Ameen Qudir

Published:
2019-05-29 20:35:03 BdST

রোগী কথনঃ'দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি; বাবা যেন এক রকম পালিয়ে গেলেন মাকে ডাকতে'


 


ডা. ছাবিকুন নাহার
___________________________

মাসিক নিয়ে আমার একটি লেখা রোগী কথনের শুরুর দিকে লিখেছিলাম। আজ বিশ্ব মাসিক সচেতনতা দিবস। সে উপলক্ষে আসুন পুরনো কথা গল্পচ্ছলে নতুন করে জানি।

* অর্থি। ক্লাস ফাইভ। দারুন বুদ্ধিমতি। চাঁদের আলোর মতো সুন্দর! চারপাশের সবকিছু অবাক বিস্ময়ে দেখে। প্রজাপতির মতো উড়েউড়ে ঘুরে বেড়ায়। কেমন একটা ছন্দ ওর চারপাশ জুড়ে। হঠাৎ একদিন সে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুল্ল। অর্থি আর কান্না? মেলানো যাচ্ছে না।

- কি হয়েছে মা অর্থি?
- বাবা কেটে গেছে, অনেক রক্ত!
- কোথায় দেখি দেখি, উৎকন্ঠা বাবার কন্ঠে।
- এইখানে বাবা... বলে পয়েন্টিং করল। বাবা চুপ। দাড়াও তোমার মাকে ডাকছি। বাবা যেন এক রকম পালিয়ে গেলেন মাকে ডাকতে।

- এই তোর বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে শুনি?
- সব পটর পটর করে বাবাকে বলা লাগে, হ্যাঁ?
- তুমি এখন আর ছোট নও বুঝলে? লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি বাদ। কারো সাথে তেমন মিশবে না। ছেলেদের সাথে তো নয়ই।
- তোতনের সাথে ও না?
- বল্লাম তো। বেশি বেশি ঘরে থাকবে।
- কেন এমন হলো মা? আমি কী খুব খারাপ?
- মা রে, এটা সব মেয়েদেরই হয়।
- তোমার ও?
- হুম।

যাক হাফ ছেড়ে বাঁচল অর্থি। যে ব্যাপাারটা মায়ের সাথে হয়। সেটা যাই হোক খারাপ হতে পারে না। একটু সহজ হলো মেয়ে। মা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বল্লেন। কি করতে হবে তাও। কিন্তু বারবার করে, বেশি বেশি জোর দিয়ে বল্লেন,
তুমি আর ছোট নেই। বড় হয়ে গেছ।

অর্থি বুঝে পায়না। একবেলায় সে কেমন করে বড় হয়ে গেল! আর মা ই বা কেন ফিসফিস করে কথা বলছে? আর বাবাই কেন বা ওমন করে পালালেন! বাবাতো এমন না। তবে কি আমি ভুল কিছু করেছি? কোন বড় কিছু!? আরেহ না! মায়েরও নাকি ওমন হয়! তো মা কী কখনো ভুল করে?

নাজোয়া, সেভেনে পড়ে। একটু শান্ত। অভিমানী। ক্লাসমেটরা তার পিছনে কিছু একটার ইঙ্গীত করছে। সে ফিরে তাকিয়ে দেখে লাল কিছু একটা। সবাই ফিসফিস! অবশেষে এক বড় আপুর সহায়তায় বাড়িমুখি। চোখ জলে ভরে যাচ্ছে। বুকে দলা পাকানো অভিমানী কান্না। আমাকে আগে কেউ বলেনি কেন? মাকে খুব মনে পরছে। মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আগেই বলতেন। কেমন অপদস্ত হতে হলো! ছি! ছি!সবাই জেনে গেল। বন্ধুরা...হাসাহাসি... আবারো বুক জমানো কান্না। কিশোরী বয়সের অভিমানী কান্না ভয়াবহ, মারাত্মক!

উপরোক্ত ঘটনা দুটো খুবই নৈমিত্তিক। আপনি যদি নারী হোন তাহলে আপনার জীবনে কখনো না কখনো ঘটেছে অথবা ঘটবে। পুরুষদেরকে বলছি, আপনার জীবনে ও। ভুল বল্লাম কী ? না, ভুল বলিনি। আপনার পরিবারে, বোনের কিংবা ওয়াইফের। আর যদি তাও বাদ যায়, আপনার মায়ের জীবনে যে ঘটেছে নিশ্চিত করে বলতে পারি।

এতো নিশ্চিত হলেম কি করে? আরেহ না হলে যে আপনি হতেন না! আর হ্যাঁ বলে রাখলুম, আপনার মেয়েরও কিন্তু হবে। তো পরিবারের এতগুলো মানুষ যদি এই অমোঘ ঘটনার মধ্যদিয়ে যায়, তখন পরিবারের গুরুত্বপূর্ন একজন সদস্য হিসেবে আপনারও তো কিছু না কিছু আসা যাওয়া উচিৎ। কিভাবে? পরিবারে সবকিছুতে তো সবারতো কিছু না কিছু রোল থাকে। আপনার রোল হচ্ছে এ ব্যাপারে ভালো করে জানা।

অবাক কান্ড! আমাদের জীবনপথের সবচেয়ে গুরুত্ববহন করে এমন ব্যাপারগুলোতে আমরা ভয়াবহ রকম নির্লিপ্তি থাকি। আশ্চর্য! কেন থাকি সেটা জানিনা। কি লাভ এতে? কেন এত লুকোচুরি? এত ট্যাবু!

আসুন জানা কথা আরেকটু জানি। অযথা লজ্জা টজ্জা পাওয়ার দরকার নাই। স্রেফ একটু অনুধাবন করুন। ব্যাস। করনীয় আপনা আপনি এসে যাবে।

* মেন্সট্রুয়েশান কি?
- নারীর জরায়ু থেকে প্রতিমাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্লিডিং হওয়াকে এই মেন্স বলে।

* কত বছর বয়সে শুরু হয়?
- সাধারনত ১৩ বছর বয়সে। ২/১ বছর আগে বা পরে।

* কত দিন থাকে?
- সাধারনত ৩-৫ দিন থাকে। কারো কারো একটু কম বেশি।

* কেন হয়?
- এটা শরীরবৃত্তীয়। হরমোনের প্রভাবে হয়। সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো- আরে এটা না হলে আপনিই তো হতেন না। অর্থাৎ একজন নারীকে নারী হতে হলে মাসিক বা মেন্স জরুরী। ব্যাতিক্রম কিছু আছে, সেটা নিয়ে পরে বলব।ব্যাপ্তিকাল সাধারনত ১৩-৪৫ বছর। +/- ৫ বছর কখনো কখনো।

* ম্যাকানিজম কি?
- প্রতিমাসে নারীর ডিম্বাশয় থেকে একটা ডিম (ওভাম) নিসৃত হয়। সে স্রষ্টার নির্দেশে স্পার্ম এর জন্য অপেক্ষা করে। দুজনে মিলে নতুন জীবন আনে। সেই জীবন একটু একটু করে জরায়ুতে বড় হতে থাকে। মায়ের রক্ত মাংস খেয়ে। অদ্ভূত! যখন এর ব্যত্যয় ঘটে জরায়ু কান্না করে। আর তার এই কান্না ফোঁটায় ফোঁটায় বাইরে আসে। আমরা তাকে বলি মেন্স বা মাসিক।

আমরা যেমন খাই, ঘুমাই, ওয়াসরুমে যাই। হাসি, কান্না করি। প্রেম করি। সংসার করি। আরো স্পেফিক করে বল্লে, প্রজন্ম চাষ করি, তেমনি মাসিক একটি ফিজিওলজিক্যাল ব্যাপার। এটাকে আলাদা করে, ফিসফিস করে দেখার কিছু নেই।

আজকের মতো শেষ করছি, অন্যদিন এর মিথগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাবে। কী অদ্ভূত সেসব ঘটনা জানলে মন থেমে যাবে কিছুক্ষনের জন্য হলেও। আচ্ছা যাক। যা বলছিলাম, কিছু হলেও তো জানলেন। এখন নিশ্চয় আশা করতে পারি, কোন নারীকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে দেখলে অন্যরকম ভাবে তাকাবেন না। কিংবা বাজারের ফর্দে একটা এই নতুন আইটেম আপনিই যোগ করলেন খুব নীরবে। তারপর দেখুন ম্যাজিক। কত আন্তরিক হয়ে ওঠে আপনার বাসার পরিবেশ। সত্যি বলছি। ট্রাই করেই দেখুন না।
___________________________

ডা. ছাবিকুন নাহার
চিকিৎসক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়