Ameen Qudir

Published:
2019-03-21 06:29:02 BdST

তিনি আমার থেকে সামান্যই জুনিয়র, ফি র কথা বলতে যা তা বলে দরজা দেখালেন


 

 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

_________________________

২০০৭ এর মধ্য মার্চ। আমার চিকিৎসা আমিই নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করি। বড় ডাক্তারবাবু দের আপত্তি স্বত্বেও। আমার অসুখ সম্পর্কে হ্যারিসন, ইন্টারনেটে যা যা ছিল সব পড়ে ফেলেছি। বিশেষ ভাবে অজ্ঞ বলতে পারেন বৈকি। অন্য দিকে উন্নতি হলেও আমার নার্ভ ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলো। হাঁটা এতখানিই পাল্টেছিল যে, আমি না বুঝলেও অন্য সকলে একটু লক্ষ্য করে দেখলেই বুঝতে পারতেন।
তার আগেই আমার ডান হাতের উলনার নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডান হাতের কড়ে আঙুল অসাড়, সাড় নেই ডান অনামিকার বাহিরের দিকে। একেবারে বই অনুযায়ী।

একজন নিউরোলজিস্ট পরীক্ষা করে জানালেন যে সব রিফ্লেক্স ( এক্ষেত্রে জার্ক) অবশিষ্ট নেই। ইনি আমার থেকে সামান্যই জুনিয়র, ফি র কথা বলতে যা তা বলে দরজা দেখালেন।
সেই প্রেসক্রিপশন জমা করলুম নামী চিকিৎসকের কাছে। সম্ভবতঃ তিনি তখন আর জি করের বিভাগীয় প্রধান। আমার চিকিৎসা করছিলেন প্রাইভেট নার্সিং হোমে। তিনি বললেন, তবুও কোর্স শেষ করতেই হবে।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসিলুম, ইয়ে মানে, ভিনক্রিস্টিন না দিয়ে বাকি তিনটে দিন না।
উনি রাজি হলেন না। হ্যাঁ আমার পরিচয় জেনে , আমার মেডিক্লেম আছে শুনেই ফিজ বেশ করে হিসেব নিকেশ করেই নিতেন। সে বড় মজার হিসেব ও বটে। সেই বেসরকারি হাসপাতালে উনি আউটডোর চেম্বার করতেন। আবার যাঁরা ভর্তি আছেন , লিফটে উঠে তাঁদেরো দেখতেন। তবে আউটডোর ফিজ ছিল চারশো টাকা, ইন্ডোরে গেলেই তা হতো আটশো। ( আজ থেকে বারো বছর আগে) ।

আমার সুবিধার জন্যে শনিবার কখনো ভর্তি হতুম, আবার চিকিৎসা শেষে শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ি আসতুম। কখনো কখনো, বিশেষতঃ যখন আমাকে রক্ত নিতে হতো, তখন শনিবার সকালে ভর্তি হয়ে, ফিরতে ফিরতে রবিবার সন্ধ্যে হতো। এই নার্সিং হোম টি তৈরী হয়েছিল তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী র তত্বাবধানে। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মাঝে মাঝেই এই নার্সিং হোমে আসতেন। ওঁদের সল্ট লেকের নিবাস থেকে প্রায় হাঁটা পথ। খুব ন্যায্যমূল্যে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল। পরে জেনেছিলুম ওঁর স্ত্রী ( রমলা বৌদি বলতো সবাই) পরিচালন কমিটির সদস্যা অথবা প্রধানা ছিলেন।
পরিচ্ছন্নতা, সকালে জলখাবার থেকে দুপুরের আহার, বিকেলের চা বিস্কুট এমন কি রাতের খাবারের পরিচ্ছন্নতা, স্বাদ ও গুণমান যথেষ্ট ভালো ছিল। যে সেবিকা দিদিরা ছিলেন, তাঁরাও হাস্যমুখী, মৃদু স্বভাবী ছিলেন। বলা যায় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের থেকে ১০০ গুণ ভালো। এতো জোর দিয়ে লিখছি কারণ, সেই সূত্রেই তখনকার সরকারি হাসপাতালের সেবিকা দিদি দের ব্যবহার ( দূর্ব্যবহার ই প্রায়) দেখেছি কিনা। শীতকাল, চাকরি টিও সরকারি, তাঁরা চা বা কফি সরকারি হিটারে বানিয়ে টেবিল আলো করে বসে থাকতেন আর নানা সোয়েটার বুনতে ব্যস্ত থাকতেন ই বেশি। সম্ভবত তাঁদের উঠে চলে ঘুরে দেখার বিষয়ে অলিখিত নিয়মে বারণ ছিল। অথবা তাঁরা অমন নিয়ম করেছিলেন।
যাক, আমি তার আগেই সিটি স্ক্যানে দেখেছিলুম, অসুখের চিহ্ন মুছে গেছে। তার জন্যই ঝুঁকি টি নেই।
চিকিৎসক দের কাছে তখনো প্রি ম্যাচিওর এন্ডিং এর কুফল বা সুফল সম্পর্কে তেমন তথ্য ছিল না।
তা তিনি বলেছিলেন যে সমুদ্রতটের বালিতে হাঁটলে আমার পায়ের মাসলে জোর বাড়বে।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
আমি কখনোই ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলুম না। ১৫ বছর বয়সে যখন আমার পৈতে হচ্ছে তখন ই আমি মনে মনে নতুন অতিপ্রিয় বিষয় রসায়নের ( কেমিস্ট্রি) র ফরমূলা মনে মনে আওড়েছি।
আহ্নিক ইত্যাদি করার সময় ও তাইই।
আমার বাবাও আদৌ ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না। আমার মাতৃকুল ঈশ্বরবিশ্বাসী। মা ও মানতেন।
বাবা কে হারাই আমি আমার ২৭ বছর বয়সে। মা, বয়সকালেই প্রয়াত হয়েছেন।
এই বদখৎ অসুখ টি হওয়ার পরে আমি আরোই ঘোর অবিশ্বাসী হয়ে যাই।
আমি জ্ঞানত কারো ক্ষতি চাই নি, ধূমপান করিনি কখনো, এমন বাজে অসুখ হলো আমার। যাক গে, বাদ দিন।

এইবারে পুরী যাওয়া ঠিক হলো। ধৌলি তে ভুবনেশ্বর আর ভাড়া গাড়িতে পুরী। দোলের দিন দুপুরে, ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি ধরবো। দুপুরের রোদের তেজ ভালোই। রং খেলায় আমার অনাগ্রহ শিশুকাল থেকেই। ছোটবেলায় কাকা পিসী মা কাকিমা দের বীভৎস মূর্তি দেখে ভয় আর বিরক্তি আসতো। আমি লুকিয়ে থাকতুম। আমার বয়েসী আর কেউ ছিল না বলে কেউ কখনো জোর করে নি।
সেই ভয় যেন ফিরে এলো রং মাখা মানুষজনদের দেখে। যদি রং মাখিয়ে দেয়।
ভয় অবশ্য অমূলক। উড়িষ্যায় দোলের দিন পুরীর আরাধ্য জগন্নাথ দেব কে আবির দেওয়া হয়, আর তার পর দিন বা হোলির দিন সবাই রং মাখেন।
আমরা প্রায় বিকেল নাগাদ হোটেলে পৌঁছই। বুকিং ইত্যাদি করা ছিল। স্বর্গদ্বার থেকে দূরে, নিউ মেরিন ড্রাইভে। ওদিকে তুলনামূলক ভাবে কম মানুষ তখনো যেতেন।
সপরিবার যাত্রা। একঘরে আমি ও আমার স্ত্রী, পাশের ঘরে আমার কিশোরী কন্যা এবং তার ঠাকুমা।
আমার শর্ত ছিলো মন্দিরে যাবো না। এমনকি মা ও নিজে যান নি। ( সবাইকার ই আগে কয়েক বার যাওয়া অবশ্য)
রোজ বেলা পড়লে সৈকতে বালিতে হাঁটার পালা। অন্ততঃ ৩০ মিনিট প্রতিদিন।
ভারি চমৎকার রান্না করতো ওই হোটেলের পাচকপ্রধান। আমাদের সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গেল।
সেও নিত্যনতুন ভাবে নতুন পদ রান্না করতো। ৫ দিন কাটলো। এবার আবার গোছানোর পালা।
এর মধ্যে দুদিন কাকাতুয়ার দোকানে গিয়ে খাজা ও অন্যান্য মিষ্টি খেয়ে এসেছি অন্ততঃ।
আসার দিনে একটু আগে খেয়ে নিয়ে গাড়ি করে ভুবনেশ্বর। সেখান থেকে আবার ধৌলি ধরে ফেরত।
আগেও যে কবার পুরী গেছি আমাকে চুম্বকের মতো টানতো কোনার্ক মন্দির। অসাধারণ স্থাপত্য। সৌভাগ্যক্রমে আমি জটাধারী শেঠ্ঠি নামে একজন গাইড ( ফরাসি গিদ) কে পেয়েছিলুম। মানুষ টির জটা ছিল না, প্রথাগত বিদ্যাও তেমন ছিল না বোধকরি কিন্তু ইংরেজি, ফরাসি, ইতালিয়, স্পেনীয়, জর্মন, জাপানী ও হিন্দি এবং বাংলায় অসাধারণ দখল। পরে বুঝেছিলুম তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি দিয়ে সে ওইকথা গুলি, যাতে মন্দিরের স্থাপত্য স্বম্বন্ধে ধারণা হয়, সেটি মুখস্থ করেছেন। ফরাসি তে প্রশ্ন করলে উত্তর ও ফরাসি তে। ইতালিয় তে প্রশ্ন করলে উত্তর ও ইতালিয় তে। এই দুটি ভাষার সঙ্গে সবে প্রণয় হয়েছিল আমার। অসাধারণ বললেও কিছুটি বলা হলো না।
পাশের জমিতে নকশা থেকে কি ভাবে মন্দির টির নির্মাণ, তা জটাধারী র কাছে অনায়াস, সাবলীল।
আমাদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা হচ্ছিল। বাংলা বলার সুযোগ পেলে আমি ছাড়ি নে কখনো।
এক্কেবারে সলিড ফান্ডা। ইনি যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেতেন!!
ফিরে খুব ধীর লয়ে সুস্থতা ফিরে এলো অনেক টাই।
এরপরে কেউ কোনার্কের মন্দিরে যেতে চাই শুনলেই তাকে বলে দিতুম জটাধারীর শরণ নিতে।
পরে একবার শুনলুম তিনি আর আসেন না।
আমারো পুরী - কোনার্কের বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবা বন্ধ।
জটাধারী একবার আমার আর আমার উনির একসঙ্গে কর্পুর জ্বালিয়ে পুজো দিয়েছিল, জগন্নাথ দেবের উদ্দেশ্যে। সরল বিশ্বাস কে বাধা দিতে নেই। দিও ই নি। আজও দিইনা।
আমি সমাজ সংস্কারক নই।
গতকাল এবং আজও কয়েক জন কে আসন্ন রোজার সময়ে খাওয়ার নিয়ম বলে এসেছি।
যে যেভাবে ভালো আর সুখী থাকে। একটাই যে জীবন।।
সব্বাইকে দোল ও হোলির আগাম শুভেচ্ছা।।

_________________________

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়