Ameen Qudir

Published:
2019-06-23 20:50:29 BdST

এখনও সুযোগ পেলে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে অন্য যে কোনো পেশায় যোগ দিতে চাই




ডা. নাজিয়া সুলতানা
___________________________

এখনো সুযোগ পেলে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে অন্য যেকোনো পেশায় যোগ দিতে চাই৷

অনেকের কাছেই এই কথাটা কিছুটা ঠাট্টার মতো শোনায়৷ অনেকে বলে বসেন পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন এই কথা বলছেন, মজা করেন তাইনা? কিন্তু এ আমার মনের একান্ত গহীনের কথা৷ জীবনে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে যৌবনকাল ব্যয় করে বহু আত্বত্যাগের পরে অর্জিত এই অবস্থানে আজ আমি সত্যি সুখী নই৷ আর এটাই চড়ম বাস্তব সত্য৷

আমি আসলেই এখন ভূলে যেতে চাই যে আমি একজন চিকিৎসক, কখনো মানব সেবার ব্রত নিয়েছিলাম শিশু ও কিশোর বয়সে৷ সম্ভব হলে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে স্মৃতিগুলোও মুছে ফেলতে চাই মস্তিস্ক থেকে৷

ছোট বেলায় খেলাধুলার সময়গুলো কাটছাট করে পড়ায় টেবিলে বেশি কাটাতে হয়েছে কারণ বাবা বলতেন, মা তুই বড় হয়ে ডাক্তার হবি, মানুষের সেবা করবি আর এজন্য তোকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে নইলে কোনো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবিনা৷ বাবা মায়ের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন বানিয়ে লালন করতে লাগলাম সেই থেকেই৷

আমার বাবা মায়ের এতো টাকা ছিলনা যে তারা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াবেন৷ তাই আমার মনের উপর চাপটাও ছিল দ্বিগুণ৷ একদিকে বাবা মায়ের স্বপ্ন পুরণের টেনশন অন্যদিকে সরকারী মেডিকেলে ভর্তি সুযোগ অর্জনের টেনশন৷
কত উৎসব পার্বন গেছে অন্যদের আনন্দ করতে দেখেছি কিন্তু আনন্দ করতে পারিনি অথবা আনন্দ করতে যদি গিয়েছিও ভেতর থেকে সংকোচবোধ তাড়া করেছে কারণ পরদিন হয়ত কোনো পরিক্ষা অথবা সামনেই মেট্রিক/ইন্টার পরিক্ষা৷ রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেলে বাবা মাও কষ্ট পাবে, তাদের স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যাবে৷

সব ডাক্তারকে একযোগে খারাপ বললে আমি যেমন মানতে পারবনা কখনোই, আবার সব ডাক্তারকে সাধু বলতেও আমার বাধে৷ আমার নিজের ডাক্তার হবার পেছনে যে এক ডাক্তারেরই অনবদ্য অবদান রয়েছে৷

আমার খুব ছোটবেলায় আমার মরহুম বাবা একবার এক সরকারী হাসপাতালে রক্ত বমি নিয়ে ভর্তি হোন, তার রোগের তেমন কোনো কারণ তখন খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা৷ চিকিৎসার এক পর্যায়ে তার কনসালটেন্ট তাকে বললেন, উনার কাছে একটা দামী অসুধ আছে যেটা দিলে ভালো হয়ে যাবেন এবং সেটার জন্য মোটামুটি ভালো একটা অংকের টাকা দাবি করেন৷ ছোট ছিলাম তাই ভালো বুঝতে পারিনি৷ তবে আমার আদর্শবান পিতা মনে অনেক বড় আঘাত পান ডাক্তারের ব্যাবহারে ও কার্যকলাপে এইটুকুই মনে আছে৷

তখন তিনি ঠিক করেন তার বড় সন্তানকে তিনি ডাক্তার বানাবেন যেন তার সন্তান ওই সব ডাক্তারদের বদনাম ঘুচাতে পারে৷

মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সময়ে নানা রকম বৈরি পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, সে ইতিহাস এখন আর নাই বা বললাম, আর তাছাড়া এ ইতিহাস সব মেয়েদেরই জানা আর যারা মেয়েদেরকে মেয়েমানুষ নয়, মানুষ মনে করেন তাদেরও বোধকরি জানা৷ একটা মেয়েকে কতো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন গঠন করতে হয় ও ধরে রাখতে হয় তা কেবল মেয়েরাই জানে৷ আর একটা ডাক্তার মেয়েকে সামনে আগাতে হলে যে পুলসিরাত পাড়ি দিতে হয়, তা কেবলমাত্র ডাক্তার মেয়েটা ও তার পরিবার জানে৷ কত শত মেডিকেলের ভালো ছাত্রী পরবর্তীতে পেশা ছেড়ে গৃগিনী হয়েছেন শুধুমাত্র পারিবারিক ও সামাজিক সাপোর্টের অভাবে৷ কত কত ভালো ছাত্রীরা পরবর্তীতে বেসিক সাব্জেক্ট বেছে নিয়ে শিক্ষকতার পেশায় চলে গিয়েছেন৷
ক্লিনিক্যাল পেশায় থাকা মানে নিজের সাথে সারাক্ষণ সমঝোতা, সাথে মিশ্রিত হয় হতাশা আর মনোকষ্ট৷ এই নিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাওয়া৷ আবার সব বাধা ও সমস্যা যেন মানুষের সেবায় প্রভাব না ফেলে সেক্ষেত্রেও সজাগ দৃষ্টি রাখা৷ এ যেন ভেতরে তিলে তিলে ক্ষয় হয়েও টিকে থাকা৷

জীবনের কঠিন সংগ্রামের দিন গুলিতেও আব্বুর ইচ্ছাটা আর স্বপ্নটা সবসময় লালন করে গিয়েছি তাই হয়ত মাঝে মাঝে থেমে গিয়েও একসময় আবার নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি৷ সংসারে তেমন সময়ই দিতে পারিনি৷ সন্তানদের ভালো যত্ন নিয়ে পারিনি৷ নিজের হাতের রান্না করে বরকে খাওয়াতে পারিনি৷ অসুস্থ বাবা কে ঘন ঘন দেখতে যেতে পারিনি৷
কারণ একটাই দায়িত্বপূর্ণ একটা পেশা ও চাকুরী৷ চাইলেই ছুটি নেয়া যায়না৷ আর এই পেশায় কেউ চাইলেই কাউকে যখন তখন ছুটি দিতেও পারেনা৷ এ এমনি এক পেশা যেখানে না চাইলেও নিজের সবকিছু ভূলে যেতেই হয়, বিলীন হতেই হয়৷

এমনি কতশত অপূর্ণতা আর অতৃপ্তির মাঝেও একজন ডাক্তার তখনি শান্তি খুজে পায় যখন তার কোনো রোগী হাসিমুখে বলে "আপা, আজকে আমি অনেক ভালো আছি" অথবা যখন কোনো রোগী সুস্থ হয়ে যাবার সময় ধন্যবাদ দেয় অথবা ফলোয়াপে এসে প্রথমেই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেন, "ম্যাডাম, আপনি কেমন আছেন?" তখন কিছুক্ষণ আগেই অসহায় অবস্থায় ফেলে আসা বাচ্চাদের মুখটাও ঝাপসা হয়ে আসে৷ মন তৃপ্তিতে ভরে যায়৷ আলহামদুলিল্লাহ!!

বিগত কয়েক বছরে মানুষের ডাক্তারদের প্রতি মনোভাব দেখে মনটা পুরোপুরি ভেংগে গেছে৷ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যাচাই বাছাই না করেই যেভাবে সমষ্ঠিগতভাবে ডাক্তারদের আক্রমণ করা হচ্ছে, এটা দেখে আজ অন্যের উপরে নয়, নিজের উপরেই তীব্র রাগ হচ্ছে৷ কেন আজ এতো কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে এই পেশায় আসলাম? এই প্রশ্নটা তাড়া করছে প্রতিনিয়ত৷

বাবা তুমি ওপারে থেকে দেখছ কিনা জানিনা, আমি সত্যি আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি চলতে চলতে৷ যাদের সেবার মাধ্যমে আত্নতৃপ্তি খুজে নিতাম যাদের নিয়ে সব কষ্ট ভূলে থাকতে পারতাম তারাই আজ ভূল বুঝছে, না না অপবাদ দিচ্ছে৷ আজকের এই পরিস্থিতি দেখলে তুমি নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার ভাবতে, মেয়েকে এই অনিশ্চয়তা আর অতৃপ্তির মাঝে ফেলবে কিনা৷

তাই এখন নতুন করে ভাবছি পেশা বদল করে ফেলব৷ ভূলে যেতে চাই আমি একজন ডাক্তার এমনকি কখনো ছিলাম৷ সম্ভব হলে পিছনে ফিরে গিয়ে মেডিকেল ভর্তি বাতিল করে অন্য যেকোনো বিষয়ে ভর্তি হতে চাই৷ পরিবারকে হারানো সময়গুলো সব ফিরিয়ে দিতে চাই, অসুস্থ বাবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে চাই, তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে চাই, তার মৃত্যু শয্যায় পাশে বসে দোয়া পড়তে চাই৷

আমি আবার নতুন করে সব শুরু করতে চাই৷
_____________________________

Dr. Nazia Sultana
Consultant (Obs & Gynae)
Sajida Hospital
Narayanganj.

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়