Ameen Qudir

Published:
2019-02-12 08:24:28 BdST

আর আমি এরকম ভাবেই বেঁচে আছি , তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ


 

 

দেবব্রত তরফদার
_____________________

এটা আমাদের অনেকের প্রিয় কবি সুনীলের একটি কবিতার লাইন । কেমন আছি আমরা ?অনেক সময় পেরিয়ে গেল জীবনের । এখন মনে হচ্ছে বার বার জীবনটা বড্ড ছোট । বহুদিনের পুরোনো ঘটনাকে মনে হয় এই তো সেদিন ঘটলো। কি পেলাম জীবনে এইসব সালতামামি না করে যদি প্রশ্ন করি কেUমন আছি ? তাহলে কি উত্তর দেবে জীবন ?
ষাটের দশকের প্রথমে যাদের জন্ম আর যাদের স্মৃতি সবল , যারা গ্রামে থাকতো তাদের মনে আছে হয়তো ষাটের দশকের শেষভাগে খাদ্যাভাব , ভাতের বদলে ভুট্টা , যব , মাইলোর আটার রুটি , একাত্তরের বন্যা বাংলাদেশের শরণার্থীর আগমন , মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ফাইটার প্লেনের শব্দ । রেডিওতে ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ আর সব ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠস্বর । শহরে যারা থাকতো তারা আঁচ পেয়েছিল নকশাল নামে একদল সতেজ নির্ভীক যুবকের জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের আর নুতন ভারত গড়ার স্বপ্ন । মিটিং মিছিল কারফিউ । বিপ্লব দমনের নামে সরকারের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন । মৃত্যু আসে চুপি নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে, কখনো বা হানাদারের মতো দিনের আলোতে। কেন্দ্রে দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন । কখনো ইন্দিরা গ্রেপ্তার হন কখনো বিপুল ভোটে ফিরে আসেন । কখনো কেউ দু এক বছর , বা দুচার মাস অথবা কিছুদিনের জন্য দিল্লির মসনদে । সেই আগের সুলতানি বা মুঘলদের শেষ সময়ের মত । ঘটে যায় দুটি বড় রাজনৈতিক হত্যাকান্ড । রাজনীতির খেলা জিইয়ে রাখে জাতপাত । অসহিষ্ণুতা আর অস্থিরতায় কখনো বলি মুসলিম , কখনো হিন্দু কখনো শিখ ।

ছোটবেলায় দেখেছি খেলার সাথীরা কখনো না খেয়ে কখনো আধপেটা খেয়ে খেলতে আসে স্কুলে যায়। গুপ্তধনের মত খুঁজে বেড়ায় গাছের পেয়ারা আম তেঁতুল । পুড়িয়ে খায় মেটে আলুর ফল , চুষে খায় চিতে গাছের লাল ফুল। আমাদের এই অবস্থা না থাকলেও এদের সঙ্গী হয়েছি। অনেককেই দেখেছি দিনের শেষে মায়ের কাছ থেকে চাইতে আসে ছোট ভাইয়ের জন্য দুমুঠো ভাত । তাদের জন্য বরাদ্ধ ভুট্টার সুজি , নুন দিয়ে সেদ্ধ করা কিন্তু ছোট্ট ভাইটি অবুঝ ভাতের জন্য বায়না করে। সত্তরের প্রথম থেকে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব পড়তে থাকে । দু একটি করে ঢুকতে থাকে কুপার , ইনডেক কোম্পানির শ্যালো মেশিন । প্রথমে নদী থেকে জল তুলে পরে শ্যালো টিউবয়েল বসিয়ে । ডিপ টিউবয়েল , রিভার পাম্প তারও পরের গল্প। আমরাও ঠাকুর দেখা মত দলবেঁধে ছুটি কোথায় জল দেওয়া হচ্ছে তা দেখতে। নদিয়ার গ্রাম গুলোতে গমের চাষ শুরু হয় যা আগে হয়নি। আগের ছোট দানার বদলে বড় দানার সোনালিকা , সোনারা গম। শুরু হয় বোরো চাষ প্রথম নাম শুনি আই আর এইট ধানের । তারপর আরো কতো কি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে থাকে । নকশাল আন্দোলন দমন , জরুরি অবস্থা কাটানোর পর গ্রামে জোরদার হতে থাকে বাম দলগুলির প্রভাব । ১৯৭৭ এর আগে থেকেই অখ্যাত গ্রামগুলো জেনে যায় জ্যোতি বসুর নাম। ইলেকশনের আগে সদর মফস্বলের জ্যোতিবাবুর ভাষণ শুনতে হাজার হাজার লোক তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের মতো স্কুল ছাত্ররাও । ৭৭ রে ঘটে বিপুল পরিবর্তন। পরবর্তীতে অপারেশন বর্গার প্রভাব পড়ে কিছুটা । যদিও তর্জন গর্জন যতটা বাস্তবে তা নয়। ধীরে ধীরে অর্থনীতির পরিবর্তন হয় , পরিবর্তন হয় মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ভোগ কাঠামোর । বাড়ে স্কুল পড়ুয়ার সংখ্যা । অশিক্ষিত চাষাও বুঝতে শেখে পড়ার , স্ত্রী শিক্ষার মর্ম। প্রাইমারি নিড মেটার পর দ্রুত জায়গা নেয় বিনোদন । প্রথমে রেডিও পরে টেপ রেকর্ডার টেলিভিশন , ভি সি আর , ভিসিপি , ভিডিও হল , সিনেমা , সিডি , ডি ভি ডি , কম্পিউটার , মোবাইল , ল্যাপটপ । আর শেষ পর্যন্ত সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে স্মার্ট ফোন। মানুষকে বিনোদন মুখী আর একই সঙ্গে সক্রিয় ও অকর্মণ্য করেছে স্মার্টফোন আর পৃথিবীব্যাপী বৈদ্যুতিন বেড়াজাল। । প্রধান মন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পর গ্রাম শহরের মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে । পরবর্তীতে কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ঘটে দ্রুত বিপ্লব । গ্রাম শহর এখন প্রায় এক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নিবিড়তা শেষ করতে প্রথম দায়িত্ব নেয় টেলিভিশন , তার সিরিয়াল দুনিয়ার মাধ্যমে । এ ব্যাপারে একদিনের ক্রিকেট , টি 20 , বিশ্ব ফুটবল , আই পি এল এর ভূমিকা কম নয়। তবে কফিনে শেষ পেরেকটি পুতলো বোধহয় স্মার্টফোন । মাদকাসক্ত জাতির যেমন মেরুদন্ড ভেঙে যায় এও তা , তাতে রাজা আরো প্রজা শোষণের সুবিধা পায় । এও তা । আরাম আর ভোগসর্বস্বতা এখন মানুষের জীবনদর্শন। যা মানুষকে করছে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর অলস ।

দীর্ধদিনের বামজমানায় তেনারা ভেবেছিলেন যে তাঁরা অজর , অমর , অপ্রতিরোধ্য । শিকড় অনেকদূর চারিয়ে গেলে বোধহয় গাছ ওপড়াই না ঝড়ঝাঁপটায় কিন্তু অহংকার , আত্মশ্লাঘা আর স্বার্থের বেনোজল যে মহীরুহ টিকে ফোপড়া করে দিয়েছিল সেটা বোধহয় টের পাওয়া গেল হুড়মুড় করে মহীরুহটির পতনের পর । রাজ্যে ওয়ান ম্যান আর্মি । স্থায়ী মূলধন গঠন পরিকল্পনার বদলে শুরু হয়ে গেল দান খয়রাত , স্বজনপোষন , মেলাখেলা , আনন্দ অনুষ্ঠান , বাকসর্বশ্বতার রাজনীতি । জমা পড়ে গেল কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক শিল্পীর কলম আর রংতুলি । খর্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতার ।দলদাসেরা পোঁ ধরে আছে সানাইএর , ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কেন্দ্র রাজ্য সরকার চিৎকার করে গলা ফাটায় বেকারদের জন্য লক্ষ কোটি চাকরি। কেউ কেউ স্টেজে উঠে হিসেব দেয় । রাজ্যে এক বছরে দশ লাখ চাকরি , মানে সিভিক , গ্রীন , আরো বিভিন্ন রংবেরং এর পুলিশ আর চুক্তিবদ্ধ কর্মীর দল । নেত্রীর মুখ থেকে কোনো কথা খসা মানে শুরু হয়ে গেল তার ইমপ্লিমেন্টেশন । বিষমদে মৃত্যু টাকা , ইমাম ভাতা , বেকার ভাতা , ক্লাবের উন্নয়নে টাকা , মসজিদ সংস্কার , কন্যাশ্রী , যুবশ্রী , রূপশ্রী , নীল সাইকেল , জুতো , বই খাতা , বন্যা তাড়িত , খরা তাড়িত , দুগ্গা পূজা । এই টাকার সঙ্গে এক শতাংশ মূলধন গঠনের সম্পর্ক নেই । রাজ্য সরকারি চাকরি ? বিজ্ঞাপন বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে টাকার কন্ট্রাক্ট , পরীক্ষায় প্রহসন , খোলাখুলি স্মার্টফোনে উত্তর । ব্যাপারটা এতটাই নেকেড যে মনে হয় এটাই যেন নিয়ম। আর যারা লেখাপড়া করে আসলে ? তাদের কি হাল ? এক ছাত্র শেষ সম্বল দশ কাঠা জমি বিক্রি করে দুই ভাইবোন বি এড করলো অঙ্কে এম এস সি করে। তাদের কথা কে ভাবে ? মুখ থেকে খসলো ইন্টার্ন শিক্ষক । পড়াবে সবে পাস করেছে যারা , উদ্দেশ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার । শুরু হলো অবাস্তব চিন্তা বাস্তবায়নের তোড়জোড় । এইমাত্র আমার অঙ্কে অনার্স ছাত্র স্বাধীন পালের বক্তব্য -- একটা যে কোনো চাকরির পাবার পর প্রথম কাজ বি এড এর মার্কশিট ছেঁড়া । কে শুনবে এদের কথা । যাদের শোনানোর জন্য ৩৪ বছর রাজত্ব করা বামফ্রন্ট কে ছুঁড়ে ফেলেছিল জনগন তারা এখন মেলা খেলা সাহিত্য চর্চা এ সবেই ব্যস্ত। স্বপ্ন দেখিয়ে আর একজনের দিল্লির মসনদ লাভ , তার পরেই কালো টাকার উদ্ধারে বড় নোট বাতিল । জনগণ থাকলো সঙ্গে আর তারপরেই যা হবার তা । মাঝখান থেকে সুবিধা পেল কালো কুমিরেরা । মাঝখান থেকে ছোট ব্যবসায়ীদের মাজা গেল ভেঙে । তাদের কথা ভাবার কে আছে । ছোট বড় সবার উদ্দেশ্য যেন যেন প্রকারেন স্থায়ী ভাবে গদি আঁকড়ে থাকা । তারজন্য রাজ্যে চলছে মুসলিম তোষন কেননা ৩৪% ভোটার সঙ্গে থাকলেই মার দিয়া কেল্লা । কেন্দ্রে সঙ্ঘ আর কট্টর হিন্দুদের খুশি করার চেষ্টা । কিন্তু এইসব নীতির ফলে অমিত আর আবুবক্কর যারা পাশাপাশি কাটিয়েছে কয়েক প্রজন্ম ধরে সব সময়ের সুখ দুঃখের সঙ্গী , তারা পরস্পরের দিকে খোলা চোখে তাকাতে পারেনা কেন ? তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কেন আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে ? তার হিসেব কে করে । ভবিষ্যতে আরো কি হবে ? কিভাবে সুস্থ জীবন যাপন করবে পরবর্তীতে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য ব্যাংক জাতীয়করণ ঘটলো। ব্যাংকের শাখা বিকেন্দ্রিকৃত হলো । আমানত বাড়লো বহুগুণ। সুবিধা কারা পেল ? না আপামর জনসাধারণ । কিন্তু ক্ষুদ্র চাষী , ক্ষুদ্র ব্যবসাদার , জনমজুর খেটে খাওয়া লোকেরা কি সুবিধে পেল ? ভবঘুরে , যাযাবর , ফুটপাথবাসী যদিও তাদের সংখ্যা কয়েক কোটি তবুও তাদের কথা বাদই দিলাম , তাদের অনেকেরই আইডেনটিটি নেই ।তারা তাহলে মানুষের পর্যায়ে পড়েনা । কোনো রাজনৈতিক দল কোনো নেতা হাতাকে তাদের সম্পর্কে একটি শব্দ খরচ করতে শুনিনি । তা সেই বাম হোক আর ডানই হোক। ব্যাংক এর অন্য অর্থলগ্নি সংস্থা আছে সেই ধনীদের জন্যই । রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো দালালদের দ্বারা পরিচালিত । কর্নধারেরা পয়সাকড়ি খেয়ে এমন ব্যক্তি আর সংস্থা কে লোন দেয় যে অনেক ব্যাংকে তার অর্ধেক রিকভারি হয়না । টানাটানি চলে শুধু ছোট ব্যবসায়ীদের উপর । সবুজ বিপ্লবের মধু এখনো চেটে চলেছে । নার্ক্স আর লুইস সাহেবের মডেল অনুসারে কৃষির প্রচ্ছন্ন বেকার যাদের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা শূন্য তাদেরকে কৃষি থেকে শিল্প ও সেবক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করা হলে একাধারে কৃষি এবং শিল্পের উন্নতি ঘটবে , মূলধন গঠন হবে , জাতীয় ও মাথাপিছু আয় জীবনযাত্রার মান বাড়বে। ভারতের কৃষিক্ষেত্রে ছদ্মবেশী বেকারের অভাব নেই। পেটের টানে গ্রাম থেকে দলে দলে শহরে চলে আসছে লোকজন , ছড়িয়ে পড়ছে দেশে বিদেশে কিন্তু চাষীর উন্নতি কই ? কোনো সরকারই এতদিন পর্যন্ত সঠিক মূল্যনীতি নির্দ্ধারন করেনি । তাই চাষী ফসল বেচে তিন টাকায় , ভোক্তা কেন তিরিশ টাকায় আর লাভের গুড় খায় মধ্যবর্তিরা। দেশের কোথাও পঞ্চাশ পয়সায় পেঁয়াজ বেচে চাষি আত্মঘাতী হয় কোথায় পেঁয়াজ তখন কুড়ি টাকা কিলো। আর দুই জায়গার পরিবহন ব্যয় কেজিপ্রতি এক টাকা। বড় ব্যবসাদারের প্রভাবে চুনপুটি শেষ এরা এখন কৃষিতেও থাবা বসাতে চলেছে । চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে সরকারি কর্মচারী বাদে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের মধ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যারা নিযুক্ত তাদের বাঁচার পথ নেই। একটু সুযোগ থাকলেই সেখানে হাজার হাজার লোক ।
এই লেখা লিখতে লিখতে বাজেট পেশ হলো। কর ছাড় দিয়ে মন কাড়লো । ছ লাখ টাকা আয়ের লোকও করের আওতার বাইরে । ভাবা যায় । কিন্তু আর চাষীদের মাসে পাঁচশ টাকার ভিক্ষা । তাও ভাগচাষী কৃষিমজুরেরা এর বাইরে । তরুণদের আশার আলো নেই , নেই কোনো নিয়োগ বাড়ানোর গল্প । থাক তোরা নিঃসীম অন্ধকারে । আমরা খাই দুধভাত তোদের পিটুলীগোলা না পাবার দিন এসে গেল।।
_____________________

লেখক দেবব্রত তরফদার। শক্তিমান কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়