Ameen Qudir

Published:
2019-03-10 19:30:28 BdST

স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করি সুদানের চেয়েও কম, চাই ইউরোপ-আমেরিকার মত সেবা


লেখকের ছবি। এই লেখাটি লেখকের সম্মতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা হল।


অধ্যাপক ডা. সেজান মাহমুদ
__________________


১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে এলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন ছাত্র হিসেবে আমি প্রথম প্রশ্নটি করেছিলাম, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কবে আমরা বাংলাদেশের জন্য পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যনীতি এবং স্বাস্থ্যসংস্কার পাব?’

যদিও এর উত্তর ছিল ‘আমরা অচিরেই তা পাব’ এবং তৎকালীন সরকার এবং পরবর্তী সরকার স্বাস্থ্য খাতে কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত সংস্কার রয়ে গেছে সুদূরপরাহত। ১৯৯৬ সালে এই প্রশ্নটি ছিল সময়োপযোগী প্রশ্ন, এখনো তাই আছে। এই নিয়ে প্রথম আলোর আমন্ত্রণে বিশেষ আয়োজনে লিখেছিলাম ২০১৩ সালেই। স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের প্রশ্নটির সঙ্গে একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অনুপাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের একটি চিত্র উঠে এসেছে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনটি গত ৮ মে প্রকাশ করা হয়। এতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রথম আলো রিপোর্টে লিখেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করত। সেটা সর্বশেষ বাজেটে কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে এসেছে। এর মানে হলো, দেশের জিডিপির আকার বেড়েছে। সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। ফলে জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্যে ব্যয় কমেছে। প্রতিবেদনে ৪৮টি দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশই এত কম হারে ব্যয় করে না। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৯ শতাংশের বেশি ব্যয় করে।

যদিও প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে পরিস্কার বোঝা যায় না যে সরকারি বাজেটের বরাদ্দ জিডিপি’র ০.৯২ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে আর সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় এক কীনা। কারণ, ২০১৫ সালের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় জিডিপি’র ২.৬৪ শতাংশ। যদিও তা পৃথিবীর উচ্চ-আয়ের দেশ তো দূরের কথা, এমনি কি দরিদ্র দেশ হিসাবে পরিচিত সুদান বা ইথিওপিয়ার চেয়েও কম। সরকারি বরাদ্দ আর সামগ্রিক ব্যয়ের মধ্যে যদিও পার্থক্য থাকে, যেমন সামগ্রিক ব্যয়ে সরকারি বরাদ্দ, প্রাইভেট সেক্টর, আন্তঃসেক্টর ইত্যাদি নানান খরচ জড়িত থাকতে পারে। একটু নজর দেয়া যাক ২০১৫ সালের তথ্য অনুসারে।

স্বাস্থ্যখাতে পৃথিবীর কোন দেশ কতো ব্যয় করে? জিডিপি’র হিসাবে
আমেরিকা : ১৬.৮৪%
জার্মানি: ১১.১৫%
জাপান: ১০.৮%
আফগানিস্তান: ১০.২%
ব্রাজিল: ৮.৯১%
ইথিওপিয়া: ৪.০৫%
বাংলাদেশ: ২.৬৪%
ধনী-গরীব সব মিলিয়ে দেখলেও বাংলাদেশ পেছনে। মধ্য-আয়ের দেশ গড়ে ৫.৩৬% খরচ করে। এমনকি হতদরিদ্র সুদান ব্যয় করে ৬.৩১%।

আমরা আগাচ্ছি স্বাস্থ্যসূচকে, আয়ের দিক থেকে, প্রযুক্তিতে; তাহলে কেন স্বাস্থ্যব্যয়ে আগাবো না?
তবে যাই হোক, যেই সূচকেই বিবেচনা করি না কেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ এবং ব্যয় দুই-ই একেবারে নিম্নস্তরে।

আমরা ব্যয় করবো সুদান বা ইথিওপিয়ার কম আর সেবা আশা করবো আমেরিকা বা সিঙ্গাপুরের মতো তা কিন্তু ঠিক নয়। অথচ আমাদের চিকিৎসকেরা সুযোগ পেলে, ট্রেইনিং পেলে, যন্ত্রপাতি পেলে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এজন্যেই আমাদের ধনী ও ক্ষমতাশীলেরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। মরে শুধু নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষেরা। এই স্বাস্থ্য-বৈষম্য দূর হোক। সরকার নিশ্চয়ই বড় পদক্ষেপ নেবেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের এই দাবী জানাই।

লেখক সেজান মাহমুদ :
পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি লেখক, গীতিকার ও কলামিস্ট হিসেবেও খ্যাতিমান। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন এবং অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন শাখার আরলি ক্যারিয়ার পুরস্কার, আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ এমএসআই ফ্যাকাল্টি স্কলার এওয়ার্ড পেয়েছেন দু দু’বার। ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএইচ এবং বার্মিংহাম থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সাহিত্যে প্রকাশিত গ্রন্থ ২৮টি, এ ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক জর্নাল আর্টিকল, নিবন্ধ, ইত্যাদি ছেপেছেন পঞ্চাশেরও অধিক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়