Ameen Qudir

Published:
2019-03-10 06:36:30 BdST

কাহিনিসব নীরবতা ভেঙে খানখান করে এক্সিডেন্টের দুঃসংবাদটা এসেছিল


 

জীবনের এই এক নারীকে নিয়ে । চরিত্রটির একটি প্রতিকী মডেল ছবি।

ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী
____________________________

সেই কাক ডাকা ভোর থেকেই মিহি সুরে সানাই বাজছে।এমন বুক ভাঙা করুন কান্নার সুর সানাই এ।তবু বিয়ের দিনে সানাই কেন বাজে?যত শুনছি ততই হাহাকার করছে মন।

আজ সানাই বাজছে।আজ আমার বিয়ে।
বেলা করে ঘুমোতাম বলে এমন কুসুম নরম আতুঁড়ে ভোর টা আমার দেখা হতো না।আশফাক কতদিন জোর করে ঘুম ভাঙিয়ে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে যেত আমাকে।ঘুম চোখে সকাল দেখতাম।

ও মারা যাবার পর থেকে এমন সকাল আমি রোজ ই দেখি।আসলে কি দেখি,না নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকি? এমন এক কাক ডাকা ভোরেই বেজেছিল ফোনটা।সব নিরবতা ভেঙে খানখান করে এক্সিডেন্ট এর দুঃসংবাদ টা এসেছিল।সেই থেকে ঘুমহীন দুঃস্বপ্নের জীবন যাপন।

জানালা থেকে চোখ ঘুরাতেই আমাদের চার বছরের ছেলে রাহুল।

সে কি জানে আজ কি ঘটতে যাচ্ছে তার ভাগ্যে?দেবশিশুর মতো দেখতে ছেলেটি।আশফাকের চলে যাবার সময় ওর বয়স ছিল দেড় বছর।আশফাক তো জেনে ও গেল না যে,তার আদরের রাহুল নির্বাক।

আমার বাবা রাশভারী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তার নয় সন্তানের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ মেয়ে টিকে বন্ধুর একমাত্র পুত্র সদ্য পাস করা ডাক্তার বাবুর সঙ্গে বিয়ে দিলেন।

আমি কালো বলে বাড়ির বুড়োরা বলত আমার জন্য বর পাওয়া যাবে না।আর বিয়ের দিন চোখ তুলে দেখলাম যেন দুনিয়ার সুন্দরতম ছেলেটা আমার বর।হাসিখুশি ভালোবাসা বাসির চারটা বছর যেন চোখের পলকে হারিয়ে গেল।

আশফাকের মৃত্যুর পর রাহুল কে যেন বুকের মধ্যি খানে বসিয়ে নিয়েছি।অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে একটু বড় হবে। আমার শূন্য বুক টা মা মা ডেকে ভরিয়ে দেবে।

নাহ।তা হলো না। রাহুলের বয়সী সব বাচ্চা কথা বলছে, খেলছে।আমার পিতৃহীন ছেলেটা। চুপচাপ। নির্বাক। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না।শিশু চিকিৎসক দেখলেন।নাক কান গলার চিকিৎসক কত শত পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন।তারা নিশ্চিত করলেন রাহুল শুনতে পায় না। কথা ও বলতে পারবে না।
সব শুনে বাবা এসে তার বাড়িতে নিয়ে এলো আমাদের। সফল বিচারপতি আমার বাবা নিস্ফল আক্রোশে ছটফট করতে লাগলেন। তার ঘরে মূক বধির নাতি!

আশফাকের মৃত্যুতে ভেঙে পড়া সবার আদরের আমি এবার যেন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম। এত দুঃখ ধারনের শক্তি আমার নাই।

বাবার এক কৃতদার জুনিয়র এর সাথে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। একটাই শর্ত। তিনি কেবল আমাকে নিয়ে রাজধানীতে পাড়ি জমাবেন।রাহুল কে নেবেন না।
আশফাকের বাবা মা ও তাদের একমাত্র ছেলের একমাত্র নাতিকে কোথাও যেতে দিবেন না।
রাহুল কি সানাইয়ের করুন সুর টা শুনতে পাচ্ছে?

এই সুর যে ওর চার বছরের পিতৃ স্নেহ বঞ্চিত ছোট্ট শরীর টাকে ওর মায়ের থেকে ও অনেক দূরে সরিয়ে নেবে।
আমার হবু বর বিলেতে সেটেল করতে চান। আজ বিয়ে করে ও বাড়িতে যাবার পর আমার কপাল থেকে অকাল বিধবা বা পোড়া কপালী নাম গুলো চিরতরে ঘুচে যাবে।স্বামী সোহাগী হয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবো, এগুলোই বুঝিয়েছেন বাবা আমাকে।

স্বল্প শিক্ষিত পরনির্ভরশীল বিধবা আমি।একটা অপরূপ নির্বাক পিতৃহীন ছেলে সন্তানের মা।
রাহুল কথা বলতে পারে না বলে সারাটা ক্ষন আমার আঁচল ধরে থাকে।

ওর চাহিদা গুলো ও ইশারা তে প্রকাশ করে।কেউ বুঝতে পারে না আমি ছাড়া।

তাকিয়ে আছি আমার সন্তানের ঘুমন্ত নিষ্পাপ শান্ত মুখের দিকে।ও জানে না ঘুম ভাংতেই ওর পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হবে।
এত বড় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে শারীরিক মানসিক ক্রটি নিয়ে জন্ম নেয়া বাচ্চা গুলোকে পৃথিবীর বুকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাবা মা দুজনকেই যোদ্ধা হতে হয়। ওর বাবা হারিয়ে গেছে। আজ ওর একমাত্র আশ্রয় মা তার জীবনে চলে যাচ্ছে। নিষ্ঠুর জীবন পথের বাঁকে একা নির্বাক রাহুল।

সানাই বাজছে।আজ এ বাড়িতে বিয়ে।
বাইরে একটু করে আলো ফুঁটছে।
- আপা আজ ও ঘুমান নি?
ফুলির ডাকে চমকে তাকালাম।
- আজ কি ঘুম আসে পাগল।আজ আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে যে!

আজ থেকে বাইশ তেইশ বছর আগে এমনি সানাইয়ের সুরের মাঝে ঘুমন্ত রাহুল কে বুকে নিয়ে নিজের বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলাম আমি।
এক বাবা আমাকে মনে মনে ত্যাজ্য করল আর এক বাবা তার নাতি সহ বুকে জরিয়ে নিল।

রাহুলের দাদা দাদী আর আমি তিন জন মিলে যুদ্ধ টা শুরু করেছিলাম।অসম্পূর্ণ রাহুল কে সম্পূর্ণ করার যুদ্ধ।
ওকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলা।সমাজে চলতে শেখানো।উপযুক্ত শিক্ষা।তার সাথে চিকিৎসা।

কথা বলা ছাড়া রাহুল এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে।
বাবা মা বহু বার বলেছে আমাকে বিয়ে করে নিজের মতো বাঁচতে।
নিজ বাড়ির আঙিনাতেই গড়েছি শ্রবন নামক মূক ও বধির স্কুল।
শত শত অসহায় শিশু বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা পাচ্ছে সেখান থেকে।
পিতৃ মাতৃহীন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য করেছি আশা নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
রাহুল চমৎকার গিটার বাজায়।গিটারের স্কুলেই তৃপ্তির সাথে পরিচয়। বন্ধুত্ব।
রাহুল এবং আমি অনেক বুঝিয়েছি।তৃপ্তি রাহুলকেই বিয়ে করবে।
রাহুল এখনও ঘুমিয়ে।নিষ্পাপ,অপরূপ এক মুখ।অবসর জীবনে দাদাজানের গড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্নধার এখন রাহুল ।আমার স্কুলের ও একজন সে।তার একটা গিটার শেখার স্কুল ও আছে।

আমার আর রাহুলের মাঝেই বেঁচে আছে আশফাক।আমার সেই কিশোরী বয়সের ভালোবাসা,নারী হয়ে ওঠা,মা হয়ে ওঠার সেই দুর্বার অনুভূতি গুলো ঘেরা এই বাড়িতে আজ এক শিক্ষিত মিষ্টি মুখের তরুনী বৌ হয়ে আসবে।

সানাই বাজছে। সানাইয়ের সুর টা আজ আর তাই করুন লাগছে না।যেন শত আনন্দের ঝর্ণা ধারা হয়ে অবিরাম বাজছে সানাই।
_____________________________

ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী
বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়