পানি বলে চিৎকার করছে যিনি, তিনি লিঙ্গে নারী। পাতলা গলার স্বর। বয়স অল্প। আশেপাশে কোন অল্পবয়স্কা নারী বা তরুনীকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমে পুরুষদের রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। সেখানে থাকার সম্ভাবনা নেই। একমাত্র সম্ভাবনা উপর থেকে কেউ চিৎকার করছে।
আমি পিচরাস্তায় শুয়ে উপরে তাকালাম। ইডেন কলেজের লেডিস হলের কোন একটি জানালা থেকে একটি হাত পানির বোতল ছুড়ে দিচ্ছে। বমিতে চোখমুখ মাখামাখি ও দৃষ্টির পুরোটা ঝাঁপসা হয়ে যাবার আগে আমি জানালা সনাক্ত করতে পারলাম না।
জনৈক রিক্সাওয়ালা পানির বোতল কুঁড়িয়ে এনে আমার চোখেমুখে ঢালতে শুরু করল। আমি প্রশ্ন করলাম,
‘পানি কে দিল?’
রিক্সাওয়ালা একদলা থুতু পিচিক করে আমার মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘কোন শালি দিছে, আমি কেমনে কই?’
অপ্রকাশিত শ্যালিকা বা জলদাত্রীর প্রতি প্রবল মায়া নিয়ে আমি ইডেন লেডিস হোস্টেলের নিচে প্রায়ই দাঁড়াতে শুরু করলাম। আমার পরনে লাল টি-শার্ট। হাফ প্যান্ট। একটি মাত্র টি-শার্ট লাল হবার কারণে প্রায়ই পারফিউম মেখে উল্টে পাল্টে পরতে শুরু করলাম। টি-শার্ট পুনব্যবহার্য হলেও জানালা দিয়ে পুনর্বার কেউ খেয়াল করল না। আগ্রহ নিয়ে কেউ বলল না, লাল গ্যাঞ্জিওয়ালা ভাইয়া, পানি।’
রবার্ট ব্রুশীয় অপেক্ষার ধৈর্য্য ব্যর্থতায় পর্যবশিত হল। দু’সপ্তাহের মাথায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পূর্বের ঘটনার রিহার্সেল দিব। ইয়াক ইয়াক বলে বমি করবার চেষ্টা করব। একশত একুশটি জানালার ভেতর নিশ্চয় কোন একটি জানালা থেকে দয়ার্ত কোন তরুনী পানির বোতল ছুড়ে দিবে।
পরিকল্পণা বেশ হাস্যকর। হাস্যকর পরিকল্পণা বাতিল করা হল।

ইডেন শেখ ফলিজাতুন্নেসা মুজিব ছাত্রী হলের ... নাম্বার কক্ষের জানালার গ্রীল ধরে জনৈক তরুনী বাইরে তাকিয়ে আছে। তরুনীর নাম কাঁকন। কাঁকনের বর্তমান ধারণা সে বড়সড় বিপদে পড়েছে। বিপদের কারণ লাল টি-শার্ট পরা যুবক। যুবক ইয়াক ইয়াক শব্দে বমির চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগেও লাল টি-শার্টের এক যুবককে বমিরত অবস্থায় সে পানির বোতল ফেলে দিয়েছিল। দু’সপ্তাহ পর প্রতিদিনই একই সময়, একই রঙের যুবকদের বমি করতে দেখা যাচ্ছে। জায়গার সমস্যা নাকি ভূতের উপদ্রব?
কাঁকন চোখ বড়বড় করল। অক্ষিগোলক ফোকাস করল। চশমা ছাড়া ক্রমবিলীয়মান দৃষ্টিশক্তির কারণে যুবককে চিনতে পারল না।

অতিরিক্ত ফ্যান্টাসী রীতিমত অভিশাপ হয়ে ফিরে আসল। বমি-অভিনয় পরিকল্পণা বাস্তবায়নের চতুর্থদিন আমার মাথায় আক্ষরিক অর্থেই পঁচাডিম ফাটল। লেডিস হোস্টেল প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। উপর থেকে মস্তিষ্ক বরাবর কেউ একজন পঁচা ডিম ছুড়ছে। আমি একশত একুশটি জানালায় দ্রুত চক্ষু অভিযান চালিয়ে গেলাম। অভিযান সফল হল।লেডিস হোস্টেল দালানের ভুমি ও উচ্চতার মধ্যবিন্দু হতে দুটি পরস্পর লম্বচ্ছেদি সরলরেখা টানলে যে বিন্দুতে মিলিত হয়, সেই জানালায় একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার কক্ষ। মুখচ্ছবি দেখা না গেলেও মাথাভর্তি ঝাউবনের মত চুলের দুলুনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি হতভম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।

গত সপ্তাহেছাপড়া মসজিদ বাজার থেকে কিনে আনা ডিম খাওয়া হয়নি। অতিরিক্ত গরমে নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট ডিমেরও বিশেষ ব্যবহার আছে। কাঁকন হোস্টেলের সীমানাপ্রাচীরে প্রস্রাব করা মানুষের মাথা সোজা করে পাঁচ তলা থেকে ডিম ছুঁড়ছে। আশ্চর্যজনকভাবে একটা ডিম পড়েছে লাল গ্যাঞ্জিওয়ালা যুবকের মাথায়। যুবক হতভম্ভ হয়ে রাস্তার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার অস্থির চোখ উপরের জানালায় কিছু একটা খুঁজছে। ঘোলা চোখে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, আন্দাজ করা যাচ্ছে, যুবক চোখভরা জন্ম জন্মান্তরের তৃষ্ণা নিয়েতার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই তৃষ্ণার উৎস কী?

আজীবন সমালোচনা সহ্য করেও গ্রহের সম্মান নিয়ে গ্রহতালিকার এলিট লিস্টে ছিল প্লুটো। সহ্যসীমা অতিক্রমের পর একদিন প্লুটোকে ঠিকই বামণ গ্রহ অভিশাপ নিয়ে ছিটকে পড়তে হল। স্বাভাবিকভাবে আমিও এমনই কিছুর প্রত্যাশা করছি। নিজের আত্মিক তৃষ্ণা ও মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে ইডেন কলেজের লেডিস হোস্টেলের নিচেররুটিনবদ্ধ অপেক্ষা বিসর্জন দিয়ে চলে যাচ্ছি। অভিশাপও মাঝেমাঝে ভোল পাল্টে বর হয়ে ফিরে আসে। আমার ঈশ্বরীয় বর হয়ে কোন একটি জানালা থেকে পানির বোতল উড়ে আসল। আমি বোতল কুঁড়িয়ে লক্ষ করলাম, স্বচ্ছ বোতলের গায়ে ঘন কৃষ্ণবর্ণে পার্মানেন্ট মারকার পেন দিয়ে কেউ একজন দশ ডিজিটের মোবাইল নাম্বার লিখে রেখেছে। শেষ ডিজিটটি নেই। অল্পতেই তুষ্ট হওয়া গৃহপালিত পশু কিংবা আজন্মের তৃষ্ণার্ত প্রেমভিখারির জন্য দশ ডিজিটই একখণ্ডস্বর্গ। আমি স্বর্গ বুকে হোস্টেলে ফিরে চললাম।
শেষ ডিজিট খুঁজে বের করা খুব অসম্ভব নয়।
রাত দশটায় বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত দশটি অংককে ঘুরে ফিরে এগারোতম ডিজিটস্থলেবসিয়ে ডায়াল করলাম। ফোন কানে চেপে উন্মুখ হয়ে বসে রইলাম।
চারটি নাম্বার বন্ধ।
দু’টি নাম্বারে পুরুষের কণ্ঠ।
স্বাভাবিকভাবেই অনার্স পড়ুয়া কোন ছাত্রীর ফোন তার অভিভাবক ধরবে না।অথবা রাত দশটায় কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার ফোনকল রিসিভ করবে না। অথবা হতে পারে সে ইচ্ছে করেই নাম্বারটি ভুল লিখেছে।
চারটি নাম্বার ধরল মেয়ে।
তিনজন বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলল।
চতুর্থজন বলল,
‘মাইয়া পাইলেই মাথায় মাল উঠে যায়?’
আকস্মিক আক্রমণ। প্রতিহত করবার মত মানসিক শক্তি বা সাহস কোনটিই আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। মাথায় মাল উঠে যাওয়া বাক্যটির ভাবসম্প্রসারণও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বরং একটি ছায়ামুর্তি দেখে মাথা ঘুরে যাবার ব্যাপারটি বেশ যুক্তিযুক্ত। রাগান্বিত তরুনী জানে না, বমিতে মৃতপ্রায় এক তরুণের মস্তিষ্কে তারইকণ্ঠস্বর খোঁদাই করা আছে।
আমি হেসে বললাম,
‘আপনি চাইলে আমি বাকীটা জনম বমি করতে করতেই কাটিয়ে দিতে পারি। আপনি কী পানির বোতল দিতে দিতে কাটিয়ে দিতে পারবেন?’
রাগান্বিত মেয়ে হেসে ফেলল। এত চমৎকার হাসি আমি কোনোদিন শুনিনি। আমার কানের টিমপ্যানিক মেমব্রেন হতভম্ভ হয়ে দুলতে লাগল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও সাহিত্যের অলগলি ঘুরে বেড়ানো আমার মস্তিষ্কে একটিও বিশেষণ খুঁজে পেলাম না।
নাম্বারপ্রাপ্তির দশম দিনে আমাদের স্বাক্ষাত হল।
নাম কাঁকন। ইডেন কলেজ। অনার্স ফোর্থ ইয়ার। মার্কেটিং।
প্রথম স্বাক্ষাতেই খানিকটা ধাক্কা খেলাম। আমার মত কিম্ভুতদর্শনের প্রাণির সামনে স্বয়ং স্বর্গীয় দেবীর অধিষ্ঠান। দেবীর সৌন্দর্য্যে আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। চুম্বকের বিপরীতমেরু যেমন ধর্মমেনে পরস্পর আকর্ষিত হয়, তেমনই আকর্ষণের নিমিত্তে তাদের দূরেও সরে যেতে হয়। এজন্যই দৈবাৎকাছে আসার ব্যাপারটি আমার জন্য দ্বিধার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।দেবীপ্রাপ্তির পর দেবীকে হারানোর আশঙ্কার মত। আমার ভাঙ্গা ঘর, ভাঙ্গা চাঁদের আলোর জীবনে এমন চমৎকার দেবীকে মন্ত্রমুগ্ধ করে আটকে রাখা কতটা সম্ভব?
দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে শুরু করলাম। প্রেমসুখ ও হারানোর পারস্পারিক অনুভূতি আমাকে অস্থির করে তুলল। সময়ের সাথে ক্ষত শুকিয়ে যায় কিন্তু মানবমনের দুরত্ব ব্যাপারটি যুগপৎভাবে বাড়ে ও কমে।কাঁকনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠায় আমাদের দুরত্ব দিনদিন কমতে শুরু করল। নানা ঘটনা ও দূর্ঘটনা শেষে একদিন কাঁকন আমাকে বুঝিয়ে ফেলল,
‘ভয় নেই পাগলা। আই এম হেয়ার।’
প্রেমজীবনে স্বাভাবিক প্রেমের মতই কতিপয় রুটিনবাঁধা ঘটনা ঘটবে ভেবে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার অপেক্ষা বিফল হল। উদ্ভট ও বৈচিত্র্যময় সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল।
প্রেমপরবর্তী জন্মদিনটিই আমার নাতিক্ষুদ্র জীবনে প্রথম আড়ম্বরে পালিত জন্মদিন। কাঁকন প্রথমবার্থডের ভোরবেলা আমাকে নিয়ে চলে গেল রমনা বটতলা। দশটাকার টিফিন কেকের উপর এগারো টাকা মূল্যমানের বেনসন ব্লু গোল্ড সিগারেট উল্টো করে পুঁতে রেখে বলল,
‘বৈচিত্র্যময় হোক তোমার প্রেমজীবন।’
সিগারেট পুড়তে পুড়তে ছাই হল। আমি ছাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম।কাঁকন হাত তালি দিয়ে আমাকে শুভকামনা জানাল। ভোরবেলা জগিং করতে থাকা শত নারী পুরুষ ভ্রূ কুঁচকে হয়তো খেয়াল করল,
‘অদ্ভুত দর্শনের এই পুরুষটির পাশে এই স্বর্গীয় পরীটি কেন? হাহ?’
চুইংগামের অর্ধেকটার ন্যায্য হিস্যাও তাকে দিতে হবে। চিবানো শেষে চুপচাপ রেখে দিবে আমার বইয়ের পাতার ভাঁজে। আমি পাতা উল্টোবো, ভাঁজ খুলব, বইয়ের পাতা ছিড়ে যাবে। তাতেই তার আনন্দ। আজন্ম বই-কবিতা আর গল্প বিরোধী প্রেমিকাকে আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হলাম।
লেখক জীবনে আমি কখনোই রাবীন্দ্রিক প্রেমিকা চাইনি বা বিশেষ আগ্রহ হয়নি। প্রথমবার আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বুকের ভেতর গাঢ় অনুভূতি। আমি খুব করেই চাচ্ছি, আমার লেখক জীবনকে সে কিছুটা গুরুত্ব দিক, খানিকটা মায়া করুক, অনেকটা ডুবে যাক আমার লেখক সত্ত্বার মধ্যে।
কাঁকনকে ডুবোনার গোপণে নানানপরিকল্পণা করলাম। পরিকল্পনামাফিক একদিন অকস্মাৎ কাঁকনের সামনে পাওলো কেয়েলহো থেকে পড়া শুরু করলাম। কাঁকন আগ্রহ পেল না। রাগে ছুঁড়ে ফেলে দিল কোয়েলহোকে। শাহাদুজ্জামানের বিভ্রম সৃষ্টিকারী শিরীষ পাতার গল্প শুরু করলাম, মুখ ফিরিয়ে নিল। চানক্য বা গোপালভাঁড়েও একই অবস্থা।
অনোন্যপায় হয়ে একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
‘চলো নিজেদের প্রেম নিয়ে গল্প বানানো শুরু করি।’
কাঁকন আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে দিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার দু’চোখের মুগ্ধতা খেয়াল করলাম।
প্রেমজীবনের বিশেষ মুহুর্ত। আমি রাতভর গল্প বানাই। দিনের অনেকটা সময় তাকে পাশে বসিয়ে গল্প শোনাই। তরুনী মুগ্ধ হয়। আমার বামবাহুতে মাথা রেখে বলে, একটা কবিতা শোনাও।
আমি চমকিতহই। কবিতার প্রতি কাঁকনের বিশেষ আকর্ষণ আমাকে নাড়িয়ে দেয়। আমি হেলাল হাফিজের ‘যাতায়াত’ আবৃতি করি,
‘ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়েযেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যাতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রুষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।
বাঙালি প্রেমিকদের কাছে বাঙ্গালি প্রেমিকাদের প্রেমিক-দিকমুখী পরিবর্তন বরাবরই সুখকর। আমার প্রেমিকার পরিবর্তনের আনন্দে আমি সাতদিনে চৌদ্দটিগল্প লিখে ফেললাম। সব গল্পই যে মনমতো হচ্ছে এমন নয়। কেউ একজন বামবাহু ধরে কাঁধে মাথা রেখে আছে, আমি তার কানের কাছে চুলের ভেতর মুখ রেখে ফিসফিস করে গল্প বলছি, এমন স্বর্গীয় মুহুর্তের লোভে আমি একদিনেই চৌদ্দশত গল্প লিখে ফেলতে পারি।লোভের কাছে আমার লেখকসত্ত্বা পরাস্থ হলেও আমি সানন্দে মেনে নিতে রাজি।
আজন্ম জ্ঞানবিদ্বেষী কাঁকন একদিন আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘কিছু জ্ঞানের কচকচি শোনাও তো।’
আমি আনন্দিত চিত্তে জ্ঞানের কচকচি শুরু করলাম। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো, জানতে চাও?’
‘হুম।’
‘প্রথমে সব গ্রহ, নক্ষত্র সব একটি বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল। যার ভর শূণ্য কিন্তু ঘনত্ব অসীম। বুঝেছ?’
‘হু।’
‘সে সময় পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সুত্রই কাজ করত না। এই অবস্থাকে বলে সিঙ্গুলারিটি। বুঝেছ?’
‘হুম।’
‘কীবুঝেছ, বলো?’
কাঁকন নিরুত্তর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মহানন্দেও বজ্রাহত হই। আবিষ্কার করি, কানের কাছে ফিসফিস করবার ব্যাপারটি একপাক্ষিক আনন্দের নয়, কাঁকনও বড় আনন্দ নিয়ে আমার গল্প কিংবা জ্ঞানের কচকচানি উপভোগ করছে।
আনন্দের পরিক্রমায়আমি দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রাণের আবির্ভাব, বিবর্তনবাদ, নস্ট্রাডামুস, এরিস্টটল কিছুই বাদ গেল না। মার্কেটিং এ পড়া কাঁকন না বুঝেই সবকিছুই যত্ন করে শুনতে লাগল। আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মনে হল, লাভ অন ফায়ার।
একদিন রাতে কাঁকন বায়না ধরল,
‘একটা কবিতা বলো তো।’
‘কার কবিতা? জয় না রুদ্র?’
‘তোমার কবিতা।’
‘আমি তো কবিতা লিখি না। শুধু গল্প লিখি।’
‘একটা লিখে শোনাও।’
আজন্মের গল্প লেখকের আকস্মিক কবিতা চাহিদার কথা শুনে আকাশে মেঘ দেখে ঘরপোড়া গরুর মত ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। সারারাত ঘুমুতে পারলাম না।কই মাছের মত বিছানায় এপাশ ওপাশ তড়পাতে শুরু করলাম। চোখের ভেতর রক্তজমে লাল হয়ে গেল। মাথার চুল উষ্কোখুস্কো হয়ে গেল। এক কোটি কাগজের স্তুপ জমে গেল ঘরময়। আমি বিফল হয়ে, ব্যর্থ মনোরথে ভোরবেলা কাঁকনের সামনে উপস্থিত হলাম।
আমার পাগলপ্রায় দশা দেখে সে খানিকটা ভড়কে গেল। জিজ্ঞাসা করল,
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি।’
‘কিছু তো কিছু হয়েছে। সেটা কী?’
‘একটা কবিতা লিখে ফেলেছি।’
‘শোনাও।’
আমি গদ্যকবিতা আবৃতি করে শোনাতে শুরু করলাম,

 

তোমার ঠোঁটভর্তি রসগোল্লা
নখভর্তি ইনসুলিন
আমি হতভম্ভ ডায়াবেটিক প্যাশেন্ট।মাত্র তিন লাইনের একটি হাস্যকর কবিতা। এই কবিতা কাউকে এতটা মুগ্ধ করতে পারে, যার বদৌলতে অযুত-নিযুত মানুষের সামনে আমার কপালে কাঁকন চুমু দিতে পারে, এমন ঘটনায় আমি পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষের চাইতে নিজেকে অধিক সৌভাগ্যবান হিশেবে আবিষ্কার করলাম।অতি আনন্দে তৎক্ষণাৎ নিজেকে একশ পৃথিবীর রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলাম। আমার একশ পৃথিবীর একছত্র রানী হিসেবে কাঁকনকে অধিষ্টিত করলাম। এরপরকাঁকনের কানে ফিসফিস করে বললাম,তুমি যেমন ইচ্ছে শাসন কোরো।
আমরা হাঁটছি।
আমার ডানবাহুতে মাথা চেপে ধরে কাঁকন হাঁটছে। তার কান আমার বাহুপেশীতে লেগে আছে।
‘রিয়াদ।’
‘হু।’
‘আমি তোমার হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি।’
‘পায়ে পেরিফেরাল হার্ট আছে কিন্তু হাতে তো কোন হার্ট থাকে না। বুকের মধ্য মেডিয়াস্টিনামে থাকে। কোথায় বিট পাচ্ছ?’
‘হার্ট যেখানেই থাকুক। আমি হার্টবিট পাচ্ছি।’
আমি হাত বাড়িয়ে কণ্যাকে জড়িয়ে ধরলাম।

 

মাঝেমাঝে কাঁকনের মন খারাপ হয়।
অতি তুচ্ছ কারণে মন খারাপ করে ফেলে। মন খারাপের যৌক্তিক কারণ অকারণ খোঁজার মত সময় আমার হাতে নেই। প্রেমজীবনের একটি সেকেণ্ডও নষ্ট করার জন্য রাজি নই। আমি কাঁকনের কানে ফিসফিস করে বলি,
‘কিছু জানতে চাও?’
কাঁকন অভিমান নিয়ে বলে,
‘না।’
‘ধুমকেতুর পেছনে ধুলোবালি উড়ে আসে কীভাবে জানতে চাও?’
‘না।’
‘প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে বলব?’
‘না।’
‘পাই এর মান দশমিকের পর বিশঘর পর্যন্ত বলব?’
‘না।’
‘একটা গল্প বলি?’
‘গল্প শুনব না।’
‘আমিই বানিয়েছি। বলি?’
‘কী গল্প?’
‘একটা খেকশিয়ালের গল্প। সে একটা বাঘিনীর প্রেমে পড়ে। হুড়মুড় করে প্রেমে পড়ার মত। বাঘিনীকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। বাঘিনী রেগেমেগে খেকশিয়ালকে তিনটা শর্ত দিল। যদি এই শর্ত পূর্ণ করতে পারে তবেই তাদের বিয়ে হবে। শুনতে চাও সেই গল্প?’
কাঁকন হেসে ফেলে।
‘চাই। খেকশিয়াল কী শর্ত পুর্ণ করতে পারে?’
‘জানি না।’
‘শেষ পর্যন্ত কী ওদের বিয়ে হয়?’
আমি হেসে ফেলি। বোকার মতো বলি,
‘গল্পটা এ পর্যন্তই লিখে আটকে আছি। সমাপ্ত করতে পারিনি। পারলে বলব।’
কাঁকন গম্ভীর হয়ে বলে,
‘ওদের বিয়ে দিবে।’
আমি মাথা দুলিয়ে বলি,
‘আচ্ছা।’
কাঁকন হাসে। আমি তার হাসিতে ভিজতে থাকি। ভিজে জবজবে হয়ে যাই।

একদিন কাঁকনের মন খারাপ হল। রুষ্ট হল। আকাশ পাতাল এক করে আমি খুঁজতে থাকলাম, মন খারাপের কারণ। পেলাম না অথবা আমার টিউবলাইট টাইপের মস্তিষ্ক অতি সাধারণ কারণটি ধরতেই পারল না।
প্রচণ্ড অভিমানে কোন যুক্তি বা কারণ না দর্শিয়েই ঢাকা শহরের ব্যস্ততম নীলক্ষেত সিগন্যালে আমাকে জড়সড় করে রেখে কাঁকন শেষবারের মত চলে গেল।
আকস্মিক প্রেমবিচ্ছেদ মেনে নেওয়া আমার পক্ষ্যে অসম্ভবপর হয়ে দাঁড়াল। আমার সাতাশের সবল হাঁটু মুষড়ে মুড়ে গেল। রঙ্গিন আলো মুহুর্তে সাদা কালোতে রুপান্তর হল। গাছের পাতা সবুজ থেকে বদলে গেল বর্ণহীনতায়। আমি আক্ষরিক অর্থেই চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম।
বিচ্ছেদের পরবর্তী দিনগুলো কাটল ছন্নছাড়ার মত।
আমি কাঁকনের জানালায় দাঁড়ানো শুরু করলাম। ভোর হতে মধ্যরাত লাল টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকি। নামে বেনামে নানান উপমা ব্যবহার করে স্বরচিত কবিতা লিখে দিস্তায় দিস্তায় চিঠি পাঠাই। কাঁকন নির্লিপ্ত। কোন উত্তর আসে না।
বিছানায় শুয়ে পড়লে মনে হয় অনেকটা অংশ ফাঁকা পড়ে আছে। প্রবল গরমেও কাথা মুড়ি দিয়ে চোখমুখ অন্ধকার করে দুঃখবিলাসী হবার ব্যর্থ চেষ্টা করি। একটা সময় আবিষ্কার করলাম, আমি লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিংবা কবি জীবনানন্দের মত জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
শেষবার আমার সমস্ত আবেগ ঢেলে আমি তাকে অতি নিম্নমানের হাস্যকর গদ্য কবিতা পাঠাই।
দু’মিনিটের জীবন দিবে?
একটি সেকেন্ড বেশি বাঁচলে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিও
কিংবা গুলিবিদ্ধ করিও পাঁজরে
যেখানটায় তুমি আছো আদরে।

 

গল্প বা কাব্যের প্রেমের সোনালি অতীত কাঁকনকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হল। একদিন, এক সপ্তাহ থেকে মাস বছর পেরিয়ে গেল। আজিমপুর মোড়ের চিরসবুজ বৃক্ষগুলোও কয়েক বসন্ত পত্র ঝরিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল,
‘লেখক শোকাগ্রস্থ হও, কবি কেঁদে সুখী হও।’
কাঁকন কলেজজীবন শেষ করে হারিয়ে গেল পঁচিশ ভাগ মাটি আর পচাত্তর ভাগ জলের পৃথিবীতে। আক্ষরিক অর্থেই আমি তার গ্রামের বাড়ি থেকে শুরু করে সারা শহরের প্রতিটা অফিসেই বারংবার খোঁজ করলাম।
বছর পেরোতে লাগল।
কারণে অকারণে এক ব্যর্থ প্রেমিককে দেখা গেল ইডেনের জানালার নিচে। তার দৃষ্টি সবটা জুড়ে পাঁচশ পাঁচ নম্বর রুমের জানালা। মাঝেমাঝে সে জানালাকে আলাদা করে চিনতে পারে না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। গালের মাংশপেশীরা অনুভব করে সূক্ষ্ম জলের ধারা।
পরিশিষ্ট ১
আমস্টারডামের শহরতলীতে ব্লিজার্ড হচ্ছে।
কাঁচঘেরা ঘরের ভেতর থেকে এক চমৎকার রূপবতীর দুই চোখ তাকিয়ে আছে বাইরে। আঙ্গিনায় তুষার জমে আছে এক হাঁটু। হাঁটুভর্তি তুষারের উপর ব্লিজার্ড উপেক্ষা করে দুটো পরীর মত মেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদের পেছনে তাদের বাবাও ছুটছে। ঝড়ের ভেতর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
‘প্লিজ বেবী, কাম টু হোম।’
নিজ সন্তানদের উল্লাস কিংবা স্বামীর কণ্ঠস্বর রুপবতীর কানে পৌছাচ্ছে না। বিষণ্ণ মন নিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

 

পরিশিষ্ট ২
রিয়াদ নামক ত্রিশোর্ধ যুবক আজিমপুর মোড়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি জানালার দিকে। দীর্ঘ ছয় বসন্ত হল, তার প্রিয় জায়গাটির টান সে ভুলতে পারছে না।
তার হাতের ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রীনে বিদঘুটে একটি ডিজিট। কলার আইডি বলছে, নেদারল্যান্ডস।
‘কে বলছেন?’
কলদাতা বিষণ্ণ গলায় বলল,
‘কেমন আছো রিয়াদ?’
রিয়াদ হতভম্ভের মত বলল,
‘ভালো আছি কাঁকন।’
‘কী করছ?’
‘তেমন কিছু না। সাপ্তাহিক ছুটি। সেই পুরোনো জায়গাতে এসেছি।’
‘কোন পুরোনো জায়গা?’
‘তোমার জানালায়।’
‘আমি তো নেই। এসে লাভ?’
‘লাভ নেই। এমনিতেই এসেছি।’
‘প্রায় আসো?’
‘আগে প্রতিদিন আসতাম। এখন আসি না। শুধু শুক্রবার করে। হাসপাতালে অনেক কাজ।’
‘কতক্ষণ থাকো?’
‘যখন পাঁচশ পাচের লাইট বন্ধ হয়ে যায়, তখন উঠে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই।’
কাঁকন কথা থামিয়ে দিল। তার প্রশ্ন করবার ব্যাপারটি হুট করে থেমে যাবার পেছনের কারণ স্পষ্ট নয়।
রিয়াদ বোকার মত বলল,
‘কাঁকন।’
‘হু।’
‘কিছু জানতে চাও?’
‘না।’
‘প্লুটোকে কেন গ্রহতালিকা থেকে বামন বলে ছুড়ে ফেলা হয়েছে জানতে চাও?’
‘না।’
‘সুর্যের জ্বালানীর হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পারস্পারিক রুপান্তর সম্পর্কে জানতে চাও?’
‘না।’
‘মঙ্গলের মাটি কেন লাল জানতে চাও?’
‘না।’
‘জানতে চাও মঙ্গলের দুটো উপগ্রহের কথা?’
‘না। আমি কিচ্ছু জানতে চাই না।’
‘জানতে চাও কোন স্ত্রী প্রাণি যৌন সঙ্গমের পর তার পুরুষ সঙ্গীর মাথা কামড়ে খেয়ে ফেলে?’
‘না।’
‘অস্বচ্ছ বালি থেকে কীভাবে স্বচ্ছ কাচ তৈরি হয় জানতে চাও?’
‘না।’
‘সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলো কীভাবে তৈরি হল, জানতে চাও?’
‘না।’
‘কিছু তো কিছু জানতে চাও। চর্যাপদের কোন রোমান্টিক শ্লোক জানতে চাও?’
‘না।’
‘কীভাবে হাইহিল আসল জানতে চাও?’
‘না।’
‘লিপস্টিকের ব্যাবহার কীভাবে আসল জানতে চাও?’
‘না।’
‘সুরমা এবং সিঁদুরের বেসিক পার্থক্য বলব?’
‘না।’
‘ঐ গল্পটা শুনতে চাও?’
‘কোনটা?’
‘এক খেঁকশিয়াল আর এক বাঘিনীর গল্প? খেকশিয়াল বাঘিনীকে বিয়ে করবে...’
কাঁকন হেসে ফেলল।
‘জানতে চাই।’
রিয়াদ ফিসফিস করে বলল,
‘গল্পটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি কাঁকন। সম্পূর্ণ হলেই বলব।’
কাঁকনহাসছে। হাসিতে বিষণ্ণতা।
পরিশিষ্টঃ ৩
মহাকাশের এককোটি নক্ষত্রপুঞ্জের ওপাশ থেকে মহাশক্তিধর পুরো ব্যাপারটি খেয়াল করলেন। তিনি একবার ভাবলেন, আমস্টারডাম থেকে উড়িয়ে মেয়েটিকে বাংলাদেশে আনবেন। আজন্ম অপেক্ষারত বোকা যুবকটির সাথে মিলিয়ে দিবেন। তাদের দু’জনের মিলনের হাসি কতটা আনন্দময় হয়, তা জানার জন্য তিনি এক ধরণের সুক্ষ্ম কৌতুহল বোধ করছেন।
কিন্তু আমস্টারডামের ব্লিজার্ডে দুটো পরীর মত বাচ্চা মেয়ের হাসি আর তাদের পেছনে ছুটে চলা কণ্যাদের শঙ্কিত পিতার আনন্দময় জীবনকে ধ্বংস করবার মত নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারছেন না।
@

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়