Ameen Qudir

Published:
2016-12-27 06:28:17 BdST

ভবিষ্যত চিকিৎসকদের মানসিক হাল : কল্পনাও করতে পারবে না কেউ


 

 

মারুফ রায়হান খান , ইন্টার্ন চিকিৎসক

 

________________________

সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেবেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কোর্সগুলোর একটা হচ্ছে এমবিবিএস কোর্স। এটা নতুন করে বলার কিছুই নেই, মেডিকেল সায়েন্সের স্টুডেন্টদের মধ্যে ডিপ্রেশানের হার প্রচুর প্রচুর বেশি। সারা পৃথিবীজুড়ে কমবেশি একই অবস্থা। ১৪% মেডিকেল শিক্ষার্থী মডারেট টু সিভিয়ার ডিপ্রেশানে ভোগেন, ৫% শিক্ষার্থীর আত্নহত্যার চিন্তা এসেছে তার মেডিকেল লাইফের কোনো না কোনো সময়। আমাদের এই বাংলাদেশের কী অবস্থা?

বিএসএমএমইউতে কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হওয়া একটা ওয়ার্কশপে ডা. তাসদিক হাসান দীপ তার একটা স্টাডি প্রেজেন্ট করেছিলেন। তিনি ২২১ জন মেডিকেল স্টুডেন্ট নিয়েছিলেন স্যাম্পল হিসেবে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে। সেখানে ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে ফিফথ ইয়ারের শিক্ষার্থীরা ছিল। তাদের বয়স বেশিরাভাগেরই ২২-২৩ বছর। আমরা দেখি কী পাওয়া গেলো--

১) বিগত দুসপ্তাহ ধরে একটানা দুঃখবোধে জর্জরিত ছিলেন ২৬.৭% ছাত্রছাত্রী (খেয়াল করি তখন কিন্তু কোনো প্রফেশনাল পরীক্ষা চলছিল না)।

২)তাদের কোনো শখ-আহ্লাদ পূরণ করার উপায় নেই এই মেডিকেল জীবনে-- এরকম মনে করেন ৩৭.৬% ছাত্রছাত্রী।

৩) সারাক্ষণ ক্লান্তিবোধে ভুগতে থাকেন এরকম ছাত্রছাত্রী ৩৫%।

৪) অতিরিক্ত ঘুমপ্রবণ, সারাক্ষণই ঘুমোতে ইচ্ছে করে ১৯% ছাত্রছাত্রীর। আবার ২৬% শিক্ষার্থী ইনসোমনিয়া অর্থাৎ অনিদ্রায় ভোগেন। তাহলে দেখা গেলো ৪৫% মেডিকেল শিক্ষার্থীরই ঘুমজনিত সমস্যা আছে।

৫) সারাদিন ধরে এক্সস্টেড, টায়ার্ড, শক্তি পান না এরকম শিক্ষার্থী ২৯ %।

৬) তাদের মধ্যে ১৭.৬% শিক্ষার্থীর কখনও না কখনও সুইসাইডাল থট এসেছে।

৭) "Life is not worth living"-- ৪০.৩% শিক্ষার্থীই এটা মনে করছেন।

৮) ফার্স্ট ইয়ারে সুইসাইডাল থট সবচেয়ে বেশি, তারপর ধীরে ধীরে এরমাত্রা কমে এসেছে।

৯) হয়তো সাধারণভাবে এটা ভাবা হয় যে মেডিকেল ছাত্রীদের মধ্যে ডিপ্রেশানের হার বেশি, কিন্তু দেখা গেলো উল্টো। বরং মেডিকেল ছাত্রদের মধ্যেই ডিপ্রেশানের হার বেশি।

বিজ্ঞ পাঠক, ভাবতে পারছেন যারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হবেন তাদের অবস্থাটা কী ভয়াবহ! আল্লাহর ইচ্ছেয় যে ডাক্তারের মানুষের জীবন বাঁচানোর কথা, সে হবু ডাক্তারদের একটা বড় অংশ নিজেরাই মনে করছে তার জীবনটা বেঁচে থাকার জন্য তেমন উপযুক্ত না। তারা লাইফটা এনজয় করছে না, সারাক্ষণ অবসাদগ্রস্ত থাকছে, শখ-আহ্লাদগুলো বিস্তর পড়াশোনার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে বানিয়ে দিচ্ছে এক অসামাজিক জীব।

এই যে একটা বড় সংখ্যক স্টুডেন্ট ডিপ্রেশানে ভুগছেন, এটা কিন্তু তারা মন খুলে কাউকে বলছেন না, নিজেদের ভেতর চেপে রাখছেন। না বন্ধুদের সাহায্য নিচ্ছেন আর না শিক্ষকদের সাহায্য নিচ্ছেন। তাদের মনে একটা ধারণা, তারা যদি বন্ধুদেরকে জানায় তারা ডিপ্রেসড, তাহলে বন্ধুরা তাকে কম পাত্তা দেবে। আর শিক্ষকদের জানালে পরীক্ষায় পাশ করাবে না।

বাইরের বিভিন্ন মেডিকেলে আমরা শুনি তাদের জন্যে কাউন্সেলিং সেণ্টার থাকে, যেখানে স্টুডেন্টরা তাদের মনের কথা-ব্যথাগুলো খুলে বলতে পারে; অথচ আমাদের দেশে কোনো মেডিকেল কলেজেই এমন কিছু নেই। ভবিষ্যত ডাক্তারদের একটা বড় অংশ আজ যেভাবে হতাশায় ডুবে আছে, তাদের এই মানসিক স্বাস্থ্যটা সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনা কি এখন সময়ের দাবি না? একজন ডাক্তারই যদি সর্বক্ষণ ডিপ্রেশানে থাকেন, সেটা কি রোগীসেবার মানের ওপর প্রভাব ফেলবে না? জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে হলেও মেডিকেল কারিকুলামে পরিবর্তন, মেডিকেল ছাত্রদের জন্যে কাউন্সেলিং সেন্টার চালুকরণসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, শিক্ষকমণ্ডলীর উদার মানসিকতা কিন্তু দিতে পারে বহু বহু ছাত্র-ছাত্রীর হতাশা কাটিয়ে উঠে এক নতুন জীবন শুরু করার অনুপ্রেরণা।

** আরেকটা বিষয়, আমাদের দেশে সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা কিন্তু বেজায় কম। যেখানে এমেরিকাতে মোট চিকিৎসকের ৫.৪% সাইকিয়াট্রিস্ট, সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ০.৪%। এ ব্যাপারটির দিকেও নজর দেয়া খুব প্রয়োজন।

______________________________

 


মারুফ রায়হান খান , ইন্টার্ন চিকিৎসক , এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়