Ameen Qudir

Published:
2019-02-07 23:35:35 BdST

করণীয়প্রিয় মানুষ বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে লিপ্ত হলে করণীয়


 


ডা. মো. সাঈদ এনাম
_______________________

'পারলে ঠেকাও'চিরকুট লিখে প্রতিদিন কেউনা কেউ উধাও হচ্ছেন। আজ দেখলাম পত্রিকা পাতায় ভাতীজার হাত ধরে চাচী উধাও, গতকাল দেখেছিলাম মামী কে ভাগ্না নিয়ে উধাও, তার আগের দিন দেখেছিলাম ছাত্রকে নিয়ে শিক্ষিকা উধাও। শালি কে নিয়ে দুলাভাই বা দুলাভাইকে নিয়ে শালি উধাও কিংবা ছাত্রীকে নিয়ে শিক্ষকের উধাও হবার ব্যাপার টা রীতিমতো ডালভাত। অনেক সময় প্রেমে মজে জামাই শাশুড়ি হাত ধরাধরি করে চম্পট দেয়ার খবরেও চোখ আটকে যায়। এসব উধাও হওয়া নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন সবাই। কোন ভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। ভয়, কে কবে কখন উধাও হয়।

উধাও হবার প্রধান কারন পরকিয়া বা বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক । পরকীয়া শুনতে কিছুটা শ্রুতিকটু শোনায় তাই অনেকে একে একটু ভদ্র ভাষায় বলেন 'বিবাহ বহির্ভুত' সম্পর্ক। ধর্মীয় আইনের পরিভাষায় অনেকে একে 'ব্যভিচার' বলেন। যে নামেই আমরা ডাকিনা কেনো বিবাহিত অবিবাহিত দের অবৈধ ভাবে উধাও হয়ে যাওয়া, আমাদের পরিবার, সমাজ বা রাস্ট্রের জন্যে মোটেই কাম্য নয়। তারপরও মানুষ একে অপরের হাত ধরে অবৈধ ভাবে শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে বন জংগলে উধাও হচ্ছে। এ উধাও হওয়াটা হঠাৎ এতো বেড়ে গেলো কেনো? এটা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

সাইকিয়াট্রিস্ট, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী সবাই সমাজে, পরিবারে ঘটে যাওয়া এই দুঃখজনক ঘটনার কারন খোঁজার চেস্টা করেছেন। জানলে অনেকে অবাক হবেন আমরা সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্ট যারা মনোরোগের চিকিৎসা করি তাদেরও অনেক সময় সম্পর্কের এমন টানাপোড়েন নিয়ে কাজ করতে হয়, ভুক্তভোগী দের সমাধানের পথ বাতলে দিতে।
ঘটনাক্রমে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন কিন্তু এখন তিনি তা থেকে মুক্তি পেতে চান, তিনি সম্পর্ক নিয়ে অপরাধবোধে ভুগছেন, তার এংজাইটি হচ্ছে, জীবনের প্রতি ঘৃনা চলে আসছে। কেনো এমন কাজে তিনি নিজেকে জড়ালেন? তিনি এখন তা থেকে ফিরতে চান। তার পরামর্শ দরকার।

চিকিৎসা নিতে আসা এ ধরনের রোগীরা সমাজের একেবারে নীচ পরিবারের তা কিন্তু নয়। পত্রিকার পাতায় চোখ বোলালে অনেক শিক্ষিত, এবং নামীদামী পরিবারেও সদস্যের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এ সব।

#উধাও_২

গবেষণায় দেখা গেছে পরকিয়া সম্পর্কটা সাধারণত বেশ একটা স্থায়ী হয়না। সাধারণত ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত। কারো ক্ষেত্রে কম বা বেশি। আর এ সম্পর্কে ভালোবাসার অস্তিত্ব ও তেমন একটা খুজে পাওয়া যায়না। কারন ভালোবাসা পবিত্র একটা ঘটনা। অপবিত্রতা বা কাউকে বঞ্চিত করা বা ঠকানো এখানে মোটেও কাম্য নয়।

একেকটা এক্সট্রামেরিটাল রিলেশনসিপের একেকটা কারন থাকে। তবে মোটাদাগে কারন গুলো কে পারিবারিক, সামাজিক, দৈহিক, মানসিক এই কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আসুন নিষিদ্ধ, বিবাহ বহির্ভুত, অবৈধ, অতি স্পর্শকাতর এই গোপন সম্পর্ক কেনো ইদানিং খুব বেশি দেখা যায়, তা নিয়ে কিছু জানার চেস্টা করি। হয়তো অনেকেই উপকৃত হবেন এ থেকে মুক্তি পেতে।

১) দৈহিক মেলামেশায় অতৃপ্তি:

বিবাহ বহির্ভুত পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত বেশ কিছু নারী পুরুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এর প্রধান কারন শারীরিক মেলামেশায় অতৃপ্ততা। এবং এ অতৃপ্ততা বিষয়ক স্পর্শকাতর প্রশ্নে শতকরা তিরিশ ভাগ স্ত্রী তাদের স্বামীর সাথে মিথ্যে উত্তর দিয়ে থাকেন।

যদিও তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে এক সাথে থেকে অনেক সামাজিকতা সুন্দর ভাবেই রক্ষা করে চেলেন, কিন্তু এ ঘনিষ্ঠ মেলামেশায় তাদের সমস্যা রয়েছে, এটা তারা কাউকেই শেয়ার করেন না। এ ব্যাপারে কারো স্বামীর রয়েছে দূর্বলতা, কারোর বা স্ত্রী'র। এই দুর্বলতার জন্যে চিকিৎসার শরনাপন্ন না হয়ে কেনো এমন অবৈধ কর্মে লিপ্ত হয়েছেন এ প্রশ্নে দু ধরনের উত্তর পাওয়া যায়। কেউ বলেন দুরারোগ্য কেউবা বলেন চিকিৎসায় নিষ্ফল। আর এ নিয়ে ডিভোর্স বা দ্বিতীয় বিয়ে না নেবার কারন হিসেবে তারা সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ের কথা বলেন।


২) অধিক চাহিদাঃ

অনেকে এ নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়ানোর কারন হিসেবে বলেন তার চাহিদা প্রচুর। সংগী বা সংগীনী সে চাহিদা পুরনে ব্যার্থ, তাই তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছেন।

৩) পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা:

এক সাথে দীর্ঘদিন থাকছেন কিন্তু তাদের মধ্যে আবেগময় কোন সম্পর্ক নেই। শুরু থেকেই তারা রোবটের মতো জীবন যাপন করছেন। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে, রোমান্টিক সম্পর্ক স্থাপনে অনেকে অজান্তেই পরকীয়ায় জড়ান।

৪) প্রতিশোধ পরায়ন:

স্বামী বা স্ত্রী দুজনের কেউ অতিতে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে লিপ্ত থেকেছেন বিষয় টি জানাজানি হবার পর প্রতিশোধ নিতে অনেকে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান।

৫) অর্থবিত্ত:

আর্থিক লোভ লালসায় পড়ে অনেকে পরকীয়ায় লিপ্ত হন। কেউ কেউ চাকুরী ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা আদায়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হন বা হতে বাধ্য হন, বাধ্য করেন।

৬) নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ:

নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ শয়তানের কু মন্ত্রনা। অনেকে এ কুমন্ত্রনায় গা ভাসিয়ে এরকম অবৈধ সম্পর্কে নিজেকে জড়ান। আবার অনেকে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক কে ফ্যাশন বা স্মার্টনেস ভাবেন। ফলে এই ভয়ংকর পথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।

৭) অল্প বয়সে বিয়ে:

অনেক সময় অল্প বয়সে যেমন বয়স ২০ বছর এর ভিতর বিয়ে করলে দেখা যায় পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশের কোটায় এসে 'যাপিত জীবন' তাদের কাছে এক ঘুঁয়েমী মনে হয়। ফলে অবৈধ সম্পর্কে তাদেত মন প্রশান্তি আবিষ্কার করে। চাপে পড়ে বিয়ে, অমতে বিয়ে, অসম বয়সী বিয়ে, বিশেষ উদ্দেশ্যে বিয়ে, বিয়ের পর মানসিক চাপ ও নির্যাতনেও অনেকে পরকীয়ায় লিপ্ত হন।

৮) সংগী বা সংগীনীর মৃত্যু:

স্বামী বা স্ত্রী'র মৃত্যুর পর অনেকে দৈহিক চাহিদা মেটাতে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান। এক্ষেত্রে পূনঃবিবাহ শুধুমাত্র লাজ লজ্জার ভয়ে এড়িয়ে যান।

৯) দাম্পত্য জীবনে কোয়ালিটি টাইমে'র অভাব:

স্বামী বা স্ত্রী চাকুরী ব্যবসা নিয়ে দিন রাত ব্যস্ত। ব্যস্ততায় তার নিজের চাহিদা হয়তো ভুলে যান কিন্তু সংগী বা সংগীনীর চাহিদা কে অজান্তে অবজ্ঞা করেন। এমন কি তাদের মধ্যে কোয়ালিটি টাইম যেমন বেড়ানো, গল্প করা ইত্যাদির সুযোগ হয়না। ফলে মানসিক প্রশান্তি খুঁজতে অজান্তে অনেকে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান। যা প্রথমে ভালোবাসা পরে দৈহিক মেলামেশায় পরিণত হয়

১০) সন্তান জন্মদান:

অনেক সময় সন্তান জন্মদানের পর স্ত্রী হয়তো সন্তান কে নিয়েই বেশি সময় ব্যয় করেন, স্বামীর চাহিদা কে খাটো করে দেখেন আবার অনেক স্বামী আছেন সন্তান আসায় স্ত্রী'র প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার উল্টো টাও হয়। স্বামীর সন্তানের প্রতি অধিক মনযোগী হওয়ায় অনেক স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন।

১১) ওয়ানস এ চিটার ইজ অলওয়েজ এ চিটার:

কথাটি অবশ্য বিতর্কিত। তারপর ও দেখা গিয়েছে যিনি একবার প্রতারণার আশ্রয় নেন তিনি বার বার সে পথেই পা বাড়ান। অনেক সময় এ অনাচার অনেকে পরিবার থেকেও শিখেন। পরকীয়ায় লিপ্ত ছেলে মেয়েদের পরিবারের অন্য সদস্যদের ক্ষেত্রেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখা যায়।

১২) মানসিক রোগ:

বিবাহ বহির্ভুত অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া বা কাউকে বাধ্য করা এক ধরনের মানসিক রোগের লক্ষন। একে এন্টি সোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসওয়ার্ডের বলে। এর চিকিৎসা ও রয়েছে। মেডিসিন ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রনে হয়।

#উধাও_৩

কিভাবে বুঝবেন প্রিয়জন বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে আসক্ত?

কারো সাথে কারো টুকটাক কথা বলা, এস এম এস বা মেইল আদান প্রদান করা বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা মানেই যে রহস্যময় কিছু একটা এমনটি ভাবার কোন কারন নেই। অযথা সন্দেহ করাটাও কিন্ত একটা মানসিক রোগ। এ রোগ অনেকের মধ্যে আছে। অনেকে এ স্ট্রাগল মেনে নিয়ে খুব কষ্টে দাম্পত্য জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন।

তবে পরকীয়া বা এক্সট্রামেরিটাল রিলেশন এর কিছু লক্ষন আছে যা দেখলে সহজেই বুঝা যায়, সামথিং রং। যেমন কোন কিছুর প্রশ্নের উত্তরে হাইড করা, লুকানো, গোজামিল দেয়া। লুকিয়ে ফোন, ল্যাপটপ ব্যবহার করা বা কথাবার্তা বলা, লাইফ স্টাইলে আচমকা চেঞ্জ দেখা যেমন অসময়ে ফেরা, বের হয়ে যাওয়া বা কোন কিছুতে যেমন আবেগ বা চাহিদায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন। এছাড়া অপরিচিত ফোন কলে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে কথাবার্তা বলা, কল লিস্ট, এস এম এস লিস্ট ডিলিট কিরা বা সেইফটি পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখা।

প্রিয় মানুষ বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে লিপ্ত হলে করনীয়:

যে কোন সমস্যা নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করাই হলো যে সম্পর্কের ভালোবাসার মুল ভিত্তি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রাখা। তবে সব কিছুরই একটা সীমা রেখা আছে।

আগেই বলেছি পরকীয়া বা ব্যভিচার এর সম্পর্ক গুলো সাধারণত ১ থেকে ৫ বছর এর বেশি স্থায়ী হয় না, এবং এগুলোর পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিভোর্স, হত্যা, আত্মহত্যা ইত্যাদিতে ভুক্তভোগী কে প্ররোচিত করে।

পরকীয়া বা ব্যভিচার ইসলাম ধর্মে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং উভয় পক্ষের স্বার্থ বিবেচনায় এর জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অবিবাহিতরা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে এক রকম শাস্তি (১০০ বেত্রাঘাত) এবং বিবাহিতরা ব্যভিচারে আরেক রকমের শাস্তির (মৃত্যুদণ্ড) বিধান আছে। তাছাড়া ইসলামে স্বামীর যেমন স্ত্রীর প্রতি পূর্ন হকের কথা বলা হয়েছে তেমন স্ত্রীর ও তার স্বামীর প্রতি পূর্ণ হক বা অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অধিকারে কেউ কারো কম নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে ইসলাম সহ অন্যান্য সকল ধর্মে স্ত্রী'দের অধিকার বেশি রাখা হয়েছে।

কেউ যাতে শারিরীক বা মানসিক ভাবে বঞ্চিত বা নির্যাতিত হতে না পারে সেজন্যে উভয় পক্ষকেই শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন বেছে নিতে তালাক বা সেপারেশনের বিধান রয়েছে ইসলামে। ইসলাম শান্তির ধর্ম তাই ব্যভিচার, অনাচার ইত্যাদি থেকে বিরত থেকে বরং তালাক কেই সর্বশেষ পথ হিসেবে বেছে নেবার কথা বলা হয়েছে।

মুসলমানদের মধ্যে সঠিক ইসলাম চর্চা বা জ্ঞান নেই বলে তাদের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে বহু বিবাহের পরিবর্তে অবৈধ বহুগামিতা বা ব্যভিচারে সন্তর্পণে লিপ্ত হতে দেখা যায় বা মেনে নিতে দেখা যায়।

ডা. মো. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়