Ameen Qudir

Published:
2019-08-04 07:00:47 BdST

সঙ্ঘবদ্ধভাবে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা : নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা


 


ডা. ফাতেমা জোহরা
__________________________________

দেশের বিভিন্নস্থানে ছেলেধরা আতঙ্কের জের ধরে গণপিটুনিতে অনেকেই নিহত হয়েছে।মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে ২০১১ সাল থেকে পরবর্তী আট বছরে দেশে প্রায় আটশ মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। এ বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন।

গণপিটুনি এবং সামাজিক সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম দায়ী।ভিকটিম পরিবারগুলো থেকে কেউ এগিয়ে না আসার কারণেও ঘটনার পর বিষয়গুলোর দিকে খুব বেশিদিন কারও নজর থাকেনা।এর প্রবণতা খুব বেশি হারে বাড়ছে। কারণ এসব ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষে কেউ শক্ত ভাবে দাঁড়ায়না। অপরাধীদের সনাক্ত করার ক্ষেত্রে যদি সরকার দৃঢ় হতো তাহলে এমন পরিস্থিতি হতোনা। সংঘবদ্ধ হয়ে করলে কোনো শাস্তি হয়না এমন ধারণাও অনেকের মনে আছে এবং সে কারণে তারা এর সুযোগ নেয়।
এটা যে অপরাধ। সেই বোধটাই কথিত মানুষদের মাথায় আসেনা। বিচার না হওয়ার কারণেই এমন ধারণা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।সুনির্দিষ্ট আইন আছে কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ হয়না বলেই একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।এ কারণেই মানুষেরও আস্থা নেই।আইনের প্রয়োগের উদাহরণ তৈরি না হওয়ায় এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা না থাকায় সাধারণ মানুষ একত্রিতভাবে এধরণের অপরাধ করতে ভয় পায় না।

সুযোগ পেলেই মানুষের ভেতরের আদিম পশুপ্রবৃত্তি বেরিয়ে আসতে চায়। ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন মানুষের মধ্যে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তখন তার ভিতর ঐ পশুপ্রবৃত্তিটি কাজ করে।আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অনাস্থার বিষয়টি একেবারেই নতুন নয়।এরকম মানুষ ছোটখাটো অপরাধ সংঘটন করে পার পেয়ে যাওয়াকে অধিকাংশ সময়ই গৌরবের বিষয় বলে মনে করে।

পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সহায়তার বদলে হয়রানি করারও অসংখ্য অভিযোগ আছে।সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারব্যবস্থার ওপর অনাস্থার কারণে সাধারণ মানুষ শুধু যে নিজেরা বিচারে উদ্যোগী হচ্ছে তাই নয়, অপরাধ সংঘটন করেও পার পেয়ে যাচ্ছে কারণ তারা জানে যে এরকম ঘটনায় তাদের বিচার করা কতটা কঠিন।

যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যেমন এলাকার মেম্বার, কাউন্সিলর, এবং স্থানীয় সরকার ও এমপিরা যদি এলাকায় জন সচেতনতামূলক কথা বলেন যে, এগুলো গুজব এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া অপরাধ এবং তারা আইনের আওতায় আসবে। তাহলে মানুষ ভয় পাবে এ ধরণের কিছুতে জড়ানোর আগে।মানুষ যাতে এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় সেজন্য জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিভিসিসহ নানা ভাবে প্রচারণা চালানো শুরু হয়েছে এবং আরো ব্যাপকতর করা হচ্ছে।ইতিমধ্যেই সব জেলায় জেলায় প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচার চালানো হয়েছে।

সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, চোর ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলে দন্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বে বাধা দেয়ার মতো কোনো অধিকার নেই। বরং এমন কোনো ব্যক্তিকে যদি আটকে রাখা হয় এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া হয় তবে দন্ডবিধির ১৮৬ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ টাকা জরিমানা বা দুই ধরনের দন্ডেই দন্ডিত হতে পারে।

আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে পিটুনি বা ধোলাই দেয়া হয় তবে কারাদন্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা তো থাকছেই। আঘাত করতে গিয়ে যদি গুরুতর আঘাত দেয়া হয় তবে ৩৩৪ ধারা দন্ডবিধি অনুযায়ী কারাদন্ডের মেয়াদ বাড়বে আরও এক বছর। আর অর্থদন্ড হবে অনূর্ধ্ব ২ হাজার টাকা। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয় দন্ডেও দন্ডিত হতে পারেন। (দন্ডবিধি, ৩৩৫ ধারা)।

গণপিটুনিতে যদি ওই ব্যক্তি নিহত হয় তবে তার দায় বর্তাবে অপরাধ সংঘটনকারী সব ব্যক্তির ওপর। কেননা আইনে 'যৌথ দায়িত্বশীলতা' বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। তাই গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে, সবাইকে সমভাবে এজন্য দায়ী করা যাবে। [৩৪ ধারা দন্ডবিধি]

কাজেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় জড়িত জনতার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলে সবারই নূ্যনতম দন্ড হওয়ার কথা 'যাবজ্জীবন কারাদন্ড'। কিন্তু এসবের প্রয়োগ না থাকায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।

তবে এসব বিষয়ে ভয় বা আতংকিত না হয়ে সঠিক তথ্য জানা উচিত।প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
________________________________

ডা. ফাতেমা জোহরা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়