Ameen Qudir

Published:
2018-12-29 21:04:41 BdST

বাঙালির হেশেলেবাঙালির হেশেলে দক্ষিন আমেরিকার অনুপ্রবেশের কিছু বিবরণ




আজিজুল শাহজী
__________________________

ইদানিং যাই লিখছি তাতে কেউ না কেউ অনুভূতিতে আঘাত পাচ্ছে। তাই ভাবলাম একটু নিরীহ কিছু লিখি, এই কারণে বিজ্ঞান বা ধর্মের বিষয় একটু দূরে রেখে অন্য কিছু লেখার চেষ্টা করছি। বছরের শেষ দিনগুলো একটু ক্যাচাল কম করার চেষ্টা ভাবতে পারেন।আগে ইতস্ততঃ অনেক জায়গায় বলেছিলাম বা লিখেছিলাম যে আমরা অনেক সময় অনেক কিছু কে নিষিদ্ধ বলে হেঁশেলে ঢুকতে দেই না অথবা ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানে নানান আনাজ মশলা ইত্যাদির প্রবেশ নিষিদ্ধ করি অথচ প্রচলিত গুলো কে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলি।

গোটা ইসলামী শাসন বা তার আগের সময়ে গোটা ভারতবর্ষ অথবা যদি ছোট আঙ্গিকে বাংলা কে নিয়ে ভাবি তা হলে আমাদের হেঁশেলে রন্ধন এক অতীব উচ্চমার্গের শিল্প ছিল। বাংলা প্রবল মাংসাশী এবং এক পর্যায়ে বৌদ্ধ বা পরবর্তীতে চৈতন্যদেবের কারণে নিরামিষাশী হলেও নানান পদের বৈচিত্র ছিল যথেষ্ঠ তবে তা প্রবলভাবে ঘি ইত্যাদির সংযোগ যুক্ত ছিল। মনসামঙ্গলের বা ধর্মমঙ্গলের মতো আঞ্চলিক কাব্যে যা দেখছি তাতে মনে হয় তখন বা এখনো আমরা অনেকটাই খাওয়ার জন্যই বাঁচতাম অন্তত এক বড় অংশের মানুষ। কোথাও কোথাও তো সন্ন্যাসীদের আপ্যায়িত করা হয়েছে মাংস দিয়েও সুতরাং বেশ ঝালে ঝোলে ছিলাম আমরা। দাঁড়ান ,ঝালে ঝোলে ? একটু কোথাও বোধহয় তাল ঠিক ছিল না। অনেক কিছুই তখন ছিল না ,আজ কি ছিল না তার কিছু ফিরিস্তি দেওয়ার জন্য এই লেখা। অর্থাৎ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম এর বদলে ,যুগের সাথে কি ভাবে আরো সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের হেঁশেল বা রন্ধন শিল্প তার এক পর্যায়ে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার বিবিধ বস্তু কি ভাবে আমাদের বৈচিত্র দিয়েছে তার উপর আলোচনা করতে আজকের এই লেখা। আসুন এই বিষয়ে জানি কি কি পেয়েছি গত দুই শতকে,হ্যা ,এই দুই বা আড়াই শতকেই পেয়েছেন এতো সব পরিচিত ফল বা আনাজ যে অবাক হয়ে যাবেন এইগুলো ছাড়া চলছিল কি করে আগের মানুষরা!

 

কলম্বাস সাহেব মানে মূলত ইতালিও এই ভাগ্যান্বেষী মানুষটি ১৪৯২ সালে নিনা,পিন্টা আর সান্তা মারিয়া নামের তিন জাহাজ নিয়ে সেই যে আটলান্টিকের ওই দিকে নোঙ্গর করেছিলেন তারপরে আমাদের রসনার এক নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল। আগে ইউরোপ আর এশিয়ার এই খাদ্যবিনিময় বা অন্য সামগ্রী বিনিময়ের জল বা স্থলপথে বিনিময় মানে বাণিজ্য হলেও একদম অপরিচিত সব বস্তু হয়ে উঠলো সবার নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু।অথচ মজার কথা দেখুন ,এই কলম্বাস যে ভারতের জলপথ খুঁজে বের করতে অভিযান করেছিল সে তার নিজের পুরো জীবদ্দশাতে জানতেও পারেনি যে তার অভিযানের ওই অঞ্চল ভারতের কোনো অংশই না।
মজার হলো কলম্বাসের অভিযানের কিছু পরেই মানে ১৪৯৮ এ ভাস্কো ডা গামা কালিকট ধরে জলপথের হদিশ পেয়ে গিয়েছিল যা আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য তার আগে পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিল ইউরোপের থেকে।এই গামা সাহেব নিয়ে আসে আজকের অতীব পরিচিত একটি বস্তু,মানে লঙ্কা (পূর্ববঙ্গে যাকে মরিচ বলে ) এইদিকে এনে। মজার হলো,পর্তুগাল এই লঙ্কা পেয়েছিল কলম্বাসের কল্যানে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আর ছয় বছর বাদে ওই ১৫ শতকের গোড়াতে পেলাম আমরা। উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়লো একশো বছরের মধ্যেই। অর্থাৎ মাত্র শ চারেক বছর আগে আমরা লংকার ব্যবহার কিন্তু জানতাম না!তাহলে ঝাঁল খেতাম কি ভাবে ? ওটার জন্য নির্ভর করতাম গোলমরিচের উপরে। আজ কিন্তু আমরা মানে ভারত এই লঙ্কার সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী দেশ !

এতেই শেষ না ,সবচেয়ে বেশি যে আনাজ মানে তরকারির তা সে আমিষ বা নিরামিষ যাই খান না ,সেই আলু ও শ পাঁচেক বছর আগে আমাদের পরিচিত ছিল না। এক পর্যায়ে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে মহর্ষি ত্রৈলোক্যনাথ এই আলুর এক প্রজাতি টপিওকা ইত্যাদি খাওয়ানোর এক মহতী প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ সাধারণ গরিব মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয় করেছিলেন ভুট্টার মাধ্যমে। যাক সে কথা,অভ্যেস খারাপ তাই বেলাইনে চলে যাই ,আলুতে আবার আসি।মজার কথা হলো ইনকা সভ্যতার ওই মানুষগুলো কিন্তু আলু খাচ্ছে প্রধান খাদ্য হিসেবে সেই হাজার পাঁচেক (অন্ততঃ হাজার সাড়ে তিন তো বটেই)বছর ধরেই।তাঁরা এই আলু দিয়ে রুটি পর্যন্ত বানিয়ে খেতো (আলুর আটা ধরণের বিষয়),ইনকা সভ্যতার মূল জায়গা বলিভিয়া বা পেরু (মাচুপিচুর স্মারক নিশ্চই জানেন ) তে এর নিদর্শন কিন্তু প্রমাণিত ! এই আলু কলম্বাস পরবর্তী সময়ে মানে ধরুন ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ইউরোপের বাজারে আসে। প্রথমে মানুষ নেয় নি পরে করেছে অতীব আপন। জার্মানি বা আয়ারল্যান্ডের এক প্রধান খাদ্য উপাদান হয়ে ওঠে এই আলু। এই উপমহাদেশে ঢুকেছে সপ্তদশ শতকের গোড়ায় বা ষোড়শ শতকের শেষের দিকে। জানি না ঠিক কোন সময়ে তবে এটা মাত্র শ তিনেক বছরের মধ্যেই যে এসেছে ওটা কিন্তু সত্য। অর্থাৎ আমাদের দু তিন পুরুষ আগের মানুষ আলু বস্তুটি কি জানতেন ই না ! অথচ আজ আলুর দম থেকে নানান রান্না বা ধরুন আমাদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প চপ ইত্যাদি ও এই আলু ছাড়া আর ভাবা যায় ? এতেই শেষ না,ধরুন পরিচিত মিষ্টি কুমড়ো বা পাতের অতীব পরিচিত টমেটো সেই শ তিনেক বছর আগেই পেয়েছি। কলম্বাস টমেটো ভেট দিয়েছিল স্পেনের রাজপরিবার কে , এই অদ্ভুত লাল টমেটো অনেক দেরিতে এই এশিয়াতে আসে স্পেনের কলোনি ফিলিপাইনস এ আবাদ হয়ে। এরপর ক্রমশ ঢুকেছে আমাদের এই উপমহাদেশে। আর মিষ্টি কুমড়ো ?একই ভাবে সমাদৃত হয়েছে এই দিকে। আজ ভাবতে পারেন এইগুলো ছাড়া ?

এই উপরে বলা টমেটোর মতোই আমাদের পরিচিত বাদাম মানে চীনা বাদাম ও কিন্তু কোনো চীনা প্রভুর আমদানি না। এটি এসেছে সেই কলম্বাসের অভিযানের সুবাদে এবং সেই ইনকা সভ্যতার মানুষদের থেকেই। আজ চীন এর সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করলেও এর চারা এসেছে সেই সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকেই। এরপর ধরুন আনারস ফলের কথা,আনারস নামের এই সুধারস আরো পরে এসেছে কিন্তু আমাদের এইদিকে। কলম্বাস পরবর্তী যুগে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা এই ফল স্পেন হয়ে অনেক পরে ঢুকেছে সেই ফিলিপাইনসে আর তারপর ধরুন শদুয়েক বছরের মধ্যে পেয়েছি আমরা। এতেই শেষ না কিন্তু!অতীব পুষ্টিকর পেঁয়ারা ও কিন্তু আমাদের এইদিকে ছিল না ! এটি ও এসেছে সেই দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে কলম্বাসের প্রদর্শিত পথ ধরেই !

এরপর ধরুন চিরপরিচিত পেঁপে নামের বস্তুটি। এর পাঁকা বা কাঁচা অবস্থায় অতীব সুপাচ্য এবং উপকারের কথা আমরা তো সবাই জানি। এই উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই পেঁপে যা এসেছে সেই কলম্বাসের জলপথ ধরেই আর তার আগে কিন্তু আমরা এর পরিচয় জানতাম না ! ও,বলতে ভুলে গিয়েছি এর উৎপত্তি যতদূর জেনেছি সুদূর মেক্সিকো অঞ্চলে। মানে আরো পরে আমাদের কাছে এসেছে ওটা ভাবতেই পারেন।

উপরে যেমন বলেছিলাম,দুর্ভিক্ষ অনাহারে অগুনতি সাঁওতাল সম্প্রদায়কে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় ভুট্টা কিনতেন এক দল সাঁওতালের থেকে আর ওটা আবার আরো একদলের কাছে বিলি করতেন যাতে দুদল মানুষ বেঁচে থাকে সেই অকালে। এই ভুট্টা ও আমরা পেয়েছি সেই কলম্বাসের অভিযানের হাত ধরেই। আজ পপকর্ন বা পুড়িয়ে অথবা অন্যভাবে যা খাচ্ছেন তার জন্য দায়ী সেই কলম্বাস ! প্রসঙ্গত বলে রাখি বিশ্বে আমাদের দেশ ভারত আজ ভুট্টা উৎপাদনে ছয়নম্বর দেশ কিন্তু !

আবার ধরুন আরো পরে আসা কোকো নামের বস্তুটির কথা। এর থেকে চকলেট নামের লোভনীয় বস্তুটি বা ধরুন পরিচিত কোকাকোলা ইত্যাদির খোঁজ পেতেন ই না যদি না কলম্বাসের হাত ধরে এই বীজ ইউরোপে না ঢুকতো। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো চকলেট হিসেবে ব্যবহারের কাজ অবশ্য ইউরোপেই শুরু হয় ১৫ শতকের গোড়ার দিকে ,এর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা মূলত এটিকে পানিও বা ধর্মীয় কিছু উৎসবে পান করার সামগ্রী হিসেবেই ব্যবহার করে থাকতো। কোকো নামের এই গাছ আরো লাগতো চিকিৎসা ইত্যাদিতে।

এছাড়া এসেছে ক্যাপসিকাম যা অতীব সম্প্রতি মানে এই শতকে আমাদের কাছে পরিচিত হয়েছে যদিও ইউরোপে পরিচিত হয়েছে সেই সময়ের থেকেই।আরো এসেছে সূর্যমুখী এবং তার থেকে পাওয়া তেল যা আগে ইউরোপ বা অন্য জায়গায় অপরিচিত ছিল।একই সাথে মানুষ পরিচিত হয়েছে ভ্যানিলা নামের বস্তুটির সাথে বা স্কোয়াশ নামের ফলটির সমন্ধে।

শুধু হেশেল দিয়েই শেষ করলে অপুর্নতা থেকে যাবে তাই বলে রাখি ম্যালেরিয়া রোগের দাওয়াই হিসেবে পাওয়া কুইনিন ও ওই দক্ষিন আমেরিকা থেকেই আমরা পেয়েছি কিন্তু!

সবই কি ভালো এসেছিল ?
উহু , উপরে বলা কোকো ইত্যাদির থেকে এসেছে কোকেন আরো এসেছে একটি কুঅভ্যাস ,আজকে বিব্রতকর একটি নেশা মানে ধূমপান করা ও এসেছে এই অঞ্চলের ইনকা বা রেড ইন্ডিয়ানদের থেকেই।এই মানুষগুলো অন্তত হাজার তিনেক বছর আগের থেকেই এই তামাক উৎপাদন আর তার থেকে ধূমপানের রীতি চালিয়ে গিয়েছিল। অনেক দেরিতে মানে সেই সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজদের হাত ধরেই এই কুঅভ্যাস আমদানি হয় আমাদের এই উপমহাদেশে।

কি পেয়েছিল ওই দক্ষিন আমেরিকার আদি বাসিন্দারা ?
এক কথায় স্থানীয় অধিবাসীরা প্রায় কিচ্ছু না!একটি পরিসংখ্যানে দেখছি,কলম্বাসের সময়ে আড়াই লাখের মতো অধিবাসী ছিল যার অবশিস্ট ১৫ হাজার রয়ে যায় ১৫ শতকের শুরুতেই না , স্রেফ হত্যা না ওটা হলেও মূল কারন ছিল ইউরোপের তথাকথিত সভ্যতার আমদানি করা বিবিধ রোগ যার প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না এই দুর্ভাগা মানুষগুলোর ফলে বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে!তবে সে এক অন্য কাহিনী ...অন্য কোনদিন এই নিয়ে অল্প স্বল্প লিখতে আগ্রহী

এত কিছুর পরেও একটাই কথা বলে যাই, মানুষের প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে সাহায্য করেছে যা তা হলো তার চরৈবতি মানে চলমান হওয়ার আর একের চিন্তা অন্যের সাথে বিনিময় করার মানসিকতা ।মনে রাখবেন, রক্ষনশীলতা কোনো দেশ বা জাতির মঙ্গল সাধন করে নি।যে জাতি বা দেশ নিজেকে পৃথিবীর সাথে একাত্ব করেছে বা নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই জাতিই উন্নতি করেছে , মানুষের সার্বিক মঙ্গল ও নিহিত রয়েছে এই প্রসারণ আর পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঠিক যেমন অশেষ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলন ,”যে নদী হারিয়ে পথ চলিতে না পারে সহস্র শৈবাল্দাম আসি তারে বাঁধে “ ঠিক এই কারণেই ভুবন গ্রামে একা থাকা মানেই নিজের বিনাশের পথ পরিস্কার করা।আপনার আমার হেশেল এর ব্যতিক্রম না !

তথ্যসূত্র :
১. https://www.kellogg.northwestern.edu/…/reso…/NunnQianJEP.pdf
২. https://www.scholastic.com/…/t…/columbian-exchange-overview/
৩. কি খেতো ইউরোপ বা আমাদের পূর্বপুরুষ দক্ষিনের এই বস্তু গুলো আসার আগে https://www.nytimes.com/…/de-gustibus-historian-s-menu-what…
৪. https://www.thespruceeats.com/foods-america-gave-the-world-…
_______________________

আজিজুল শাহজী। প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক। থাকেন কলকাতায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়