Ameen Qudir

Published:
2019-08-02 21:32:25 BdST

ডেংগু কর্নার ও আমার ডেংগু অভিজ্ঞতা


 

 

ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম

______________________________

ডেঙ্গু” শব্দটি পূর্ব আফ্রিকার সোয়াহিলি জাতির মুখের ভাষা। তারা জ্বর হলে বলতো 'কা ডিংগা পেপো' যার অর্থ 'দুষ্ট আত্মায় সৃষ্ট রোগ'। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কতিপয় ক্রীতদাস ডেংগু ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তীব্র ব্যথায় কুকড়ে, ডাংডি নৌকার মতো চলা ফেরা করতো বলে তখন একে 'ডাংডি জ্বর' বলা হতো। সেই 'কা ডিংগা পেপো' বা 'ডাংডি জ্বর' এখন কালক্রমে 'ডেংগু জ্বর' বলে বিশ্বে পরিচিত।

এই ডেংগু জ্বর সম্পর্কে আমি প্রথম জানি ঢাকা মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে থাকতে। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডেংগুর প্রাদুর্ভাব । পত্রিকায় ডেংগু জ্বর এবং এ রোগে চোখ লাল হয়ে যাওয়া রোগীর ছবিতে সয়লাভ দৈনিক গুলোর প্রথম পাতা। অনেকের গা'য়ে তখন ঘামাচির মতো র‍্যাশ এর ও ছবি।

পরবর্তীতে ডেংগু জ্বর এর সাথে পরিচিত হই ২০০২ সালে। আবারও ঢাকা শহরে ডেংগু ভয়াবহ আকারে। আমি তখন মেডিসিনে ইন্টার্নিশিপ করছি। রাতারাতি ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ড গুলোতে ডেংগু কর্নার খোলা হয়। আমি অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ স্যারের অধীন ৩ নাম্বার ওয়ার্ডে ডাক্তার দের রোস্টার অনুযায়ী ডেংগু কর্নারের প্রথম 'বেড ডক্টর'।

এডমিশনে ওয়ার্ড মানে সারাদিন-রাত রোগী ভর্তি। মিনিটে মিনিটে রোগী। রোগী মানে সারাদেশ আর পেরিফেরির সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেফার্ডকৃত মারাত্মক খারাপ সব রোগী।

আমরা দল বেধে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে রোগী রিসিভ করা, হিস্ট্রি লেখা, ইনভেস্টিগেশন প্রোফাইল তৈরী করা এই কাজ গুলো করতে থাকতাম। সাথে গাইড হিসেবে সি এ (ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট) স্যার, রেজিস্ট্রার স্যার আর প্রফেসর সারেরা থাকতেন। আমরা কেউ কেউ ওয়ার্ডেই থাকতাম, সি এ স্যারের রুমে।

পোস্ট এডমিশন রাউন্ড মানে ঐতিহাসিক ব্যাপার স্যাপার। খাতা কলম নিয়ে চার পাঁচ ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বেড বাই বেড সদ্য ভর্তিকৃত নতুন রোগীদের লক্ষন, যাবতীয় হিস্ট্রি, রিপোর্ট, আনুষাঙ্গিক সকল বিষয় ক্রমান্বয়ে মূখস্ত বলতে হতে। তোতলালেই যত সমস্যা। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম সবাই।

একবার পোস্ট এডমিশন রাতে তিনটার দিকে পেরিফেরির মেডিকেল থেকে রেফার্ড হয়ে এলো এক রোগী। জ্বর, রক্ত বমি। প্রতিবার বমিতে রক্তে সয়লাভ। আরজেন্ট সিবিসি করানো হলো। প্লাটেলেট কাউন্ট দশ হাজার। রোগী শক-এ। রাত তিনটায় 'ইন্টার্ন ব্লাড গ্রুপ ম্যানেজ পার্টি' দৌড়াদৌড়ি করে সব কিছুর ব্যবস্থা করলো। আশ্চর্য রোগী টা ভালো হয়ে গেলো ক'দিনের চিকিৎসায়।

রোগীর আত্মীয়স্বজন যারপরনাই খুশি। ডিসচার্জের বেয়া রোগীর আত্মীয়রা আমাদের কাছে টেনে- হাতে, কপালে, চিবুকে স্পর্শ করে অশ্রুসজল আশির্বাদ, "বাবা'রা, মায়ে' রা আপনাদের ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবোনা, দিন রাত আপনারা যা করলেন..."

আমাদের ডেংগু কর্নারে ভর্তি হওয়া সেদিনের ডেংগু রগীর রোগীর এক জনই মারা যাননি। প্রিকোশন নেয়াতে আমাদের কারোই তখন আর ডেংগু ছড়ায়নি।

ডেংগু কিভাবে ছড়ায়?

ডেংগু বিশেষ মশা বাহিত এবং বিশেষ ভাইরাস গঠিত রোগ। ডেংগু আক্রান্ত রোগী কে স্ত্রী এডিস মশা কামড় দিয়ে, চার পাঁচ দিন পর তা সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তবেই তার দেহে ডেংগু ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ডেংগু জ্বর হবে। সুতরাং ডেংগু ছড়াতে হলে ডেংগু রোগী ও স্ত্রী-এডিস মশা একসাথে থাকতে হবে। শুধু ডেংগু, শুধু স্ত্রী এডিস মশা থাকলে লাভ হবেনা।

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ডেংগু ছড়াতে গেলে ডেংগু প্রাদুর্ভাব অঞ্চল থেকে আক্রান্ত রোগী সাথে বাস, ট্রাক, লঞ্চ, ষ্টীমার, ট্রেন ও প্লেন যাই আসুক সে বাহনে স্ত্রী-এডিস মশা কেও আসতে হবে। সুতরাং বাহন কে মশামুক্ত রাখা জরুরী। স্ত্রী-এডিস মশা দিনে কামড়ায় আর বাস ও বংশ বিস্তার করে ঘরে জমে থাকা তিন চারদিনের জমে থাকা ছোট পাত্রের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে।

ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম
ডিএমসি,কে-৫২।

সাইকিয়াট্রিস্ট

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়