Ameen Qudir

Published:
2019-05-04 20:39:26 BdST

দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি একটি ভালোবাসার গল্প লেখার প্রচেষ্টা:২


দেবব্রত তরফদার
______________________
প্রথম কিস্তির লিঙ্ক 

https://daktarprotidin.com/column/3889/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE

 

দ্বিতীয় কিস্তির শুরু

চুপ থেকে বুল্টি বলে , জানেন মা একদম গান পছন্দ করেনা । বাবাও বহুদিন আমায় আর গান শেখান না । পুরোনো যা শিখেছি তাই রেওয়াজ করি । বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে কখনো অংশগ্রহণ করিনি এমনকি স্কুলে কেউ জানেইনা যে আমি গান জানি । আবারও একটি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনায় জয়দীপ কিছুটা বিব্রত । আর মনে ভাবে একে যতটা বাচ্চা ভাবি আসলে তারচেয়ে অনেক পরিণত ।
বুল্টির রচনা অবশ্য দিদিদের খুব ভালো লেগেছিল , সারা স্কুলের সামনে সেটাকে পড়ে শোনানো হয় । পুজো আসে চলে যায় এবং ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয় । রেজাল্ট বেরোলে দেখা যায় বুল্টি অনেককে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে , আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার অঙ্কে লেটার না হলেও কাছাকাছি । ডিসেম্বরের শেষে ছাত্রীর রেজাল্ট জানার জন্য জয়দীপ আসে কোলকাতা থেকে সরাসরি । লেটার না হওয়ায় বুলটি ম্রিয়মাণ , জয়দীপ একটুও হতাশ হয়নি । কাঁধের ব্যাগটা বেশ ভারী । তার মধ্যে থেকে বার করে তিনখন্ড বিভূতি রচনাবলী । এর চেয়ে বেশি ম্যানেজ করতে পারেনি । বলে , আগামী বছর পুরোটাই পাবি।
পরের বছর দুটি বিয়ে হয় দুই পরিবারে । জয়দীপের ছোটদির বিয়ে হয় আগে আর কৃষিবিজ্ঞানী দাদার পরে । জয়দীপ বন্ধুর দেওয়া একটি 110 ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়ে ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় । কিশোরী ছাত্রীটি আজ সাজে উর্বশী মেনকাকেও হার মানায় । আর তার একমাত্র গেস্ট বোধহয় জয়দীপ । তার চা শরবত নিয়েই সে ব্যস্ত । কিছুদিন লক্ষ্য করেছে জয়দীপ, যে বুলটি তাকে কোন সম্বোধন করেনা , বেশির ভাগ সময় ভাববাচ্যে কথা বলে । আরো অনেক কিছু টের পায় কিন্তু এ ব্যাপারে চরম পেশাদার সে । বুলটির প্রচেষ্ঠা তাকে উজ্জীবিত করে । এর কারণ সে নিজেই অনেকটা তা বুঝতে পারে । নিজে দুর্বলতা প্রকাশ করলেই অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে তাই তার দৃঢ়তা বাড়ে। তার নিজের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা , সে নিজেও পড়ার মধ্যে ডুবে যায় । শুধুমাত্র নটরাজ কলাসঙ্গমের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একটি সারারাত্রি ব্যাপী ধ্রুপদী গান বাজনার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সুমন্তের সঙ্গে । সঙ্গে ছিলেন সুবিমলবাবু এবং বুল্টি । এসব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই জয়দীপের । তার দিদিদের গান শেখার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না পরিবারের । তারা রেডিওতে কমার্শিয়াল আর্টিস্টের গানই শোনে । সুমন্তর চাপে বাধ্য হয়েছিল , বুল্টির নীরব অনুনয় ছিল । সেটা উপেক্ষা করাই যেত কিন্তু তার নিজেরও গরজ ছিল কেননা এই অনুষ্ঠানে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী আসছেন । সুমন্ত জোর করে রাজি করিয়েছে বাবাকে ওই অনুষ্ঠানে যাবার জন্য । কোনো বিশেষ ঘটনার সাক্ষী হবার ইচ্ছেতেই তার যাওয়া ।
অনুষ্ঠান দেখার পর পরই তার পার্ট ওয়ান পরীক্ষার কারনে একমাস ছুটি নেয় । এর পর মাধ্যমিক পরীক্ষা দামামা বেজে যায় প্রিটেস্ট পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে । যথাসময়ে পরীক্ষাও হয়ে যায় । আবার নতুন ছাত্রের অন্বেষণ , তা না হলে মুশকিল , শুধুমাত্র শম্পাকেই পড়াতে যাওয়া সপ্তাহে তিনদিন। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান , মাধ্যমিক রেজাল্ট বার হয় । জয়দীপের টেনশন ছিল নিজের পরীক্ষারই মতো । বুলটির রেজাল্ট এত ভালো হবে তা নিজেও ভাবেনি । অঙ্কে 94 , তার নিজের চাইতেও বেশি । এ ব্যাপারে জয়দীপ এবাড়ির বড় ছেলেটিকে ধন্যবাদ দেয় কেননা সেদিন ছোট বোনটিকে এতটা অসম্মান আর হেয় না করলে এই চ্যালেঞ্জটা সে নিতো না । কিন্তু এর জন্য কিশোরী মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সে জানে । বাড়িতে ছিল উৎসবের পরিবেশ । কৃষিবিজ্ঞানী দাদা ঘোষণা করলেন , বুলটি কমার্স পড়ুক কেননা জয়দীপ তাহলে ভালো গাইড করতে পারবে । সবার সানন্দ সম্মতি ছিল , বুলটির চোখে হাজার পাওয়ারের আলো । কিন্তু জয়দীপ আর পড়াতে অস্বীকার করে । তার নিজের পড়ার অজুহাত দেয় এমনকি পরদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষার ব্যাপারেও তার অসুবিধা জানিয়ে দেয় । খুশির মধ্যে হটাৎ নীরবতা নেমে আসে । সাইকেল ছিলনা সেদিন , ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে সোজা বেরিয়ে আসে , একবারও পিছন দিকে তাকায়নি । অঞ্জনা খালের পাশ দিয়ে যখন ফেরে তখন আকাশে মরা চাঁদ , কোন তিথি কে জানে । সে জানে সবকিছু সবার জন্য নয় । একদিনের শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে পাকা ধান , শেষ হয়ে গেছে আগাম লাগানো পাট । ছোটদির বিয়ে হয়েছে ধারকর্জ করে । কয়েক মাসের মধ্যে জানা গেছে ব্যাংকর্মী জামাইবাবুটি ভালো লোক নন । নেশাটেশা করেন , ছোটদিকে ভিখারির বাচ্চাটাচ্চা বলে গালিগালাজ করেন । গায়ে হাতও তুলেছে একদিন । হাতটা ভেঙে দিতে পারলে ভালো হতো , সবাই মিলে সামলেছে তাকে কিন্তু এর একবার দেখবে সে । এইসব কারনে বাবার শরীর আরো খারাপ । মা লোকজন দিয়ে কোনরকমে চাষ আবাদ চালাচ্ছেন । জয়দীপ বুঝতে পারে এবার একটা ঝড় আসছে , সে শক্ত না হলে তলিয়ে যাবে পরিবারটি । হাতে একটাও টাকা নেই , বুল্টিকে কিছুই দেওয়া হলো না । জানিনা বিভূতিভূষণের বাকি খন্ডগুলি বুলটির পড়া হবে কিনা ।
এরপর কেটে গেছে আরো তিনটি বছর । কমার্স টিচার হিসেবে শহরে নাম হয়েছে জয়দীপের । তিনদিন রানাঘাটের এক কোচিং সেন্টারে পড়াতেও যায় । ছোটদি এক বছরের কিছু বেশি সময় পর এবাড়িতেই চলে এসেছে । এখন সেই চরম অপমানজনক আর অবমাননাকর পর্যায় মানে ডিভোর্স কেস চলছে । পায়ের নিচে শক্ত মাটি নেই । আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বেড়েছে জীবনযাত্রার মান , এবং পরিবারেরও কিছুটা । ছোটদি সেলাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে , আপ্রাণ চেষ্টা তার জীবনে দাঁড়ানোর । অন্ধকার সময়টাকে ভুলতে চায় । মাথার উপর ছাদ নেই , ছোট বোনের বিয়ে বাকি । বাবা মা এখনো গ্রামে থাকলেও সংসারের অনেকখানি দায়িত্ব জয়দীপের উপর । টিউশন সমুদ্রে এখন নিমজ্জিত সে । এসব ছেড়ে চাকরির জন্য চেষ্টা করার কথা সে ভাবতেও পারেনা । আপ্রাণ টাকা জমায় সে , তার আর কোনো স্বপ্ন নেই ।
এরকমই এক দিনে রানাঘাট কোচিং সেন্টার থেকে পড়িয়ে এসে বোনের কাছে শুনলো একটি মেয়ে তার খোঁজে এসেছিল । চেনা চেনা মনে হলেও বোন ঠিক তাকে চিনতে পারেনি । জয়দীপ ভাবে কোনো নতুন ছাত্রী হবে হয়তো । তার পরদিন দুপুরে কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখে বুল্টি। একটু অবাকও হয় । বলে , ভিতরে আয়।
না আপনি আসুন , বাইরে কোথাও বসি ।
ঠিক আছে চল । সেটাও ছিল জুন মাসের একটি দুপুর । দুজনে রবীন্দ্রভবনের দিকে হাঁটতে থাকে । দুজনেই চুপচাপ , কিন্তু কোনো অদৃশ্য তরঙ্গে হয়তো ভাববিনিময় চলে । জয়দীপ মুখ খোলে , তোর তো এবার সেকেন্ড ইয়ার , কি সাবজেক্ট ?
আপনি জানেন না ?
না তো , কিভাবে জানবো ?
আমার কোনো খোঁজই রাখেন না ?
জয়দীপ হাসে , মলিন হাসি।
আপনাকে চেনা যায় না , মুখে দাড়ি দেখে অবাক হয়েছি মেলাতে সময় লাগলো । শান্ত মেয়েটি অনেক প্রগলভ ।
আমি ইকনোমিক্স অনার্স পড়ি এই গভমেন্ট কলেজে ।তারপর থেমে বলে , আপনি বাড়ি থেকে বেরোন না ?
বেরোই তো , না বেরোলে চলে ।
কোথায় এই চার বছরে একবারও দেখলাম না। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে খুঁজেছি । আমার জন্যই তো আপনি আমাকে পড়ালেন না । কিসের ভয় আপনার ? এত পেশাদার আপনি ? এতো অহংকার ? তার গলা ভেঙে যায় ।জয়দীপ চুপ থাকে , মেয়েটিকে বলতে দেয় , আর তার বলার কিই বা আছে।
তারা দুজনে রবীন্দ্রভবনের পিছনে ঝুপসি একটা মেহগনি গাছের নিচে দাঁড়ায় । ঠান্ডা হওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে আসে । বুল্টিকে এবার সামনা সামনি দেখে । অনেক বড় হয়ে গেছে মেয়েটি । ব্যক্তিত্ব তার সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে । সরাসরি চোখের দিকে তাকায় সে ।
আপনি জানেন আমি কি বলবো ?
জানি , জয়দীপ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে ।
এতদিন কোনো যোগাযোগ করেননি কেন ?
জয়দীপ নিরুত্তর ।
আপনি কিছু বোঝেন ?
জয়দীপ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে ।
কবে থেকে বলুন তো ?
যেদিন তোকে বাংলা রচনা লিখে দিয়েছিলাম ।
বুলটি কিছুক্ষণ চুপচাপ , তারপর তার ব্যক্তিত্ব , গাম্ভীর্য ভাঙতে থাকে , চশমাটা খোলে , চোখ ছাপিয়ে বড় বড় ফোটা নামে এবং শেষে একদম ভেঙে পড়ে । জয়দীপ বিমূঢ় , সে মেয়েটাকে স্পর্শ করতে চায় কিন্তু জানে এতে আরো বেশি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তাই সামলে নেয় । বুলটিও কিছুক্ষন পর সামলে নেয় । কি বোকা আমি ভেবেছি এ আমার একান্ত নিজস্ব বিষয় , আর কি নিষ্ঠুর মানুষ পরের দেড় বছরে মুখের একটি রেখাও কাঁপেনি কোনোদিন । শুধু আমিই কেঁদে মরেছি আর আপ্রাণ পড়েছি এই পাথরটাকে খুশি করার জন্য । আমাকে ওই স্থবির , সংস্কারবদ্ধ পরিবেশ থেকে বার করে বেমালুম উবে যাওয়া । মানুষের একটা দায়বদ্ধতা তো থাকে । তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে , যাক বেহায়া যখন হয়েছি আজ সবকিছুর নিষ্পত্তি হোক । তারপর জয়দীপের মুখোমুখি দাঁড়ায় , তার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে । জয়দীপ লক্ষ্য করে একপশলা বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার , মালিন্যহীন । চোখে চোখ রেখে বুল্টি জিজ্ঞেস করে , আপনি কোনো মেয়েকে ভালোবাসেন ?
জয়দীপ না সূচক মাথা নাড়ে ।
মিথ্যে , আপনি মিথ্যের ভান করতে পারেন না। আপনি আমায় ভালোবাসেন ।
আমি তোকে শ্নেহ করি , পছন্দ করি , শ্রদ্ধা করি তোর লড়াকু মনোভাবকে , তোকে নিয়ে আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল , তুই জিতিয়ে দিয়েছিস আমায়।
কেন আমি কি গিনিপিগ নাকি , আমি রক্তমাংসের মানুষ এটা আপনি ভুলে গেছিলেন পড়ানোর আনন্দে । কেন তবে আপনি আমাকে আপনার মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন ? এই মুহূর্তে বুলটিকে ক্রুদ্ধ সর্পিনীর মতো লাগে । আর যে শক্ত খোলার মধ্যে জয়দীপ লুকিয়ে রেখেছিল নিজেকে সেটা ভাঙতে থাকে বোধহয় ।
আমি জানি আপনি আমাকেই ভালোবাসেন , এতো অহংকার আপনার , আপনি সংসার দায়িত্ব দারিদ্র এইসব খেলো অজুহাত দিয়ে নিজেকে ছোট করবেন না । আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে এসব নিয়েই বাঁচতে হয়।
জয়দীপ ভাবে মানুষ এত কম জানে , মানুষকে বুঝতে পারে বলে তার অহংকার ছিল । যে মেয়েটিকে অপরিণত বালিকা ভেবেছিল সে তার হাড় মজ্জা কোষ পর্যন্ত বার করে দেখাচ্ছে । সে আসলে চরম পেশাদারের মত নিজেকে শক্ত খোলায় আবদ্ধ রেখেছিল । তার ভেতরের আমি কি চায় সেটা সংগোপনেই ছিল বলে সে মনে করতো । আজ তার সবকিছুই উন্মোচিত হলেও তার লজ্জাবোধ হচ্ছেনা কেন তাই ভেবে একটু অবাক হয় । বুল্টি বোধহয় জয়দীপের চোখে আলোছায়ায় খেলা পড়তে পারে , এবার সে মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়ে । আমার কিন্তু সেই বৈশাখী পূর্ণিমার রাতের প্রতি মুহূর্ত মনে আছে।
জয়দীপেরও মনে আছে সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত । নটরাজ কলা সঙ্গমের উদ্যোগে সারারাত্রিব্যাপি ধ্রুপদী গানের আসর । সে সঙ্গী হয়েছিল পরিবারটির সঙ্গে । অমিতা দত্তের কত্থক নাচের অনুষ্ঠান চলাকালীন সুমন্ত জয়দীপের হাত ধরে টানে , চলো অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করে আসি । রবীন্দ্রভবনের সামনে সরকারি আবাসনের বিশ্রামকক্ষে পন্ডিতজির সঙ্গে দেখা করা সহজ ছিল না । অনেক অনুনয় বিনয়ে কর্মকর্তাদের মন ভিজিয়ে দুজনে ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখে উনি একা বসে আছেন। দুজনে প্রনাম করার পর সুমন্ত নম্রস্বরে বলে , গুরুজী আমার বাবা সুবিমল গোস্বামী আপনার পূর্বপরিচিত । আর কিছু বলার আগেই অজয়বাবু নড়েচড়ে বসেন , কে নৈহাটির সুবিমল ? কোথায় সে , আমরা দুজনে বৈরাগীজি র কাছে গান শিখেছি । জয়দীপ সবই জানতো , সে ওখানে সুমন্তকে রেখে একদৌড়ে আবার হলে ওদের দুজনকে নিয়ে যখন সুমন্তদের কাছে পৌঁছায় তখন সে রীতিমতো হাঁফাচ্ছে । অজয় চক্রবর্তীর দশাসই চেহারার আলিঙ্গনে সুবিমল বাবুর ছোট্টখাট শরীরটা প্রায় হারিয়ে যায় । এরপর উনি বুল্টি আর সুমন্তকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেন । জয়দীপ ভাবে এখানে এখন তার কোনো ভূমিকা নেই । সে বেরিয়ে যায় , এর পরেই তরুণ ভট্টাচার্যের সন্তুরবাদন শুরু হবে । প্রায় এক ঘন্টা পর ওরা তিনজন এসে আসন গ্রহণ করে। রাত্রি একটার সময় মঞ্চে ওঠেন পন্ডিতজি । উঠেই দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন , নৈহাটির কানাইদাস বৈরাগীর কাছে আমার গানের শিক্ষন জীবন শুরু , সেই সময়ের সতীর্থ সুবিমল গোস্বামী আপনাদের শহরের বাসিন্দা , সে মঞ্চে আমার সঙ্গে থাকার জন্য আমি আপনাদের অনুমতি চাইছি । সুবিমলবাবু উঠে আপত্তি করার মত ভাব করলেও সুমন্ত বাবার হাত ধরে মঞ্চের দিকে নিয়ে যায় । একটু পরেই তানপুরা হাতে সুবিমলবাবুকে দেখা যায় পন্ডিতজির পাশে। আর তারপরেই পন্ডিতজি সুরের মায়াজাল বিস্তার করে দর্শকদের আবিষ্ট করেন । জয়দীপের চোখ ছিল পাশের মেয়েটির মুখের দিকে । সারাক্ষনই চোখের জলে মুখ ভেসে গেছে , মুছতে পর্যন্ত ভুলে গেছে । জয়দীপ জানে এই চোখের জলের অর্থ। রাত তিনটেই পন্ডিতজির গান শেষ । সুবিমলবাবু বন্ধুর সঙ্গেই থেকে গেছেন । এরপর মঞ্চে উঠলেন আলী হোসেন । তিনি এবং তাঁর দলবল সানাই এ প্রথমে মিয়াঁ মালহার এবং পরে ভূপালী তে করে দিলেন মাত । শ্রোতারা ছিলেন সুরের আবেশে । জয়দীপের নতুন অভিজ্ঞতা , সে ছিল ঘোরের মধ্যে । অনুষ্ঠান শেষ হবার কথা । ভোর হয়ে আসছে । কিন্তু সংস্থার কর্ণধার , চিকিৎসক বাসুদেব মন্ডলের অনুরোধে মঞ্চে আবার ওঠেন সন্তুরবাদক তরুণ ভট্টাচার্য । এবার সানাই আর সন্তুরের যুগলবন্দি । দর্শক আবার নড়েচড়ে বসেন । শুরু হয় ভৈরবী রাগে সন্তুর আর সানাই এর মায়াজাল বিস্তার । এমন সময় সুমন্ত জয়দীপের কানে কানে বলে , জয়দীপদা বোন অনেক্ষন বসে , ওর শরীরটা ভালো লাগছেনা , তুমি ওকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে ? সন্তুর আর সানাই কে পিছনে ফেলে ওরা দুজন বাইরে বেরিয়ে আসে । হলের বাইরে গাছগুলির গোড়া বাঁধানো । দুজনে একটিতে বসে । হলের সমস্ত দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে । অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে , পূবদিকে লাল আভা , সন্তুর আর সানাই এর শব্দ হল ছাড়িয়ে ভরে দিচ্ছে আকাশ বাতাস । জয়দীপের হাতের উপর ছিল একটি হাতের স্পর্শ । এই ভোর , এই ঐকতান , সমস্ত ব্যাপারটিকে তার মনে হচ্ছিল অলীক , অপার্থিব । সে ভাবছিল কোনো রকমে বেঁচে থাকা , কোনো রকমে ঘষটে চলা এসব মনে হয় মিথ্যে । সে চাইছিল সময় থেমে যাক , এই মুহূর্তটা থাকুক অনন্তকাল । কঠিন হৃদয় ছেলেটির চোখে হটাৎ জল এসে পড়ে , সে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও হাতটা সরাতে পারেনি।
কি ভাবছেন ? আমি জানি কি ভাবছেন । আজ বোধহয় জয়দীপের ধরা পড়ার দিন।
বুল্টি আর একটু কাছে সরে এসে বলে , আজ সবই অন্যরকম , আগে আপনি বলতেন আমি শুনতাম । আপনাকে মাঝে মধ্যে অচেনা লাগছে । এই চার বছরে আমার কতো পরিবর্তন , আপনি তো খোঁজই রাখেন না । কলেজের গানের অনুষ্ঠানের সব দায়িত্ব আমার , যুববানী তে চারবার গান গাওয়া হয়ে গেল । ডিবেটে কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি গেছি। আমাকে এই মানুষ হবার স্বপ্ন আপনি দেখিয়েছেন । যার জন্য এতকিছু , আমার স্বপ্নের সেই ফেরিওয়ালার সন্ধানে আমাকেই ছুটতে হলো ভয় লজ্জার মাথা খেয়ে ।
সূর্য পশ্চিমে ঢলছে , গাছের ছায়াগুলো লম্বা হতে শুরু করেছে । বিকেল হয়ে আসলো । বুলটি এবার নতমুখী , আপনি আমার সন্ধান না করলেও আমি বারবার আসবো, হাজারবার । কতবার আপনি আমায় ফেরাবেন।
পরিবেশটাকে সহজ করার জন্য জয়দীপ তার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে । দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ খোলামেলা কথাবার্তা হয় । এরপর বুল্টি বলে , আমায় তো বাড়ি ফিরতে হবে , মা ভাবছেন মেয়ে বোধহয় পালিয়েই গেল ।একটা রিক্সা ডেকে দিন , আর যে কোনোদিন হাজির হবো এরকমভাবে ।
দুজনে হাঁটতে শুরু করে , হটাৎ বুল্টি সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় । ফিসফিস করে বলে , একবার তুমি বলবো ? জয়দীপ হেসে ফেলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে ।
যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমার চাই ই চাই । তারপর একরাশ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে । সামনে একটি রিক্সা এসে দাঁড়াতেই হটাৎই জয়দীপকে একটা প্রনাম করে রিকশায় উঠে পড়ে । জয়দীপ বলে , শেষটা কি হলো ? মৃদুস্বরে বলে ওঠে , মাস্টারমশাই তো ভুলি কি করে । রিকশা এগিয়ে যায় ।
জয়দীপ অনেক্ষন ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদে পুড়তে থাকে । হটাৎ মনে হয় কাল কোর্টে ছোটদির ফাইনাল ডেট । উকিলের সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে ।বহুদিন পর নির্ভার মনে হয় নিজেকে । চরম দাবদাহের মধ্যেও ভৈরবীর সুর ভাসে । জয়দীপ কান পেতে শোনে। শেষ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়