Ameen Qudir

Published:
2019-02-12 23:48:37 BdST

Curry: A Tale of Cooks and Conquerorsমোগলাই খানা এবং বাবুর


 

 

অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
___________________________

প্রথম মোগল বাদশা ছিলেন বাবুর। বাবুর অর্থ বাঘ। এই বাদশা ছিলেন অষ্টম হেনরির সমসাময়িক।

বাবুর বাদশা হিন্দুস্তান বিজয়ে তেমন উৎফুল্ল ছিলেন না। “হিন্দুস্তানের কোন আকর্ষন নেই”, তিনি লিখে গেছেন, “শহর গ্রাম দুটোই ভারি বিশ্রী। আমাদের সাথে তুলনা করলে এ এক পুরোই আলাদা বিশ্ব, সিন্ধু নদী পেরোলেই মাঠঘাট গাছ ফুল পাত্থর মানুষ আদব লেহাজ সবই জানি ক্যামন ক্যামন। লোকগুলি মোটামুটি ল্যাংটোই ঘুরে বেড়ায়, কোমরের কাছে কি একটা ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো। মানুষগুলি দেখতে ভারি কুচ্ছিত, সমাজে কোন আভিজাত্য-ফাত্য নেই।” তবে হিন্দুস্তানের একটা ভাল দিক হল “দেশটা বিরাট আর সোনামাণিকও প্রচুর”।

বাবুরের একটা বিরাট অভিযোগ ছিল যে হিন্দুস্তানের খাবার একবারে যা-তা। “একটাও ভালো খাবার নাই, মাংস আঙুর তরমুজ খরমুজ কিসসু না। কোন বরফ নেই, ঠান্ডা জল নেই, বাজারে রুটি নেই।” বাবুরের দেশে লোকজন মহা আয়োজন করে খেত, বাগদাদ হতে প্রকাশিত অনেক পুরাতন একটি মুসলিম রান্নার বইতে লিখা আছে খাওয়া হল ছয়টি আনন্দের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বমহান (অন্য পাঁচ আনন্দ হল পান, কাপড়, রতি, আতর আর বাদ্যবাজনা)।

সমরকন্দে হেরে যাবার পর নানান পাহাড়পর্বতে থেকে থেকে বাবুরের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তিনবেলা যাযাবর ঘোড়সওয়ারদের মতন মাংস খাওয়ার। এই মাংস রান্না হত অতি সহজে ক্যাম্পফায়ারে বসে ঝলসে। কাঠিতে গাঁথা টুকরো টুকরো ভেড়ার মাংস(কাশ্মীরে এই খাবার তুজ নামে পাওয়া যায়)। হাত দিয়ে খুলে খুলে খেতে হয় সেই মাংস। সেই মাংসের রেসিপিঃ

প্রথমে চর্বি গলানো হয় (সাধারনত ভেড়ার লেজের চর্বি) একটা পাত্রে, আর গলামাত্র তাতে ঢালা হয় ছোট টুকরা ভেড়ার মাংস। অল্প ভাজা হয়ে এলে পরে, তিন আঙুল পরিমান জল ঢালা হয় আর ধীরে বুদবুদ ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। মাংস নরম হয়ে আসার পর গোলমরিচ আর ফালি করে কাটা গাজর যোগ করা হয়, আর সবার ওপরে একস্তর চাল। আরেকটু জল যুক্ত করা হয়, আর চাল ফুটে ভাত হওয়া মাত্র আগুনের ধাক কমিয়ে আনা হয়। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে পাত্রটি রেখে দেয়া হয় গরম কয়লার উপর, ভাপে আরো সিদ্ধ হয় মাংস, ভাত আর গাজর। আধঘন্টা পরে খাবার পরিবেশিত হয় স্তরে স্তরে। সবার তলে চর্বিতে মাখামাখি ভাত, তার উপর গাজর আর সবার উপরে মাংস।

বাবুর হিন্দুস্তানে আসতে আসতে ভারত অনেকাংশে নিরামিষভোজী হয়ে গেছে। সেই সময় গরুর মাংস খাওয়া ছিল এক বিরাট পাপের ব্যাপার। আয়ুর্বেদিক বইপত্রে গরুর মাংসকে “ভারি, গরম, তৈলাক্ত আর মিষ্ট” বলে অভিহিত করা আছে। এটি হজম করতে সময় লাগে বলে সাবধানবাণীও রয়েছে। পিছনে ফিরে আমরা যদি প্রথম শতাব্দীতে তাকাই, দেখি যে ভারতীয়রা ছিল নিয়মিত গরুখোর। মহাভারতে এমনকি বলা আছে ব্রাহ্মণেরা ভারি মজা করে গরুর তরকারি খাচ্ছেন, যদিও সেখানে আরো বর্ণনা আছে একটি গরুর যে কিনা তার আত্মীয়স্বজনদের ভয়ানকভাবে কেটে কুটে খেয়ে ফেলার জন্য অভিযোগ করছে।

বাবুর যে হিন্দুস্তান জয় করেন সেখানে গরু ছিল মহাপবিত্র প্রাণী। তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে এরা যে শুধু গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তাই নয় এরা গরুর বিবিধ প্রডাক্ট যেমন দুধ, মাখন, গোবর আর চোনা মিশিয়ে শরবৎ বানিয়ে খাচ্ছে সকল রোগশোকপাপতাপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে। তিনি বিতৃষ্ণা নিয়ে দেখেন যে ভারতীয়রা দুই হাতে চোনা ঢেলে খাচ্ছে আর সর্বাঙ্গে গোবর ঢেলে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করছে।

তাই মোগলের গরুখাসী খাওয়ার বাসনার সাথে সাধারন ভারতীয় খাবারের লাগল ধাক্কা। মুসলমানদের কাছে খাবার দারুন পবিত্র ব্যাপার, তাদের কুরানে বেহেস্তের খাবারদাবারের বিস্তর বর্ণনা। আর ভারতীয়দের কাছে খাবার আমোদের কিছু ছিলনা, পেট ভরলেই হল এই তাদের মনোভাব। ভালো ভালো খাবার দেবতাদের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হত, বাকিরা খেত প্রসাদ। ঘরের কর্তাকেই মাছের মুড়োটি প্রদান করা হত, গিন্নীর পালা সবার শেষে।

কিন্তু বাবুর বাদশা বাজারের খানাখাদ্যে তুমুল বিরক্ত ছিলেন, তিনি ঠিক করলেন চারটে হিন্দুস্তানী বাবুর্চি রাখা হবে। এদের কান পাকড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল পরাজিত সুলতান ইব্রাহীম লোদির কিচেন থেকে। এই সিদ্ধান্তে পরে মহা পস্তান বাবুর। তার জীবনীতে তিনি লিখে গেছেন তিনি এক শুক্কুরবার সন্ধ্যায় খরগোশের স্টু আর জাফরানী কেতায় রাঁধা মাংস তেলেভাজা চাপাতি দিয়ে খেয়ে ভক করে বমি করে দিয়েছিলেন। খাবার বিষাক্ত, এই সন্দেহে তিনি একটা কুকুরকে সেই বমি খাওয়ান। কুকুরটিও বমি খেয়ে বমি করে দেয়।

পরে ধরা পড়ে যে পরাজিত সুলতানের মাতার ঘুষ খেয়ে চারটে বাবুর্চির একজন মাংসে বিষ মিশিয়ে দেয়। এই বজ্জাতিতে যুক্ত ছিল আরেকটি লোক, সম্রাটের নিজস্ব টেস্টার যে কিনা খাবারে বিষ পরীক্ষা করত। টেস্টারকে কেটে পঁয়ত্রিশ পিস করা হয়, আর বাবুর্চিকে জীবন্ত অবস্থায় তার গায়ের চামড়া ছিলে ফেলা হয়।

*************************************************
(হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না) এক হিন্দু রাজার ভোজন বিলাসঃ

একটি চমৎকার দরবারী হিন্দু খানার রেসিপি রেখে গেছেন দ্বাদশ শতাব্দীর রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর। তিনি পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন, বর্তমান মহারাষ্ট্র আর কর্নাটক অঞ্চলে। তিনি যুদ্ধটুদ্ধের বদলে চিত্রকলা বা সাহিত্যে আগ্রহী ছিলেন । রাজ্যের বিবিধ কর্নার যখন বেহাত হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি যুদ্ধে যোগ দেবার বদলে বই লেখা শুরু করেন। বইয়ের নাম “মানোসোল্লাস”। বইতে একজন রাজার দৈনন্দিন ব্যাপারস্যাপার অর্থাৎ শিকার, রমণ, হীরেমোতি, ডুলিপাল্কি, রাজকীয় ছাতা আর খাবারের বর্ণনা ভরা।

সোমেশ্বর লিখে গেছেন যে রাজার প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর আর পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। যেমন ঝাল দৈ এ ডুবিয়ে ডালের বড়া, এলাচ দিয়ে ভাজা শুকরের মাংস, অথবা ঝলসানো লেজ। সোমেশ্বরের অন্যান্য কিছু প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল কচ্ছপ ভাজা (খেতে নাকি ভাজাকলার মতন) আর ঝলসানো ধেড়ে ইঁদুর। পাঁচ শতক পরেও এই খাবারের অভ্যাস হিন্দু রাজাগণের ছিল, দক্ষিণের বিখ্যাত বিজয়নগরের বাজারে ভেড়া, শুকর বা গরুর মাংসের পাশাপাশি পাওয়া যেত চড়ুই পাখি, ইঁদুর, বিড়াল আর টিকটিকি গিরগিটির মাংস।

সোমেশ্বর বর্ণিত ঝলসানো ধেড়ে ইঁদুরের রেসিপিঃ

কালো ধেড়ে ইঁদুর, যেগুলো মাঠে আর নদীর ঘাটে ধরা হত তার নাম ছিল মাগ্যা। এগুলির গায়ের রোম ছাড়িয়ে গরম জলে ধুয়ে ঝলসানো হত লেজশুদ্ধ। তবে তার আগে পেট কেটে ভেতরের প্রত্যঙ্গাদি বের করে আনা হত, ওগুলি পৃথকভাবে কাঁচা আম আর নুন সহযোগে রেঁধে পেটে পোরা হত।এরপর ইঁদুরকে লোহার শিকে ঝলসানো হত কয়লার আগুনে, যতক্ষন না তা বাদামী রঙ ধারণ করত। ভালোমত ভাজা হয়ে গেলে পরে তার উপর নুন, জিরে দিয়ে খাওয়া হত

( লিজি কলিংহ্যাম রচিত Curry: A Tale of Cooks and Conquerors এর কিছু অংশের ভাবানুবাদ )
______________________

অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস। কবি। চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়