Ameen Qudir

Published:
2018-12-08 21:30:10 BdST

পরকীয়া কারে কয় !


 

দেবব্রত তরফদার
________________________________


প্রেম ব্যাপারটা বুঝেছিলাম প্রথমে বেতার নাটক থেকে । তখন বিনোদন বলতে রেডিও , আর বাড়ির বড়রা মুখিয়ে থাকতো অনুরোধের আসর , পুজোর গান , বিবিধ ভারতীর প্রোগ্রাম , বিনাকা গীতমালা এবং অবশ্যই বেতার নাটকের জন্য । যেহেতু কান বন্ধ করার উপায় নেই তাই অলিখিত ছাড় ছিল বেতার নাটক শোনার । তবে বাংলা ভাষার অনেক ক্ল্যাসিক বই এর নাট্যরূপ পড়ার আগেই শুনেছি । বই পড়ার আগ্রহের বীজ হয়তো এর মধ্যেই ছিল। আরণ্যক , ঝিন্দের বন্দি ক্ষুদিত পাষাণ , পদ্মা নদীর মাঝি , বিসর্জন এইসব নাটকের কুশীলব জগন্নাথ বসু , শম্ভুমিত্র নির্মলকুমার , আজিতেশ , তৃপ্তি মিত্র , নীলিমা দাস এঁদের কন্ঠস্বর এখনো কানে বাজে । আর স্বভাবতই পেকে ঝুনো হয়ে গেলাম খুব তাড়াতাড়ি । এর আগে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বড় দাদা দিদিদের লুকিয়ে পড়ার কারন বুঝতে শিখে গেলাম। গ্রামে দারিদ্র এবং আশিক্ষার সঙ্গে খিস্তি গালাগালির সম্পর্কটি নিবিড় । সেকারনে অতি খারাপ খারাপ কথা শিখে গেলাম অতি কম বয়সে । নিজেদের মধ্যে চলতো কিন্তু মায়ের কানে গেলে হাড়মাস আলাদা হতে পারে । মা ছিলেন অসম্ভব শান্ত কিন্তু রাগলে বাঘ , তাই সমঝে চলেছি। খিস্তি মানে বৈধ এবং অবৈধ যৌন সম্পর্ক , যৌনক্রিয়া এবং যৌনাঙ্গ সংক্রান্ত শব্দ । অচিরে তাদের মানেও বুঝে গেলাম । নাং মানে উপপতি আর নাংকরানি মানে সেই মহিলাও যিনি পরকীয়া করেন। পরে বুঝেছি এই ছোট বয়সে এসব ব্যাপার বুঝে যাবার কষ্ট অনেক । তারপর তো কৃষ্ণনগর চলে আসলাম ।গ্রামের সঙ্গে যেহেতু যোগাযোগ ছিল তাই পরবর্তী সময়ে পরকীয়ার আকছার ঘটনা দেখেছি । তার বিচারসভাও বসতো একটু বেশি রাতে । লুকিয়ে দেখা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও শুনেছি। এবং কিশোর বয়সেই বুঝে গেলাম পরকীয়া মানে
" নিকষিত হেম " নয় এবং কামগন্ধেই পরিপূর্ণ অর্থাৎ ব্যাপারটা অবৈধ দেহজ সম্পর্কেই মধ্যেই পড়ে ।
পরবর্তীতে আরো কতকিছু দেখলাম । গুগুলে দেখেছি পরকীয়ার বারোটি কারন দেখিয়েছে । কিন্তু পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে দেখে কিছু ধারণা হয়েছে । প্রথমত দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে অনেকে বৈচিত্র্য চায় । এর মধ্যে কিছু পুরুষ /মহিলা দেখেছি যাদের কাছে শরীর এতটাই প্রাধান্য পায় যে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষের দীর্ঘ দাম্পত্যকাল প্রেমহীন , এমনকি অতি তিক্ততার । সম্পর্কের বোঝাকেই টেনে নিয়ে যেতে হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় চেহারা , সামাজিক অবস্থান , অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা , মানুষটি অনেক পরে । কাজে কাজেই সমস্যা পরেই। স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে না থাকে ভালোবাসা , মমত্ববোধ , না থাকে পারস্পরিক সম্মান । সমাজ ,সন্তান এসবের জন্য থাকে আত্মত্যাগ তাই পরিবার ভাঙেনা। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের পরকীয়া মেনে নিয়েছে চিরকাল , মহিলাদের ক্ষেত্রে নৈব নৈব চ । অতীতে আরো বেশি ছিল , বহুবিবাহ , পরনারী গমন , বাঁধা মেয়েমানুষ রাখা , রাঁড় বাড়ি যাওয়া এসব সমাজের চোখে দোষের ছিলনা । কারণটা অর্থনৈতিকও বটে কেননা পরিবার ভরণপোষণ এর ভার পুরুষের । স্ত্রী শিক্ষা , মহিলাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এসব কারণে মহিলাদের পরকীয়া দৃষ্টিগোচর হচ্ছে । কেউ কেউ একপেশে ভাবলেও কিছু করার নেই তবে বহু মেয়েকে অসম্মানের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয় । চাকুরীরতা স্ত্রী কে স্বামী বলছে -- তোকে দেখতে বিশ্রী , তোর টাকার জন্য তোকে বিয়ে করেছি। এমন স্বার্থপর বিবেকহীন মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে হচ্ছে সন্তানের কথা ভেবে। স্বামীর যৌনমিলনের ক্ষমতা নেই , মেয়েটির বাড়ি থেকে বলছে -- মানিয়ে নে । মেয়েটি গৃহবধূ , তার বাড়িতে সাপোর্ট দেবার কেউ নেই। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলে অন্য কথা ছিল। একজন স্ত্রীকে জানি মাসপয়লাতেই ব্যাংক চাকুরে স্বামীর বেতনের সব টাকা কেড়ে নিয়ে দৈনিক দশ টাকা হাতখরচ দিত । স্বামীকে শারীরিক সান্নিধ্য দিত না । বেচারা । যৌন সম্পর্ক কে প্রথম থেকেই অপরাধের চোখে দেখা হয় । মায়েদের অতি সাবধানতার কারনে মেয়েরা স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপন করতে পারেনা । সেখান থেকে হাজারো সমস্যা । এর বাইরে আছে হাজারো কারন , সব ব্যাখ্যা সবাই দিতে পারবে না। অনেকক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যাই নেই। উপযুক্ত সক্ষম পুরুষ , ব্যাংক চাকুরে তার বউ পালিয়ে গেল সব্জিওয়ালার সঙ্গে। আবার ঘরে সুন্দরী অল্পবয়সী বউ থাকতে যে মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক সে পাঁচ সন্তানের মা যার বড় ছেলের বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গেছে । এর ব্যাখ্যা দেওয়া আমাদের কম্ম নয় । তেনারাই বলবেন।

পাড়ার একটি ঘটনা । বৌদিটি একটু ইলিক ঝিলিক প্রকৃতির । পাড়ার দেওরদের আদর আপ্যায়ন হয় খুব। সব পাড়াতেই এরকম পাওয়া যায় । আর দাদাগুলো হয় একটু বোকা## টাইপের । এই দাদার তুতো বোনটি ছিল অসুস্থ , তার স্বামী ডাকসাইটে কন্ট্রাক্টর । তা অসুস্থ বউয়ের জন্য কন্ট্রাক্টর বাবুর শরীরে মনে সুখ নেই । তা শালাজ বউ ঠাকুরজামাইটিকে একটু বোধহয় করুণা করলেন । তা নন্দাই মশাই এর দশগুণ ফিরিয়ে দিলেন স্থাবর অস্থাবরে ।বোকা## স্বামীটি দেখলো -- বাহারে এতো মজা কম নয় । দূর্দার দোতলা উঠে গেল , চকাচাক বার্জার পেন্টস । এদিকে ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে আবার পারিপার্শ্বিক চাপে পৌরুষ জেগে ওঠে এবং হুড়ুম গুড়ুম চলে । স্ত্রীর ঘোষণা -- বেশি কিছু বললে ওর সঙ্গে চলে যাবো , তোর ছেলেমেয়ে নিয়ে তুই থাক । প্রথম রাতে যেহেতু বিড়াল মারতে পারেনি তাই স্বামী চুপ। আর নন্দজামাই শালাজ বউ এর আদর যত্ন পেতেই থাকলেন । সুবিধা প্রাপ্তির বিড়ম্বনা আর কি।
অন্য গল্প অবশ্য আছে । আমার এক ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু বিয়ে করেছিল খুব কম বয়সে । বিরাট ধনী । সন্তানাদি ছিল না । চল্লিশের পর কি হল জানিনা বেপরোয়া জীবনযাপন করতে শুরু করে। সোনাগাছির এক মহিলার সঙ্গে স্থায়ী জীবনযাপন করতে লাগলো । ফুর্তি করতে বিদেশেও যেত । অবশ্য অন্য মহিলার সঙ্গে । তিনপুরুষের ব্যবসা চৌপাট । ব্যাঙ্কে স্থাবর সম্পত্তি মর্টগেজ । সে টাকাও শেষ । ফুর্তিরও বিরাম নেই । একটি বাচ্চা আড্যাপ্ট করেছিল তাদেরকেও দেখেনা । সোনাগাছির ওই মহিলা ফুর্তির জন্য তার সারা জীবনের সঞ্চয় খরচ করে। বন্ধুটি তার বাড়িতেই মারা যায় আর ওই মহিলা তার বাবুর জন্য সারাজীবনের সঞ্চয় খরচ করে ভিখারিনী ।
মহিলাটি পাশের বাড়ির বৃদ্ধা মহিলাকে দেখাশোনা করতেন। মানে আয়ার কাজ করতেন। অল্প বয়সে এদের বিয়ে হয় এবং ছেলে মেয়ের বিয়ে থা হয়ে গেছে । স্বামীটি রিকশা চালায় নেশাও করে ,আর ভাত দেবার ভাতার না হলেও কিল মারার গোঁসাই বটে। তা নাতিনাতনি হয়ে গেলেও মহিলাটি এখনো ডাগরডোগর আছে। ভোরবেলায় চলে আসে রোগিণীর সেবায় । তখন ড্রেন পরিষ্কার করতে আসে যে জমাদার ছেলেটি নাম তার শ্যাম। শেফালী, মানে মহিলাটির সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি মাঝেমধ্যে । ওই বাড়ির গৃহিণী মারফত আমার গৃহিণীর কাছে খবর এসেছে যে শ্যামের বউ ভোকাট্টা আর শ্যামের সঙ্গে চলছে শেফালির । ছেলেবেলায় বিয়ে হয়েছে বেচারির তার এই পরকীয়া প্রেমের গল্প আগ বাড়িয়ে অন্য লোককে শুনিয়ে যাচ্ছে। স্বামীর সঙ্গে বেধে গেছে এবং সে বেপরোয়া। গিন্নি বলার পর দুজনকে দু একদিন লক্ষ্য করেছি ছেলেটি প্রায় তিরিশ মহিলাটি পয়তাল্লিশের আশেপাশে।একটু বিসদৃশ্য লাগে বই কি ।এর মধ্যে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা মারা গেলেন । আর শেফালির খবর পেলাম না। পরে একদিন গিন্নি বলে শেফালী বিয়ে করেছে শ্যামকে । ওর বর হেভি ঝামেলা করে কিছু করতে পারেনি। ছেলেমেয়েরা মাকে সাপোর্ট করেছে। শ্যাম আর শেফালীকে আয়ার কাজ করতে দেয়নি। আমারও কৌতূহল ছিল না । আজ সকালেই বউ বললো -- পাশের বাড়ির বৌদি শেফালীকে দেখতে গিয়েছিল, ওর ইউট্রেসে টিউমার হয়েছিল অপারেশন হয়েছে । জমাদার ছেলেটির পরিবারের লোকজন এসে শেফালীর দেখভাল করছে । বৌদির কাছে শেফালী কেঁদে বলেছে -- জীবনে অনেক পুণ্য করেছে , শ্যামের জন্য সে মরতেও পারে। তাহলে কে বলে পরকীয়া শুধু দেহজ , স্থূল সম্পর্ক । এইহল পরকীয়ার প্রেম মাহাত্য । চন্ডীদাসের " নিকষিত হেমের " অস্তিত্ব এখনো আছে হয়তো।
কে এর কি ব্যাখ্যা দেবে কে জানে । মানুষের মন , অরূপরতন , সেই পরমধনের তল পাওয়া মুশকিল। তাই ফিরে যাই কয়েকশ বছর আগে।
কত মধু যামিন রভসে গোঙায়লু
না বুঝলু কৈছন কেল ।।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তবু হিয়ে জুড়ন না গেল ।।
( এই লেখাটি কি দাঁড়ালো জানিনা , কে কিভাবে নেবেন কে যা জানে । তবে কোনোটাই জীবনের বাইরে নয় । এইসব নিয়েই তো জীবন । )
(ছবিটি প্রাসঙ্গিক নয় , তবে দৃষ্টি আকর্ষণকারী)
___________________________

 

লেখক দেবব্রত তরফদার। শক্তিধর কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়