Ameen Qudir

Published:
2019-06-15 20:02:27 BdST

"ডাক্তারদের প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জি আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলে গেলেন"


 

ডা. রেজাউল করীম


_______________________

মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। ডাক্তারদের প্রসঙ্গে দেখলাম আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলে গেলেন। তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলা রুচিসম্মত নয়, কিন্তু অনেক ভেবেও কোন বিকল্প খুঁজে পেলাম না। তিনি বললেন, 230টি সন্ত্রাসের ঘটনা ঠিক নয়। অথচ, গত বছর তিনি নিজেই আমাদের বলেছিলেন, 2018 সালের এপ্রিল পর্যন্ত 195 টি ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর তথ্য তখনো সঠিক ছিল না, তখন পর্যন্ত 187 টি ঘটনা ঘটেছিল। তারপর ছোট ঘটনাগুলো বাদ দিলেও মোট 235 টি হামলার ঘটনায় এফ আই আর হয়েছে। বলা বাহুল্য, কেউ গ্রেপ্তার হন নি। এমনকি কুখ্যাত ডেবরার ঘটনায়ও কেউ গ্রেফতার হননি।
জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার প্রসঙ্গ তিনি তুলেছেন। ছাত্ররা নাকি কথা বলতে চায় নি। তিনিই এই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী, তাই তিনি কথা বলতে চেয়েছিলেন কিনা তিনিই বলতে পারেন। কিন্তু, আমরা তাঁর এই দাবিতে হতবাক। তখনো এই ছেলেমেয়েদের এত জেদ ছিল না, তখনো তিনি পিজিতে তাঁর ট্রেডমার্ক ভাষন দেননি, তখনো পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের তিনি সাম্প্রদায়িকতায় অভিযুক্ত করেননি। তাসটি তখনো মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই ছিল। হামলাকারীদের গ্রেফতার করলে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হতো। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে নিতেই পারতেন।

মুখ্যমন্ত্রী বললেনঃ আমি কোথায় যাবো কেউ বলে দিতে পারে না। এখানে "আমি" মানে কি ব্যক্তি মমতা? আমি হলেন মুখ্যমন্ত্রী, যিনি সরকারী নিয়ামক, যিনি সরকারের বেতনভূক, যিনি নানারকম সরকারী সুবিধাভোগী। জনগন হল আসল মানিক, তারা ডিকটেট না করলে কারা সরকারের বেতনভূক ব্যক্তিকে ডিকটেট করবে? সেদিন একটা সোশাল মিডিয়া পোস্টে দেখলাম, সীতারাম ইয়েচুরি ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগ দাবী করে ঘোষণাপত্র পড়ছেন, আর ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে স্বয়ং ইন্দিরা সেটি শুনছেন। একে বলে গনতন্ত্র, যিনি ভুল করলে স্বীকার করে নেন, যিনি কঠোর হাতে দমন করেন আবার তাঁর গাড়ী তুলে নিয়ে যাওয়া আই পি এস অফিসারকে চায়ের নেমতন্ন করেন। ভারতীয় গনতন্ত্রের এই সৌন্দর্য্য, যার জন্য সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছিল।

মুখ্যমন্ত্রী বলুন, কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো যদি তিনি পরিবহকে গিয়ে বলেন, "আমার আগে আসা উচিত ছিল, আসি নি। এখন এসেছি বাবা, তুই ভাল হয়ে ঔঠ"। কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে যদি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে কাল সকালে নীলরতনে হাজির হয়ে বলেন, "বলতো দেখি তোদের কি সমস্যা!" এক নিমেষে তো এই আন্দোলনের সমাপ্তি হবে। তিনি হারবেন না, তিনি জিতবেন, তারচেয়ে বেশি জিতবে ভারতীয় গনতন্ত্র। সন্তানের কাছে মায়ের পরাজয় কখনো পরাজয় বলে কেউ গণ্য করবেন না।

জানি, অতিরিক্ত বেশি কল্পনা করে ফেলেছি। এই ছোট্ট কাজটি করার জন্য যে বৃহৎ সাহসবিস্তৃত বক্ষপট দরকার, সে কখনো অনৃতভাষনে পটু হয় না। তাঁর হৃদয় ভালবাসায় পূর্ণ থাকে, অমূলক, অন্যায় অভিযোগ সেখানে স্থান পায় না। সে অনন্য রুচি ও চেতনা যে মনুষ্যত্বের জন্ম দেয় তিনি সব কিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাবেন না, তিনি সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি পরিচালিত হবেন না , ক্ষমতা তাকে দাম্ভিক করে না। তিনি পুরুর মত, কোন পরাজয়ের মালিন্য তাকে স্পর্শ করে না।

খুব সংক্ষেপে বলতে হয়, ডাক্তারদের ক্ষোভের কারন হল তাঁদের প্রাপ্য সম্মান তারা পান না। সরকার মানতে চায় না যে, যে পরিকাঠামো নিয়ে তাঁরা তৃপ্ত তা অপ্রতুল। এত অপ্রতুল যে, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বা তার প্রিয়জন, আত্মীয় বন্ধু অসুস্থ হলে সেখানে চিকিৎসা সম্ভব হয় না, তাঁদের নিয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে ছুটতে হয়। তিনি যে 28,000 বাড়তি শয্যার দাবী করছেন তার জন্য কমপক্ষে 9000 অতিরিক্ত নার্স লাগবে, প্রচুর ডাক্তার দরকার হবে। যে তালিকা মেনে ডাক্তার নিয়োগ হচ্ছে সে তো গত শতাব্দীর শেষভাগে তৈরী। সেদিনের নিরিখে আজকের চাহিদার হিসেব কিভাবে করছেন? তার জানা নেই বোধহয় ওই 28000 হল সমুদ্রে গোষ্পদ। এ রাজ্যে আরো কমপক্ষে এক লক্ষ আশি হাজার শয্যা দরকার।

এই পরিকাঠামো নেই তাই মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। মানুষ দরকারের সময় ডাক্তার পান না কিন্তু তার জন্য ডাক্তার দায়ী নয়। দায়ী অপ্রতুলতা, যার দায় সরকারের। আমরা কখনো এই দাবী করি নি যে, রাজ্য সরকার এই বিপুল শয্যার দায়িত্ব নিক। আমরা চেয়েছি, সরকার এই অপূর্ণ চাহিদার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জিডিপির আড়াই শতাংশ খরচের দাবী তুলুক। নিজের রাজ্যে শ্রীনাথ রেড্ডি রিপোর্ট চালু করার উদ্যোগ নিক। রাজ্য বাজেটের আয় ব্যয়ের হিসাব পড়লে সহজেই বোঝা যায় অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিকটু অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যয় সঙ্কোচ করলে রাজ্য জিডিপির আড়াই শতাংশ খরচ করা সম্ভব। রাজ্য গত বাজেটে স্বাস্থ্য শতকরা হিসেবে 0.1%কম বরাদ্দ করেছে, যদিও টাকার অঙ্কে বৃদ্ধি হয়েছে।

187 ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে চিকিৎসক প্রহৃত হয়েছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কারণ হল, দীর্ঘ্যক্ষন শয্যা না পেয়ে মারা যাওয়া বা অতিরিক্ত খরচে রোগীর সর্বস্ব যাওয়া।। দুটি ক্ষেত্রেই শ্রীনাথ রেড্ডি দিশা দেখিয়েছেন।
চিকিৎসকদের আরেকটি বড় ক্ষোভের কারণ হল, হামলার ঘটনাগুলিকে অস্বীকার করা বা তাকে ছোট করে দেখানো। মুখ্যমন্ত্রী তো দুবেলা তেরিয়া হয়ে হেডদিদিমনির মত একে তাকে বকে দিচ্ছেন।যে দুষ্টু ছেলেরা (কাল অবশ্য বখাটে বলেছেন) ডাক্তার ঠেঙাচ্ছে তাদের একটু বকে দিলে আর হামলার ঘটনায় কঠোর নিন্দা করলে ঠিক কি অসুবিধা হতো? তিনি তো বিবৃতি দেব বলেছিলে, দিলেন না কেন, তার উত্তর আছে? তিনি ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে কড়া বার্তা দিচ্ছেন, গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে কেন নয়, একটু জানাবেন?
মুখ্যমন্ত্রীর আচার ব্যবহারে কেমন যেন একটা আত্মগরিমা স্ফীত ঔদ্ধত্য ফুটে উঠছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তিনি কারো পরামর্শ নেবেন না, পাছে লোকে তাঁর সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়। এই ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স তাঁকে দিয়ে যা বলিয়ে নিচ্ছে অচিরেই তা তাঁকে আষ্টপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। নেমেসিস হাজির, শেষের সেদিন ঘনিয়ে আসছে।
২.
আমাকে একজন ফোন করে বললেন, আপনি WBDF ( ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম) কে ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে সিপিএম এর হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে আমাদের হতাশ করেছেন। আমি যদিও এই বিষয়ে বহুবার আলোচনা করেছি, তবু কিছু কথা পুনরাবৃত্তি করতে চাই।
চিকিৎসকদের আন্দোলনের সাথে আমার সম্পর্ক গত তিন দশক। বাম জমানায় ১৯৯৮ সালে যখন আমার বাড়ী আক্রান্ত হয়, তখন যেমন কাউকে পাশে পাই নি, তেমনি এই সেদিন দিদিমণির কল্যাণে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে যখন চাকুরিতে ইস্তফা দিই তখনো কাউকে পাশে পাই নি। তাই, ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে আমি সংগঠনকে জড়াই না। তাছাড়া জনসংখ্যার .002% র প্রতিনিধি ভোটে জিতবে এই আশা দুরাশা। পেশাগত সমস্যার স্বার্থপর দাবী নিয়ে আন্দোলন করে কখনো ভোটে জেতা সম্ভব নয়, বিশেষত চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তাঁর মূল কারণ নিহিত আছে পেশাগত দাবিদাওয়ার সীমাবদ্ধতায়। এ এমন এক পেশা যার সমস্যা বৃহত্তর সমাজ বুঝতে চায় না, বুঝলেও স্বীকার করতে চান না।অনেক সময় পরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষেরাই বুঝতে চান না, অন্যদের কথা বাদ দিলাম। যদি, সাধারন মানুষ চিকিৎসকের সমস্যা বুঝতেন তাহলে আজ হাজার হাজার ডাক্তারকে পথে এসে দাঁড়াতে হতো না। মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে হলে চিকিৎসক আন্দোলনের যে পথ পথ পাড়ি দিতে হয়, আমাদের দেশে সেই ধারার আন্দোলন হয় না।আমরা কেউ নর্মান বেথুন নই, নেহাত ছাপোষা মানুষ, যারা আক্রান্ত চিকিৎসকদের নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ করতে চেয়েছি।
প্রথম থেকেই আমাদের লক্ষ্য হল, ভায়োলেন্স মুক্ত চিকিৎসার পরিবেশ। আমরা বলেছিলাম, যে যার খুশি রাজনীতি করতে পারেন কিন্তু সন্ত্রাসের ঘটনা একসাথে প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা দুবছর ধরে একই কথা বলেছি, হাইকোর্টে একাধিক মামলা করেছি। সফল হতে পারি নি। পেশাগত ক্ষুদ্র পরিসরে আন্দোলন করে সফল হওয়া সম্ভব নয়, অথচ চিকিৎসকরা আরো বেশি বেশি করে আক্রান্ত হয়ে চলেছে। এই অবস্থায়, আমি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিই যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস নিয়ে বৃহত্তর জনসমাজের কাছে তুলে ধরবো। এক্ষেত্রে, নির্দল হিসেবে দাঁড়ানো যেত নিশ্চয়ই কিন্তু আপন মনে গুনগুন করা ছাড়া লাভ হতো না। একটা সংগঠনের মাধ্যমে না দাঁড়ালে সঙ্গতিহীন মানুষের নির্বাচনে দাঁড়ানো বাতুলতা।

আরেকটি বড় সমস্যা হল, যে প্রচার আমরা করতে চাই তা সংশ্লিষ্ট দল করতে দেবে কিনা। খুব স্বাভাবিক কারনে কোন রাজনৈতিক দলের ন্যারেটিভ আওড়ানো সম্ভব ছিল না। যে সব দলের প্রবল হাওয়া রাজ্য জুড়ে চলছিল সেখানে ব্যক্তির ক্ষুদ্র প্রয়াস বার্থ হতো। সংগঠিত রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সমস্যা অন্ততঃ একটি জেলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া গেছে। এটি করবো বলেই আমি 1300 কিমি পায়ে হেঁটেছি। কোন কিছু পাওয়ার আশায় করলে ঠিক উল্টো পথ নিতাম। সেটা এমন কিছু কঠিনও ছিল না।

এই ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই, নির্বাচনের বহু আগেই WBDF নেতৃত্ব যোগ্য লোকের হাতে সাংগঠনিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল।সেই নেতৃত্বের বেশির ভাগ আর যাই হোক বামপন্থী নয়, সিপিএম তো নয়ই।এখন, আমি আর পাঁচজন সমর্থকের মত সাধারন কর্মী। অসংখ্য চিকিৎসক যারা এই আন্দোলন করছেন, তাদের রাজনৈতিক মত আছে, আমার ও একটি রাজনৈতিক মত আছে সে মত প্রকাশ করতে দ্বিধা নেই কারন তা ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতি নয়। তা হল, সন্ত্রাস মুক্ত, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত অবাধ গনতন্ত্র- যা কোন মত জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে না। এ দেশের কোন দল সেই অবাধ গনতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও দলের যূপকাষ্ঠে বৃহত্তর উদ্দেশ্য বলি দেয়।

যাইহোক, এখন যে সাতটি সংগঠনের যুক্ত মঞ্চের মাধ্যমে এই আন্দোলন চলছে সেখানে সব রাজনৈতিক মতের চিকিৎসক সংগঠন আছে- হ্যাঁ, সিপিএম পন্থী, বিজেপি পন্থীদের মাঝে আছে এস এস ইউ র মতো সংগঠন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আছে WBDF. ব্যক্তির রাজনৈতিক মত সেখানে প্রতিফলনের সুযোগ নেই। তারচেয়ে বড় কথা চিকিৎসকদের দাবীটাই তো অরাজনৈতিক। চিকিৎসকদের সুরক্ষার দাবীতে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকবে তার বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে। আজ যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে তাহলে কি আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে? যতদিন উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে না উঠবে ততদিন সন্ত্রাস বন্ধ হবে হওয়া সম্ভব নয়। যদি পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের দাবী কখনো চিকিৎসকদের দাবী হয়ে ওঠে, তাহলে হয়তো WBDF র মতো সংগঠনের দরকার হবে না। সাধারণ মানুষ ই চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

যতদিন তা না হচ্ছে, এই সংগঠনের রাজনীতি নির্বিশেষে সব সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে।
_______________________________

 

ডা. রেজাউল করীম। শীর্ষ নেতা , ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম । কলামিস্ট। প্রখ্যাত পেশাজীবি নেতা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়