Ameen Qudir

Published:
2019-01-30 00:18:36 BdST

জিন্দেগী না মিলেঙ্গে দোবারাডাক্তারদের পরাজয় :জীবনের পরাজয়:কালের যাত্রার ধ্বনি আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?


 


ডা. জামান অ্যালেক্স
______________________________

১...

স্থানীয় পাতি নেতা তার ক্ষুব্ধ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দ্রুত ভঙ্গিতে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে প্রবেশ করলেন।একটা এসপারওসপার তারা আজ করেই ছাড়বে, তাদের চ্যালাকে অন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে, কিন্তু হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার সাথে করে দেয়া হয় নাই। তারা চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আপুর সাথে বাকবিতন্ডা শুরু করলেন...

আপু তাদের যতই বোঝান যে হাসপাতালের সিলিণ্ডার বাইরে দেয়ার নিয়ম নেই, তারা ততই গর্জে উঠেন। যেহেতু কর্মরত চিকিৎসক একজন মহিলা কাজেই বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে তারা ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে আক্রমণ শুরু করলো। পাতি নেতা এ পর্যায়ে অশ্লীল ভঙ্গিতে যে কথাটা বললো সেটা কোট করিঃ

'অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবো না, ঐ তরা( সাঙ্গপাঙ্গকে নির্দেশ করে) সব শুইয়া পর, আপায় আইজকা আমাগো সেবা দিবো, টিকিটের পাঁচ ট্যাকা নাইলে দিয়া দিবোনে...'

কর্মক্ষেত্রে আপনার বোনকে যদি কেউ একথা বলতেন তবে আপনি কেমন বোধ করতেন?...

২...

এবারের ঘটনা আমার সাথে। ইমার্জেন্সি রুমে একটার পর একটা রোগী আসছে। একটা হার্ট অ্যাটাক, একটা স্ট্রোক, একটা শ্বাসকষ্টের (অ্যাজমা) রোগী আর দুইটা রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট এর বিভৎস রোগী একত্রে সামলাচ্ছি, প্রত্যেকের সাথে ৭-৮ জন করে লোক। আমার দম ফেলার ফুরসত নেই। এমন অবস্থায় এক লোক তার প্রেসার মাপার জন্য আমাকে বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু অন্য রোগীগুলোর অবস্থা খুব খারাপ তাই আমি তাকে ওভারলুক করলাম, ২০ মিনিট পর আসতে বললাম...

লোকটি তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তুইতোকারি শুরু করলো, 'আমারে চিনস' -টাইপ হম্বিতম্বি স্টার্ট হলো, তার এক ফোনে নাকি আমি ওলটপালট হয়ে যাবো...

লোকটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করলো না। লোকটির বিবেকহীনতায় আমি তখন বিস্মিত। যেহেতু কর্তৃপক্ষ এই শ্রেণীর বিপদজনক লোক হতে আমার নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করেনি, সেহেতু হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের রোগী বসিয়ে রেখে আমি তার ব্লাডপ্রেসার মেপে দিলাম...

৩...

রিসেন্ট একটা ঘটনা মনে দাগ কাটলো।পত্রিকার শিরোনাম দেখে কপালে ভাঁজ পরলো, শিরোনামটা এরকমঃ "কেরানীগঞ্জে এসিল্যান্ডের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের উপর হামলা..."

পত্রিকা মারফত যা জানলাম মূল ঘটনা তার চেয়েও নাকি ভয়াবহ। আমি আর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না...

অশিক্ষিত, মূর্খ লোকের গোয়ার্তুমির একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এক শিক্ষিত লোক যদি একই কাজ করেন তবে সেটা কিভাবে জাস্টিফাই করবেন? তার শিক্ষার কি মূল্য রইলো? শেকল ভাঙার গান যাদের গাইবার কথা, সেইসব শিক্ষিত লোকেরা আজ শেকল তৈরি করছেন। আফসোস...

৪...

আমি কতগুলো নাম বলি, দেখুনতো আপনাদের পরিচিত মনে হয় কিনা...

ডা. শম্পা
ডা. মুরাদ
ডা. পবিত্র কুন্ডু
ডা. সাজিয়া
ডা. অমিত
ডা. তন্ময়
ডা. পরাগ
ডা. রিজন
..............
..............

মনে পড়ে কিছু? আমার মেমোরী খুব একটা শার্প না, এরপরও এই নামগুলো আমি আমার মেমোরী থেকে মুছতে পারি নাই...

কিভাবে মুছি বলেন? একেকটি নাম একেকটি দীর্ঘশ্বাস, একেকটি নাম একেকটি চিকিৎসক অত্যাচারের কালো অধ্যায়, একেকটি নাম এদেশে চিকিৎসক নিগ্রহের বিচারহীনতার একেকটি সোপান। এই নামের সাথে কোন একদিন আমার-আপনার নাম যোগ হবে। বলতে পারেন এদেশে চিকিৎসক বাদে আর কোনো পেশাজীবীকে এতোটা অত্যাচার সইতে হয়েছে?...

"The wound is the place where light enters you..." মাওলানা রুমী সাহেবের কথাবার্তা। মনে প্রশ্ন জাগে-আর কত ক্ষত সৃষ্টি হলে আলো আমাদের মাঝে প্রবেশ করবে?...

৫...

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। ১৫ জন চিকিৎসক মেম্বার অব পার্লামেন্টে হিসেবে শপথ নিয়েছেন, যা নির্দিষ্ট একটি পেশাজীবী হিসেবে সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও চিকিৎসক। আমরা কি এবার আশা করতে পারি যে এবার এদেশে চিকিৎসক নির্যাতন বন্ধ হবে? আমরা কি এবার আশা করতে পারি যে এবার চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে?...

নির্বাচন পরবর্তী কয়েকদিন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা অনেকেই চিকিৎসক হিসেবে যারা মেম্বার অব পার্লামেন্টে হয়েছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, হাসিমুখে মেম্বার অব পার্লামেন্টদের সাথে ছবিও তুলেছেন। তাতে আমার আপত্তি নাই। এই পর্যায়ে আহমদ ছফার একটি কথাকে কোট করে ফেলিঃ " আমরা এক আজব সময়ে বসবাস করছি। নিজের স্বার্থের বিষয় না থাকলে কেউ কারো জন্য বাক্য ব্যয় করতেও কুণ্ঠিত হয়..."...ছফা সাহেবের কথা সবসময় সত্য হতে হবে এমন কোন কথা নেই।তাই বলছিলাম ছবি তোলার সাথে সাথে আপনারা কি কাইন্ডলি চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ইস্যুটি তাদের সামনে তুলে ধরবেন? তীর হারা এই নির্যাতনের ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেয়া আমাদের মত সাধারণ চিকিৎসকদের পক্ষে আর সম্ভবপর হচ্ছে না...

৬...

কিছুদিন আগে পিইসি এর রেজাল্ট বের হলো। জেরিন নামের একটা মেয়ে ৬০০ তে ৬০০ পেয়ে প্রথম হয়েছে। তার স্বপ্ন সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে। পেপারে লেখাটা দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে এলো, একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললাম। জিন্দেগী না মিলেঙ্গে দোবারা। লেখাপড়াতে সে জয়ী, কিন্তু সে কি জানে চিকিৎসক হবার পর দ্বিতীয়বার সুযোগ না পাওয়া এই এক জিন্দেগীতে তার জন্য কত বহুমাত্রিক বিভীষিকাময় পরাজয় অপেক্ষা করছে?...

দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় অর্ধশতক হয়ে এলো। এতোদিনেও আমরা এদেশের এই সোনার ছেলেমেয়েগুলোর জন্য একটা নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি নাই। এ ব্যর্থতার দায়ভার কার? সৃষ্টিশীল এ ছেলেমেয়েগুলো যদি দেশমাতৃকাকে ত্যাগ করে তবে যে ক্ষতিটা হবে সেটা কি কখনো পূরণ করা সম্ভব? কালের যাত্রার ধ্বনি আমরা কি শুনতে পাচ্ছি? দেশমাতৃকার বাহ্যিক উন্নতি আমরা দেখি, দেশমাতার যে তিলে তিলে আত্মিক মৃত্যু ঘটছে সেটা কি আমাদের চোখে পড়ে?..
_____________________________
ডা. জামান অ্যালেক্স । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়