Ameen Qudir

Published:
2019-01-27 05:21:44 BdST

সম্পর্ক “মাই ডক্টর টোল্ড মি টু টেক দিস” : ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক


 

 

ডা. তারিক আলম অনি

___________________________

ইমার্জেন্সী তে এক রোগিনী এসেছে। এনাফাইলেক্সিস। লাইফ থ্রেটেনিং এলার্জী এটাক যাকে বলে। মোটামুটি শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তিনটা এড্রেনালিন ইনজেকশন পুশ করেও কাজ না হওয়ায় এড্রেনালিন ড্রীপ( শিরাপথে) অনবরত চালানো হয়েছে। কষ্ট করে ম্যানেজ করা গেছে। মোটামুটি যমদূতকে ছোটখাটো একটা হাই হ্যালো করে রোগিনী পৃথিবীতে ফিরেছে।

মোটামুটি স্ট্যাবল হওয়ার পর তাকে বললাম,

-“তুমি আপাতত বিপদমুক্ত। তবে তোমার এটাক টা খুব সিরিয়াস ছিল, মারা যেতে পারতে। তোমার ফ্যামিলি ডাক্তার যে ঔষধ টা দিয়েছে খুব সম্ভবত সেটা রিএকশন করেছে তোমার শরীরে।”

আমার কথা শেষ হওয়ার আগে রোগিনী বললো,
- “ না । না । আমার জিপি খুব ই ভালো ডাক্তার। সে ভুল কিছু দিতেই পারে না। “

- “না। আমি বলছিনা সে ভুল কিছু দিয়েছে। বলছি তার দেওয়া ঔষধটা তোমার উপর রিএকশন করেছে। “

- “ হু হতেই পারে। সে বা আমি কেউ ই জানতাম না যে আমি এলার্জিক এই ঔষধটার উপর। আমার জীবনেও আগে এরকম হয়নি তো। এই প্রথম।”

রোগিনীকে হাসিমুখে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরতেই একটা ব্যাপার মনে হল, আশ্চর্য এদের ডাক্তার ভক্তি। আরেকটু হলে মারা যেত তারপরও তার ফ্যামিলি ডাক্তারের উপর তার অগাধ বিশ্বাস। সে তার ফ্যামিলি ডাক্তারের অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে এটাই মানতে পারছে না। “মাই ডক্টর” বলার সময় তার চোখে মুখে যে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছিল আর শ্রান্ত-ক্লান্ত চোখের তারায় যে হঠাৎ এক চিলতে বিদ্যুৎ খেলা করে গেল তা আমার চিকিৎসক চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি, মুহুর্তেই ধরা পড়ে গেছে। রীতিমতো ঈর্ষা বোধ করলাম। ব্লাইন্ড ট্রাস্ট/ অন্ধ বিশ্বাস বোধহয় একেই বলে। হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে করলো সেই ফ্যামিলি ডাক্তারকে, যার এরকম একজন রোগী আছে! যে মারতে বসেও বলছে “মাই ডক্টর”। একজন ডাক্তারের জন্য গর্বভরা এই “মাই ডক্টর” শব্দটা অমূল্য, টাকা দিয়ে কিনা যায়না এই ছোট্ট শব্দ দুইটা। এই বিশ্বাসে আঘাত করা উচিত হবেনা। এতে ডাক্তার-রোগী গভীর বিশ্বাসের সম্পর্ক কে আঘাত করা হবে। ডাক্তার হয়ে সেটা কিভাবে করি।

ফিরে যেয়ে রোগিনীকে বললাম,
- “আমি প্রটোকল ঘেটে দেখলাম, তোমার ফ্যামিলি ডাক্তার তোমাকে খুব ই ভালো ঔষধ দিয়েছেন। আমি হলেও সম্ভবত এই ঔষধই দিতাম। যাই হোক যেহেতু রিএকশন করেছে, সেহেতু এটা আর তুমি নিতে পারবে না। আমি অন্য একটা ঔষধ শুরু করছি আর আমি তোমার ফ্যামিলি ডাক্তার কে চিঠি লিখে জানাচ্ছি ব্যাপারটা। সে তোমাকে আবার ফলো আপ করবে। চিয়ার্স! “

রোগিনীর মুখে সত্যিকারের হাসি। আমাকে আবারও ধন্যবাদ দিল তার চিকিতসা করার জন্য এবং সবকিছুর জন্য। আমি ও খুশি। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, কোন রোগ চিকিৎসায় ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক টা কতটা জরুরী। ডাক্তারের চিকিতসা ভুল হতে পারে, হয় ও। এই উন্নত দেশেও হয়। কিন্তু তারপরও রোগীরা কিছুতেই ডাক্তারের উপর আস্হা হারায় না। ডাক্তারের উপর পূর্ণ আস্থা যেকোন রোগীর দ্রুত আরোগ্য নিশ্চিত করে। উপরন্তু, ডাক্তারের উপর অবিশ্বাস, এক ডাক্তারের চিকিতসা অন্য ডাক্তারকে দিয়ে ভেরিফাই করা, প্রেসক্রিপশন এডিটিং এবং সমালোচনা, এক ডাক্তার আরেক ডাক্তারের ভুল ধরা পুরো চিকিতসা ব্যবস্থার উপর ই অনাস্থা তৈরী করে। চিকিতসায় শুধু জটিলতা আর বিফলতা তৈরী করে।

ধরুন, আপনিই রোগী, নিউমোনিয়া তে আক্রান্ত। অসুস্থ অবস্থায় কতটা মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থায় আপনি। তার উপর জ্বর-কাশি তো আছেই। আপনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। প্রথম ডাক্তার আপনাকে দেখে হয়তো কিছু ঔষধ আর এন্টিবায়োটিক লিখে দিলেন, হয়তো কিছু পরীক্ষা দিলেন, হয়তো বললেন আবার পরের সপ্তাহে আসতে। আপনি এই প্রেসক্রিপশন টা নিয়ে দ্বিতীয় ডাক্তারের কাছে গেলে দ্বিতীয় ডাক্তার দুটো কাজ করতে পারেন।
প্রথম ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করতে বলতে পারেন। খুব ভুল কিছু না লিখলে প্রেসক্রিপশন পরিবর্তনের কোন দরকার নেই।

কিন্তু, আমাদের দেশে প্রায়ক্ষেত্রে যেটা হয়, প্রথম ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের উপর দ্বিতীয় ডাক্তার কলম চালান। দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি, এক নিউমোনিয়া কমপক্ষে পাঁচ রকম এন্টিবায়টিক দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। রক্ত পরীক্ষা/ এক্সরে পরীক্ষা - অনেক ডাক্তার দিতেও পারেন, অনেক ডাক্তার নাও দিতে পারেন। সবগুলোই সঠিক। কিন্তু কলম চালানো সোজা। কিছু অসাধু ডাক্তার একটা কাজ করেন, পুর্ববর্তী ডাক্তারের চিকিতসায় ভুল ধরে সেটাকে পুজি করে নিজের চিকিতসা কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। আপনি রোগী হিসেবে চিন্তা করুন- এরকম হলে আপনি কি প্রথম ডাক্তারের উপর বিশ্বাস হারিয়ে , দ্বিতীয় ডাক্তারকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারতেন? পারতেন না। আপনি কি তৃতীয় ডাক্তার এর কাছে যেতেন না? যেতেন। এবং সেই তৃতীয় ডাক্তারের উপরও কি পূর্ণ আস্থা থাকতো? উত্তর হল- থাকতো না। পুরোপুরি ডাক্তার-রোগী বিশ্বাসের সম্পর্ক টা যেখানে নড়বড়ে সেখানে রোগমুক্তি না হয়ে জটিলতাই তৈরী হত।

এই দেশে যে ভালো চিকিতসা হয় এবং বাইরের ডাক্তারের কথা শুনলে যে রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে যায়, এর শিকড় আমার ধারণা ডাক্তার- রোগীর সম্পর্কে। প্রচন্ড অন্ধভাবে বিশ্বাস করে এরা ডাক্তারকে। আমি এতদিন কাজ করছি, আমি আমার শত শত রোগীকে বলেছি, “তোমার ওই হাড় টা ভেঙ্গে গেছে, আমি তোমাকে কিছু ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে সেটা ফিক্স করে প্লাস্টার করে দিব।” বিশ্বাস করুন, হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া কেউ এক্সরে দেখতে চায়নি, জানতেও চায়নি হাড়টা কোথায় কতটুকু ভাংল এবং আমি কিভাবে কি করবো। আমি প্রচুর রোগীকে বলেছি, “তোমার ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট ভালো” - একজন ও আমার কাছে জানতে চায়নি, কি ভালো, কোনটা কত, লিভার না কিডনী, নাকি ক্যান্সার। আমি বেশ কিছু রোগীকে বলতে বাধ্য হয়েছি, “দেখো তোমার এই ব্যাথা এর চেয়ে বেশি কমবে না, বাসায় চলে যাও। আমি সরি।” সে বিশ্বাস করেছে যে তা আসলেই কমার নয়। চলে গেছে মন খারাপ করে কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্ন করেনি।

তবে এই উন্নত দেশেও ভুল চিকিতসা হয়। প্রচুর মামলা হয়। জরিমানা হয়। লাইসেন্স ক্যানসেল হয় পর্যন্ত। ডাক্তারদের জবাবদিহিতা এখানে অনেক। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক টা কে তারা যত্নে লালন করে। এই জায়গাটা তে তারা কিছুতেই আঘাত করতে দেয়না। আমার ধারণা, আমার বাংলাদেশে এই সম্পর্ক টা লালন করার জন্য ডাক্তার এবং রোগীর উভয়ের ভূমিকা রাখা দরকার। ডাক্তারদের ভূমিকা টাই মূখ্য হওয়া উচিত জনসচেতনতা তৈরীতে।

ডাক্তারদের মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। এক ডাক্তারের জ্ঞান বা চিন্তা কে অন্য ডাক্তারের সম্মান করা উচিত। তাহলেই রোগীদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। ভরসার এবং আস্থার জায়গাটা তৈরী হবে। আমাদের দেশের রোগীরা দেশের ডাক্তারের উপর বিশ্বাস হারিয়ে শুধু কথা শুনে রোগ অর্ধেক ভালো করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ছুটবেন না। আমাদের ডাক্তাররাও ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্য আরেক ডাক্তারের প্রসক্রিপশনে কলম চালিয়ে ভুল প্রমাণ করে নিজের প্রসার প্রচার বাড়াবেন না। তখন আমার দেশের রোগী হয়তো বিদেশের কোন ডাক্তারের কাছেই গর্ব করে বলবেন, “এই ঔষধ আমার দেশের ডাক্তার দিয়েছে। এটার উপর কলম চালানো যাবে না! “

__________________

ডা. তারিক আলম অনি
রেজিস্ট্রার
ডিপার্টমেন্ট- এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী,
গ্ল্যাডস্টোন হাসপাতাল।
সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়