Ameen Qudir

Published:
2019-09-19 21:39:39 BdST

পড়তে বসলেই বমি আসে



ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
________________________

এক.
বাবু'র সমস্যা একটিই। পড়তে বসলে কেবল তার বমির ভাব হয়। শুধু ভাব নয় রীতিমতো খাবার দাবার নাড়ীভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসার জোগাড়। আর এ সমস্যার জন্যে আপাতত তার পড়াশোনা বন্ধ রেখেছেন তার মা বাবা। এটাই স্বাভাবিক। সন্তানের পেট উগলে বমি আসছে এমন বেদনাদায়ক দৃশ্য যেকোন মা বাবার কাছে অসহনীয়। আগে'তো কলিজার টুকরো বাঁচবে, তারপর না পড়াশোনা।বাবু'র বয়স ন'বছর হলো, ক্লাস ফোরে উঠেছে। তার এরকম কোন সমস্যা পুর্বে ছিলো না। গত তিনমাস যাবৎ শুরু। বমির সমস্যার জন্যে গত তিনমাস যাবৎ অনেক চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র উপশম হয়নি।পড়াশোনা না পারা, স্কুলের ভয়, স্কুলে শাসনের ভয় বা কঠিন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে বসা ইত্যাদিতে অনেক সময় শিশু,কিশোর কিশোরীদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, হাতে পায়ে ব্যথা, ঘুম পাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু পড়তে বসলে নাড়িভুঁড়ি উগলে বমি আসা নিতান্তই দূর্লভ । বাংলা, ইংরেজি, আরবি, পাঠ্যবই বস গল্পের বই, যাই নিয়েই বাবু পড়তে বসে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বমি শুরু হয়। অথচ সে স্কুলের ফার্স্ট বয়।প্রথম সাক্ষাতে তাকে একটা এন্টি ইমেটিক, এনথেলমিন্থিক, ও এন্টি এনজাইটি দিয়ে তার বমির বিষয়টি ভিডিও করে আনতে বলা হলো।কিছু কিছু কেইস আমরা ভিডিও করে আনতে বলি, এটা আমাদের স্যারদের কাছ থেকে শিখা। বিশেষ করে নিউরোলজিকাল মৃগী রোগ, কনভারসন ডিসওর্ডার বা ম্যালিংগারিং এ জাতীয় কিছু মনোরোগ রোগ।

দুই

দ্বিতীয় সাক্ষাতে তারা আসলেন। বাবুর সমস্যার কোন উপশম হয়নি। কয়েকটি ভিডিও তারা দেখালেন, যা বাবুর অগোচরে তোলা। সে গুলোতে স্পষ্ট, বাবু পড়েতে বসছে, মিনিট পাঁচেক পরেই বমি আর বমি।বমি আসার বিষয়টি এবার চাক্ষুষ দেখতে চাইলাম।বাবুকে কয়েকটি গল্পের বই, বাংলা, ইংরেজি ও আরবি সব দিয়ে চেম্বারের পাশে এক এক টেবিলে পড়তে দেয়া হলো। বমি আসলে যাতে বমি করতে পারে সে ব্যবস্থাও নেয়া হলো। বাবু'র মা বাবাকে বলা হলো, পুরো বিষয়টি ভিডিও করা হবে । তাদের কোন আপত্তি আছে কিনা এতে? তারা সানন্দে রাজী হলেন।বাবু'কে চেম্বারেই টুকটাক কাউনসেলিং এবং অন্যমনস্ক করে টেবিলে পড়তে বসানো হলো, এবং সিস্টার কে ভিডিও করতে বলা হলো।এদিকে বাবুর মা বাবার সাথে আলাপের মাধ্যমে তার রোগের অতীত ইতিহাস নেয়া চললো।

 

তিন.পরপর দুবার দশ মিনিটের ভিডিও করা হলো। এর মধ্যে দেখা গেলো বাবু পর পর তিনবার উঠে গিয়ে বমি করলো। ভানবনিতা নয়। সত্যিকার অর্থেই বমি। গল গল করে। এতে ছেলেটি কিছুটা কাহিল হয়ে পড়েছিলো।বাবু'র মা বাবার কাছ থেকে তার বার্থ হিস্ট্রি, ডেভেলপমেন্ট হিস্ট্রি, বন্ধুবান্ধব ও স্কুলিং হিস্ট্রি নেয়া সম্পন্ন হলো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বেরিয়ে এলো।বাবু ছিলো প্রি ম্যাচুউর বেবী। জন্মের পর দেখা দেয় এক সমস্যা। বুকের দুধ খেলেই সদ্য জন্ম নেয়া বাবু বমি করছে। তিন দিন একই অবস্থা, কোন উন্নতি নেই। এদিকে ধীরে ধীরে বাবুর পেট ফুলতে থাকে। বাবুর মা' বাবা খেয়াল করলেন তার পায়খানা হচ্ছেনা, এমন কি পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোন বাতাস ও যাচ্ছেনা।বাবুর পেট ফুলার কমতি নেই, পেট ফুলতে ফুলতে শ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। তাৎক্ষণিক সদ্যভূমিষ্ট বাবুর অপারেশন এর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।তিন দিনের মাথায় কলোস্টমি অপারেশন হলো। পেট দিয়ে নলের মাধ্যমে তার পায়খানা করানোর ব্যবস্থাও হলো। তিন মাস পর আবার পায়খানার রাস্তা ঠিক করে দেয়া হলো বাবুর। শিশুসার্জন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ গুলো করলেন।দু'বছর পর বাবুর আবার একই সমস্যা। আবার হঠাৎ করেই পায়খানা বন্ধ এবং সেই সাথে পেট ফুলে যাওয়া।আবার সেই সার্জনের শরণাপন্ন হলেন তারা। বাবুর পুনরায় কলোস্টমি করা হলো। আবার তিনমাস নল দিয়ে পায়খানা। তিনমাস পর পায়খানার রাস্তা পুনরায় জোড়া দেয়া হলো।তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ছ'সাত বছর হয়েছে বাবুর টুকটাক সর্দি-জ্বর ছাড়া আর কোন সমস্যাই হয়নি।পড়াশোনায় বাবু বরাবর খুবই ভালো। ক্লাস থ্রী পর্যন্ত রোল এক। খেলাধুলাতেও এগিয়ে। ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা হলেও কাছে ডেকে আদর করে জানতে চাইলাম, 'বাবু, বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও'। সে বললো 'ডাক্তার'। জিগ্যেস করলাম, 'প্রিয় খেলা ক্রিকেট, ক্রিকেটার হবা, ডাক্তার কেনো?'বাবু বললো, পড়তে বসলে বমি আসে। বার বার বমি করতে যেয়ে তার খুব কষ্ট হয়। নাড়ীভুঁড়ি সব বের হয়ে আসতে চায় প্রতিবার। ডাক্তাররা কেউই এটা ভালো করতে পারছেন না। তাই সে নিজের ডাক্তার হয়ে নিজের চিকিৎসা করবে।
আমি একটা কলম গিফট করে বললাম, 'মাশাআল্লাহ, অবশ্যই তুমি ভালো হয়ে যাবা, এবং ডাক্তার ও হবা ভবিষ্যতে ' ।

চার.

বাবুর এ সমস্যা নিয়ে বাবুর মা বাবা ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। তাদের ধারনা সম্ভবত আবারও বাবুর বড় কোন অপারেশন লাগবে। কিন্তু সার্জারী বিভাগ থেকে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করে বলে দেয়া হয়েছে সার্জিক্যাল কোন কেইস নয়। অন্যান্য ডাক্তারাও চেষ্টা করেছেন বার বার, লাভ হয়নি। হুজুর, কবিরাজ ও দেখিয়ে নিয়েছেন এর মধ্যে।শিশু বিশেষজ্ঞরা এবার বলছেন সাইকিয়াট্রি দেখাতে।বাবুর কি তবে কোন মানসিক সমস্যা? জেনারেল এনজাইটি বা কনভারসন ডিসওর্ডার জাতীয় কিছু?
_______________________

ডা. সাঈদ এনাম

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়