Ameen Qudir

Published:
2016-12-17 21:15:35 BdST

মতি গাজীর লাশটি কোথায়?


 


বেণুলাল দাশগুপ্ত
______________________


যুদ্ধ শুরুর পরই মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতা আক্কাস খান নরেরকাঠী এবং গাভা গ্রামের ৭৬ জন নর-নারীকে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পরে তাঁদেরকে নরেরকাঠী সমদ্দার বাড়ির খালের মধ্যে ফেলে রাখে। আমি তখন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার গাভা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এলাকার যুবকদের নিয়ে আমার নামে বেণু বাহিনী গড়ে তুলি। বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গাভা স্কুলে ক্যাম্প গঠন করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৯ নং সেক্টর কমান্ডের অধীনে আমাকে বানারীপাড়া, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন, ছারছিনা দরবার শরীফ, ঝালকাঠী সদর উপজেলার গাভা-রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন ও উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের বেস কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মেজর এম এ জলিল আমাকে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন। তখন আমাদের দলে একমাত্র মহিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহানারা পারভীন শোভা যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে আমাদের দলে কম করে হলেও প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। সম্ভবত ২২ নভেম্বর ঘটনা। আমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো স্বরূপকাঠী কমান্ডার জাহাঙ্গীরের বাহাদুরের। তিনি বললেন, ছারছিনার দরবার শরীফে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে আপনার সহযোগিতা লাগবে। আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিই। তবে ছারছিনা দরবার শরীফ আক্রমণ করতে যে পরিমাণ গোলাবারুদের দরকার তা আমাদের সংগ্রহে ছিল না। আমাদেরকে গোলা-বারুদ দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর বাহাদুরকে অনুরোধ করলাম। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সাব-কমান্ডার নূর মোহাম্মদ। কথা অনুযায়ী রাত ৮টার দিকে আমি, মতি কাজী, অনুকূল, হাবিব, দেলোয়ারসহ প্রায় ২৫-৩০ জন নিয়ে রওনা হই। রাতে স্বরূপকাঠীর সংগীতকাঠী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে দরবার শরীফের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আমরা এবং জাহাঙ্গীর বাহাদুরের দল দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে আক্রমণ করি। বলতে গেলে সারারাত যুদ্ধ হয়। চারদিকে অবস্থান নিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য ভাগে ভাগে বিশ্রামে যাই। সে সময়ে আমার দলের মতি কাজী পীরের বাড়ির পেছনে একটি কলা বাগানে বিশ্রাম নেন। তখন আবু জাফর মোহম্মদ সালেহ্ মতি কাজীকে সেখান থেকে ধরে দরবার শরীফে নিয়ে যায়। এ খবর পেয়ে আমরা আবার সকালে আক্রমণ করি। কিন্তু আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ফিরে আসি। এর পর থেকে মতি কাজীকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স থেকে শুনেছি মতি কাজীকে কেটে টুকরো টুকরো করে সন্ধ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম অনেক যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে ছারছিনা দরবার শরীফে হত্যা করা হয়েছে। লাশ টুকরো টুকরো করে তারা সন্ধ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।

 

যুদ্ধের সময়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মতি কাজীকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়েছে যে ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে সেই যুদ্ধাপরাধী আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ্র গলায় স্বাধীনতা আর একুশের পদক । স্বাধীনতাবিরোধীদের গলায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমার প্রশ্ন, হাজার হাজার দেশপ্রেমিক যোদ্ধা তাঁদের প্রাণ দিয়েছিলেন এ দৃশ্য দেখার জন্য? কয়েক লাখ মা-বোন তাঁদের সতীত্ব হারিয়েছেন কি এর জন্য? সবচেয়ে আমার দুঃখ, দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার অনাহারে দিন কাটায় আর যুদ্ধাপরাধী আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ্ পায় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক আর একুশের পদক। যুদ্ধকালীন সময় যার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা এ দেশের নিরীহ জনগণকে ধরে নিয়ে টুকরো টুকরো করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। অথচ তারাই আজ পুরস্কৃত হচ্ছে। লজ্জায়, ঘৃণায়, বেদনায় মুখ লুকায় মুক্তিযোদ্ধারা। এই কষ্ট, এই বেদনা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। কতদিন চলবে এই অরাজকতা? কবে এদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হবে? কবে আমরা দেখব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার?

______________________________

লেখক বেণুলাল দাশগুপ্ত : মুক্তিযুদ্ধের বেস কমান্ডার, বানারীপাড়া, বরিশাল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়