Ameen Qudir

Published:
2019-04-05 23:15:42 BdST

অনেকে মেডিক্যাল পড়ার চাপ সইতে না পেরে বাক্স পেটরা নিয়ে পিতৃগৃহে ফিরতে বাধ্য হয়েছে


 


ডাঃ আজাদ হাসান
___________________________


প্রথমেই বলি, আমি শিক্ষাবিদ্ নই। তবে আমিও একদিন ছাত্র ছিলাম, ঐ ছাত্রত্বের মধ্য দিয়েই আমি গড়ে উঠেছি।

আমাদের সময় একটি কথা প্রচলিত ছিল, "ছাত্রজীবন বড়ই মধুর যদি না থাকিত পরীক্ষা"। কিন্তু এই পরীক্ষার গুরুত্ব যে কি সেটা এক কথায় বলে কিংবা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ক্লাস সেভেন থেকে টুয়েলভ্ পর্যন্ত আমি কেডেট কলেজ নামক রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়েছি। কঠিন কঠোর শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে প্রতিটি কর্ম দিবস পার করতে হতো। সারা দিনে সেল্ফ স্ট্যাডি বা পারসোনাল স্ট্যাডির জন্য দৈনিক গড়ে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় পেতাম। দৈনিক পিটি/প্যারেড গেমস্ তো থাকতোই, তার সাথে সারা বছরই কোনো না কোনো কম্পিটিশন থাকতো। এ সপ্তাহে কবিতা আবৃত্তি তো তো নেক্সড্ উইকে উপস্থিত বক্তৃতা, এ সপ্তাহে জুনিয়র গ্রুপের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা তো নেক্সড্ উইকে সিনিয়রদের বিতর্ক প্রতিযোগিতা। আজ আর্ট কম্পিটিশন তো নেক্সড্ উইকে সংগীত, এই সপ্তাহে কারেন্ট এফেয়ার্স তো নেক্সড্ উইকে জেনারেল নলেজ প্রতিযোগিতা। এভাবে সারা বছরই আমরা নানান কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকতাম। তাছাড়া ছিলো বিভিন্ন স্পোর্টস কম্পিটিশন, অ্যাথলেটিক্স এবং লং ডিস্টেন্স দৌড়। আর এর পাশাপাশি একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্যে ছিলো, প্রতি ২ সপ্তাহ পর পর প্রতিটি সাবজেক্ট-এর উপর ক্লাস টেস্ট। তাই দেখা যেতো গড়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সাবজেক্ট এর ক্লাস টেস্ট থাকতো। একদিকে একাডেমিক কারিক্যুলাম এর পড়ার চাপ আবার অন্যদিকে এক্সট্রা-কারিক্যুলাম একটিভিটিস্ সব মিলিয়ে সারা বছরই মোটামুটি দৌড়ের উপর থেকেছি।

আমাদের সময়ে সারা বইটিই ছিলো সিলেবাস, স্যারদের চেষ্টা থাকতো কিভাবে নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস কমপ্লিট করবেন, আর আমাদের চেষ্টা থাকতো নির্দিষ্ট সময়ে ম্যাক্সিমাম কতটা করায়ত্ব করতে পারি।

পরবর্তীতে যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম তখন দেখি অবস্থা আরো কঠিন, এখানে মোটামুটি প্রতি অল্টারনেট ডে-তে আইটেম বা ক্লাস টেস্ট। কথিত আছে "ছাত্র নং অধ্যয়নং তপ"।
আমাদের ব্যাচে আমরা তিনজন একই কেডেট কলেজের ছিলাম।যেহেতু আগের থেকেই আমরা ক্যাডেট কলেজের তিন বন্ধু এরকম পরীক্ষার সাথে ওরিয়েন্টেড ছিলাম তাই আমাদেরকে নতুন সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন বেগ পেতে না হলেও আমাদের ব্যাচে অনেককেই প্রতি অল্টারনেটিভ ডে ক্লাস পরীক্ষা বা আইটেম-এর এই নতুন পদ্ধতি নিয়ে হা পিত্যেশ করতে দেখেছি। এমন কি অনেকে মেডিক্যাল কলেজের পড়ার চাপ সইতে না পেরে রণে ভংগ দিয়ে বাক্স পেটরা নিয়ে পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ অভিভাবক মহলে যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো সেটা হলো, পিএসসি কিংবা জেএসসি পরীক্ষা থাকবে কিনা (?) এটা কোমল মতি শিশুদের উপর অযথা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে কিনা? সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন পরীক্ষায় থাকবে কিনা (?) সম্প্রতি প্রবর্তিত বোর্ড পরীক্ষা চলমান থাকবে নাকি এর স্থলে আগের মতো কেবল মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদেরকে পড়াশুনায় অনুপ্রাণিত করার জন্য কেবল ৫ম এবং অষ্টম শ্রেণীতে পূর্ববত বৃত্তি পরীক্ষা পুনঃ প্রবর্তন করা হবে।

এসব প্রশ্নের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান না করে, সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশ ক্রমে প্রথম ধাপে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধাপে ধাপে বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করণের সিদ্ধান্ত কোন যুক্তিতে এবং কোন উর্বর মস্তিষ্ক হতে নির্গত তা বোধগোম্য নয়।

কথায় কথায় আমরা উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশকে তুলনা করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সে সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ইনফ্রাস্ট্র্যাকচার এর সাযুজ্য আছে। এ প্রসংগে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।

♦আমাদের দেশে ছাত্র শিক্ষকের মাঝে স্ট্যান্ডার অনুযায়ী যে অনুপাত বজায় রাখার কথা, তা মানা হয় না।
♦শিক্ষক স্বল্পতা একটি বড় সংকট।
♦আমাদের দেশে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের বেতন, একজন হেভি-ভেহিক্যাল ড্রাইভারের বেতনের চেয়ে কম।
আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রদের জন্য পর্যাপ্ত আসন ব্যবস্থা, আধুনিক শিক্ষার উপকরণ, খেলার মাঠ, লাইব্রেরী নেই, এমন কি অনেক স্কুল আছে যেখানে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দরজা জানালারও ঠিক নেই।
♦তাছাড়া শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং নিয়মিত রিফ্রেসার্স কোর্সের অণুপস্থিতি রয়েছে।
এ কথায় বলা চলে, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নেই।
মান সম্মত শিক্ষা প্রদান কল্পে এ সব সমস্যার আশু সংস্কার আবশ্যক।

তাছাড়া একজন বাচ্চার কাছে পড়াশুনাকে আকর্ষনীয় করে তোলার মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে শিক্ষকদের মাঝে।

এমন কি শিক্ষকদের আকর্ষনীয় স্যালারী, সামাজিক মর্যাদার কমতি থাকায় অনেকে মেধাবী ছাত্ররাও এ পেশায় আসতে আগ্রহী নন।

♥♥♥
এবার বিদেশের স্কুলের পাঠ দান পদ্ধতি সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেই। আমার ছোট শালীর মেয়ে ক্লাস ফোর-এর ছাত্রী, ওরা আমেরিকায় থাকে, একদিন ওদের টিচার ক্লাসে একটি জারের ভেতর প্রজাপতির একটি "লার্ভা" এনে ক্লাসের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখলেন এবং ক্লাসে সেদিন "প্রজাপতির জীবন চক্র" আলোচনা করা হলো। এবং ক্লাস শেষে টিচার বললেন, আগামী ২সপ্তাহ পর এই জারটির ভেতর হতে একটি প্রজাপতি বের হবে। সবাই তো শুনে ব্যাপারটিকে খুব অবাক হলো এবং বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিলো, সবার মাঝে এটা নিয়ে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হলো। এক একটা দিন যায় আর ছাত্র/ছাত্রীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে, সবার মাঝে এক ধরনের টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। লার্ভা হতে পিউপা এবং অবশেষে ১৪তম কি ১৫তম দিনে ক্লাসে যেয়ে দেখতে পেলো যে ঐ "লার্ভা" হতে ঠিকই একটা "প্রজাপতি" বের হয়েছে।
আর একদিনে টিচার স্কুল ফিল্ডে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রং-এর মাটি স্তরে স্তরে স্তরীভূত করা হলো, এরপর ঐ মাটির মধ্যে একটি কেচো ছেড়ে দেয়া হলো। উদ্দেশ্য হলো কেচো যে নীচের মাটি উপরে তুলে এবং উপরের মাটি নীচে নিয়ে যায় তা প্রমাণ করা। আর এ কারণেই
কেচোকে প্রাকৃতিক লাঙ্গল বলে।

আর একটি উদাহরণ দেই, আমার মেঝো শালী অষ্ট্রেলীয়ায় থাকে। ওর এক মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে, ওদেরকে একদিন স্কুল হতে "সী একুরিয়াম"-এ নিয়ে যাওয়া হলো, এরপর ওদেরকে এই ভিজিট সংক্রান্ত একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হলো।

ওর আর এক মেয়ে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী, ওদেরকে "রোমিও জুলিয়েট" নাটকটি পড়ানোর আগে টিচার সবাইকে সিডনীর "অপেরা হাউজে" নিয়ে যান, প্রথমে ওদেরকে "রোমিও জুলিয়েট" নাটকটি দেখানো হয়, এরপর ক্লাসে নাটকটি পড়ানো হয়।

এগুলো হলো উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ দান পদ্ধতির ধরণ। সুতরাং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিক না করে কেবল পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার কোনো আশানুরূপ ফল বয়ে আনবে না।

যদি প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার পূর্বক কোনো পরিবর্তন চান, তা হলে যে কাজ গুলো করতে হবে, তা হলোঃ

১) তৃণমূল বা মাঠ পর্যায়ে যে সব শিক্ষক আছেন, অভিভাবক আছেন তাদের মতামত জানার চেষ্টা করুন। শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করুন, সমাধানের উপায় নিয়ে মতামত সংগ্রহ করুন। এজন্য সবাইকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করুন, সেমিনার করুন, জেলা পর্যায় এবং বিভাগীয় পর্যায়ও অনুরূপ সেমিনার করুন।

২) একটি "জাতীয় কোর কমিটির" মাধ্যমে উক্ত ওয়ার্কশপ বা সেমিনার হতে প্রাপ্ত প্রস্তাব সমূহ পর্যালোচনা করুন। এবং আমাদের সমাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব সে ভাবে করম কৌশল নির্ধারন করতঃ প্রকল্প প্রণয়ন করুন।
৩) প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক স্কুলে কিংবা প্রতিটি বিভাগ হতে নির্দিষ্ট সংখ্যক স্কুলকে পাইলট প্রজেক্ট-এর আওয়াতায় এনে সেখানে প্রস্তাবিত লক্ষ্য সমূহ বাস্তবায়ন কল্পে কার্যক্রম গ্রহন করা হোক।

৪) একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির অগ্রগতির সাথে, পাইলট প্রজেক্ট-এর ছাত্রদের অগ্রগতি ও কার্যক্রম তুলনা মূলক যাচাই করে মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই বোঝা যাবে কোনটি আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত বা প্রযোজ্য হবে।

তাই, হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে, সীমিত পরিসরে পরীক্ষা মূলক ভাবে স্ট্যাডি করতঃ সারা দেশে বাস্তবায়ন করলে সেটা কোমলমতি ছাত্র তথা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

___________________________

ডাঃ আজাদ হাসান।
সিওমেক।
২১ তম ব্যাচ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়