Ameen Qudir

Published:
2019-02-05 10:22:31 BdST

সরকারি কর্মকর্তাদের পুত্র-কন্যাদের অনেক সাফার করতে হয়


 

 

ডা.নাহিদ ফারজানা
---------------------------------------------

সরকারি কর্মকর্তাদের পুত্র-কন্যাদের অনেক সাফার করতে হয়। যেমন আমি। ট্র্যাজেডি ভরা জীবন। উদাহরণ দিই। পটুয়াখালীতে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু। ক্লাসের প্রথম স্হানটা আমার দখলেই ছিল। "ফার্স্ট ক্যাপ্টেন " পোস্টটা ছিল খুবই
উচ্চমার্গের পোস্ট, অন্তত আমার চোখে। ক্লাস ফাইভে ওঠার চারমাস পরে আব্বুর বদলির জন্য চলে আসতে হলো ঢাকা। একটি স্বনামধন্য স্কুলে ভর্তি করা হল। আমার রোল হল একশো সাতচল্লিশ। কষ্টের পরিমাণটা চিন্তা করতে পারেন? তখনকার মানুষদের
প্রবণতা ছিল রোল জিজ্ঞেস করা।

"কোন ক্লাসে পড়?রোল কত?"

তখন ১৪৭ রোল বলাটা ছিল খুবই হৃদয়বিদারক।

ঐ স্কুলে দেড়শ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে, বিগত পাঁচ বছরের
অপ্রতিরোধ্য টপারকে হারিয়ে প্রথম হয়ে আমি যখন সিক্সে উঠলাম, তার তিনমাস পরে অাব্বুর বদলির অর্ডার এল। এবারে যশোর।

ভাগ্য ভালো, যশোর রওনা হওয়ার অাগেই অামার ঢাকার স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের তারিখ পড়লো। প্রধান অতিথি এরশাদ সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী।

স্কুল থেকে বলে দেওয়া হল, প্রত্যেক ছাত্রী যেন যত পারে ফুল নিয়ে আসে। অামার মন্ত্রী বিষয়ক উৎসাহ ছিল না। তাছাড়া অামি ফুল পাবই বা কোথায়? অামার উৎসাহের বিষয় ছিল অামি পুরষ্কার পাবো ফার্স্ট হওয়ার জন্য।

পরদিন স্কুলের বিরাট মাঠ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক -শিক্ষিকা দিয়ে জমজমাট। বিশাল মঞ্চ। ছাত্রীদের, বিশেষ করে সিনিয়র আপুদের দু'হাত উপচে পড়া ফুল-গোলাপ,রজনীগন্ধা,গাঁদা,ডালিয়া ইত্যাদি। অামার এক বান্ধবীর হাতে হাতলওয়ালা বেতের ঝুড়ি। তার মধ্য রং-বেরঙের নানারকম ফুল। ওর কাছে ফুল ভিক্ষা চাইলাম। ও অনেক যত্ন করে বেছে সবচেয়ে ছোট, রুগ্ন, শুকনো একটা গাঁদা আমায় ভিক্ষা দিল।

মন্ত্রী আসার কিছুক্ষণ আগে কর্তৃপক্ষ অাবিষ্কার করলেন, কোথাও কোন ত্রুটি নেই, তবে প্রধান অতিথিকে কে মালা দিবে তা ঠিক হয়নি।

স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাস নাইন-টেনের অাপুদের ডাক পড়লো। বেশ সময় চলে গেল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোন সিদ্ধান্তে অাসতে পারলেন না।

অামি ঘুঁটে কুড়ানিদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি, হাতে একটি মৃতপ্রায় গাঁদা, এমন সময় কয়েকজন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জানালো, আমাকে কমিটি ডাকছেন।

বাসা থেকে ফুল আনতে বলা হয়েছিল বারবার,আমিতো আনিইনি,আবার আরেকজনের হাতে -পায়ে ধরে তার ফুলের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছি, এই অপরাধেই কি ডাক পড়লো?

রুমে ঢুকে দেখি,কোন্ টিচার নেই? হেডস্যার থেকে শুরু করে সবাই। অামার ক্লাস টিচার মাহমুদা আপা, কঠিন ব্যক্তিত্ব আর প্রচন্ড গাম্ভীর্যের জন্য প্রতিটা ছাত্র ছাত্রী যাঁকে যমের মতো ভয় পেত, এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে সবার সামনে নিয়ে গেলেন,
" আপনাদের কি মনে হয়, এই মেয়ের কোন বিকল্প অাছে? আমার ফার্স্ট গার্ল, এই বয়সেই চেহারায় পার্সোনালিটি আর ইনোসেন্সের কম্বিনেশন দেখেছেন? আমি মনে করি, এই মেয়েই পারফেক্ট। "

আমাকে জানানো হলো, মন্ত্রীর গলায় অামাকে মালা পরাতে হবে। ঠিক আছে, পরাবো। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলেন ভয় পাচ্ছি কিনা? শুনে আমি অবাক। ভয়ের কি কিছু আছে এখানে? মালা দেওয়া তো অংক পরীক্ষা নয়।

আপা বললেন, "এই মেয়েকে জীবনে পাউডার ও দিতে দেখিনি। তবে তোমাকে এখন একটু পাউডার -লিপস্টিক দিয়ে দিব। নইলে টিভি ক্যামেরায় ভালো ছবি আসবে না।"

আপা নিজেই আমাকে পাউডার দিয়ে দিলেন, সুন্দর করে ঝুঁটি বেঁধে দিলেন, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে দিলেন, তারপর আমার হাতে দিলেন টাটকা ফুলের বিশাল এক মালা। ফুল ছাড়া ঝাড়া হাত -পায়ে এসে আমি ফুলেশ্বরী হয়ে গেলাম।

মন্ত্রী দলবলসহ চলে এসেছেন। মঞ্চে অনেকেই উপবিষ্ট। আপা ভালো করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, ওই যে, স্যুট পরা, বাম থেকে তৃতীয়, উনার গলায় মালা পরিয়ে দিবে।

মঞ্চে নাম-ধাম সহ আমার ডাক পড়লো। স্টেজে ওঠার পরে সব ক্যামেরা অামার দিকে। এক অল্প বয়সী ছোট -খাটো তরুণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশের চেয়ারে স্যুট পরা আশি-পঁচাশি বছরের এক বৃদ্ধ। ইনিই তবে মন্ত্রী। অামি মালা হাতে বৃদ্ধের দিকে আপার নির্দেশ মতো হাসি হাসি মুখ করে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেলাম।

একটা হৈ-হৈ রব উঠলো। কে যেন আস্তে করে অামাকে ধরে অামার গতিপথ ঘুরিয়ে দিলেন। অল্প বয়সী যাঁকে মনে করেছিলাম, তিনি মাথা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে মালা পরার জন্য এগিয়ে এলেন। তবে অতটা না ঝুঁকলেও উনার চলতো। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের গলায় মালা পরালাম।

মুহূর্মুহু ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। মন্ত্রী সাহেব অামার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন।

আমাকে রাজরাণির মতো স্টেজ থেকে নামানো হল।

মন্ত্রী মহোদয় বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। অামি কার হাত থেকে প্রাইজ নিলাম, মনে করতে পারছি না।
গল্পের বই। "লেবু মামার সপ্তকাণ্ড। "

ঐ স্কুলে ঐদিন ই আমার শেষ যাওয়া। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল কদিনের জন্য। আমরা চলে এলাম যশোর। নতুন স্কুল -যশোর গভ: গার্লস হাই স্কুল। রোল ছিল ১, নতুন স্কুলে হলো ৬৭।

কিছু দিন পরে ঢাকার পুরানো বন্ধুরা ল্যান্ড ফোনে জানালো, স্কুল খুলেছে। কলাপসিবল গেইট দিয়ে ঢুকলেই দেয়ালে টাঙানো বিশাল ছবি। অামার ও মন্ত্রী মহোদয়ের। গলায় মালা পরানোর সময়। অামাকে নাকি খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

আব্বুর কাছে খবর পেয়ে আমার ঢাকাবাসী চাচা ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আসলেন ছবিটা দেখতে। চাচার উচ্ছ্বাস ছিল বাড়াবাড়ি রকমের।

"মানুষের বাচ্চা তো না, পরীর বাচ্চা। যে স্কুলে ঢুকে, সেই হাঁ করে খানিকক্ষণ দাঁড়ি (আমাদের কুষ্টিয়ার ভাষা) থাকে। সবাই বলে, কি সুন্দর মেয়ি।"

চাচা দারোয়ান -পিওন সবাইকে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিয়ে এলেন।

ফটোটা বছর দুয়েক টাঙানো ছিল। কিন্তু অামার অার দেখা হয়নি। জীবনে ওটাই আমার একমাত্র মাল্যদান। আমার বিয়েতে মালাবদল হয়নি।কারণ বরপক্ষ বেলা আড়াইটায় এসেছে মালা ছাড়া, বিকাল পাঁচটার সময় অামাকে নিয়ে বের হয়ে গেছে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে। এর মাঝে বিয়ে পড়ানো, সাড়ে সাতশো লোকের খাওয়া -দাওয়া, কন্যা বিদায়।

যাহোক, তেতাল্লিশ বছরের জীবনে একজনকে তো অন্তত মালা পরাতে পেরেছি ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়