Ameen Qudir

Published:
2018-12-04 22:27:46 BdST

অভিযোগ শব্দটি নিয়ে অভি যোগ ও অন্যান্য


 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
__________________________

অভিযোগ - এই শব্দটি কতই না ব্যবহার হয় প্রতিদিন । কেমন করে এলো এই শব্দটি ! কেন = অভি + যোগ =অভিযোগ । আজ্ঞে না , বন্ধু । শব্দ টা দেখে সংস্কৃত মনে হচ্ছে তো !! অভি একটি উপসর্গ , বসল যোগ শব্দের আগে । এমনিতে অভি - যোগ করলে কিন্তু শব্দের মানে তেমন একটা পালটায় না । জোরটা একটু বাড়ে । - যেমন শাপ আর অভিশাপ , নিবেশ আর অভিনিবেশ । তাহলে দাঁড়াল কি - অভি অর্থাৎ অতিরিক্ত যোগ । এর মানে কি ? কিছুই নয় । শব্দ টাই ভুল , মধ্যযুগের সাহিত্যে কোথাও অভিযোগ শব্দের উল্লেখ নেই । এই শব্দটির প্রতিশব্দ পারসি ভাষা থেকে আসা - নালিশ । সংস্কৃত পন্ডিত দের সেটি সহ্য হয়নি । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এক বার লিখেছিলেন , 'যে পারস্য ভাষায় ৭০০ বৎসর ধরিয়া আমাদের দেশের প্রধান প্রধান কার্য সম্পন্ন হইয়া আসিতেছে , বাংলা ব্যাকরণের সহিত যে ভাষা হাড়ে হাড়ে বিন্ধিয়া আছে , আমরা প্রাণপণে সে ভাষার কথাগুলি লিখিত ভাষা হইতে দূর করিবার চেষ্টা করি '।
মুশকিল হল , যাঁরা এই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন , সকলের সম্যক সংস্কৃত জ্ঞান ছিল না । তাই এই অবস্থা । এটাকেও ভাষা -মৌলবাদ বলাই যায় । হঠাৎ করে মনে হল আইন কথাটি বাদ দিতে হবে। অবশ্য বাংলায় এটি এখন-ও হয় নি । হিন্দিতে হয়েছে । ন্যায়জীবি হল । মুশকিল এই যে , যিনি বিচারক বা বিচারপতি , তিনি-ও যে ন্যায়জীবি , ন্যায় বা আইন প্রয়োগ করেই তাঁর জীবিকা নির্বাহ হয় । ইংরাজি AVAILABLE শব্দ টি হিন্দিতে করা হল উপলব্ধ । কিন্তু উপলব্ধ শব্দটির মানে -- যা পাওয়া পাওয়া যাবে -- হওয়া উচিত = উপলভ্য । এখন তো পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলায় ভালোই ব্যবহার হচ্ছে এই ভুল শব্দ ।।

দুই .
___

মৌলবাদী দের সামনে আরো রাস্তা খুলে দিয়েছে , হিন্দী বানান অনুকরণ করা । পাটনা , গোয়ালিয়র , শব্দ ইদানীং একটি প্রভাবশালী সংবাদ গোষ্ঠী লিখছেন পটনা , গ্বালিয়র ।এঁরা হয়তো ভাবেননি বা গ্রাহ্য করেননি হিন্দিতে 'অ' স্বরবর্ণ টি উচ্চারণ হয় না বাংলার মতো , উচ্চারণ অনেকটা হ্রস্ব -আ , হিন্দি হলচল শব্দটি টি উচ্চারণ করলে কি হয় সক্কলে জানেন । হিন্দি পটনা উচ্চারণ যা হয় তার কাছাকাছি কিন্তু পাটনা -ই হয় বাংলাতে , এক-ই বর্ণের উচ্চারণ -ও কিন্তু বিভিন্ন ভাষায় আলাদা । ধরুন গ্বালিয়র বাংলাতে উচ্চারণ হবে , গালিয়র , কারণ প্রথম অক্ষরের অন্তঃস্থ ব-ফলা বাংলায় উচ্চারিত হয় না , সন্দেহ হলে জ্বালা বা স্বপ্ন উচ্চারণ করে দেখুন । বাংলায় গোয়ালিয়র -ই সবচেয়ে ভালো উচ্চারণ ছিল । যে সব তদ্ভব শব্দ তে সংস্কৃতর অন্তস্থঃ ব উচ্চারিত হয় সেগুলো পালটে আমরা করে নিয়েছি ' দুয়ার' বা 'সোয়ামী' । 'এলাহাবাদ ' না লিখে যারা 'ইলাহাবাদ' লিখছেন তাঁরা কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে , এটি বাংলার মুল নিয়ম বিরোধী ( এখন অবশ্য মূলে অর্থাৎ ' প্রয়াগ রাজে ' পরিবর্তিত হয়েছে) । এটাকে পণ্ডিত জন স্বর -সঙ্গতি বলে থাকেন । এর জন্যেই বিড়াল হয়েছে বেড়াল আর ভিজা হয়েছে ভেজা । এমন কি আরবি ইলাহী শব্দ -ও , বাংলায় এলাহী বলা এবং লেখা হয় । অতএব এর পরেও ইলাহাবাদ লিখলে বাংলা ভাষার অপমান বই আর কিছু করা হয় না । নমস্কার।
পুনশ্চ -- বার্ডোয়ান যদি বর্ধমানে ফেরে, চিনসুরা চুঁচুঁড়া তে, এলাহাবাদ ই বা প্রয়াগ রাজে নয় কেন?

তিন.
______

আমি সমাজবিজ্ঞান জানিনে, কোন সমীক্ষাও করিনি। তবে গত দিন দশেক ধরে একটা ভাবনা খুব উথাল পাতাল করছিল আমার অন্দরে ও অন্তরে। লিখে ফেলি।
এতোবড়ো ভারত, অনেক ভাষা, অনেক খাদ্যাভ্যাস, অনেক রকম পোষাক, বৈচিত্র‍্য অনেক। তবু তারো মধ্যে একটি সুর, একই রাগে বাজে সর্বদা। তা হলো মহাভারতীয়তা। বেশির ভাগ মানুষ ই আগে প্রবল ভাবে ভারতীয়। পরে তার ভাষা বা প্রদেশ। আমি ধর্ম কে আদৌ গুরুত্ব দিতেই রাজী নই, কারণ একজন মানুষ, এক জীবনে দুই বা তিন বার ধর্ম পরিবর্তন ও করতে পারে। কিন্তু মানসিকতা র প্রভেদ আছে বৈকি!
এখনকার উপমহাদেশে বহিরাগত হয়তো বা সাকুল্যে ৫%, বাকি ৯৫ শতাংশে র জিন ম্যাপিং এর ফল একই। মিশ্রণ ঘটেছে বিস্তর, রবীন্দ্র কবির ভাষায়, শক, হুণ, দল, পাঠান, মোগল, ইংরেজ, পর্তুগীজ ইত্যাদি।
কয়েক প্রজন্ম পরে কিন্তু সব স্বত্ত্বা ই মিশেছে ও মিলেছে ভারতীয়ত্বে।
কারো কারো কাছে ব্যবসায়ী স্বত্ত্বা টি প্রবল, কারো কাছে শিক্ষালাভ। কেউ স্বভাবে একটু অলস, কেউ বা স্বভাবতই কঠোর পরিশ্রমী।
সব প্রদেশেই একদল ব্যবসায়ী নির্ঘাৎ ছিলেন, কেউ কেউ কৃষক, বা অন্য শারীরিক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করত। একদল তখনকার শাসকদের করণিক ও ছিল বৈকি। বা বিভিন্ন সরকারি কাজে অনেকে চাকুরিও করতেন।
চন্দ্রগুপ্তের সময় থেকে মোগল আমল অবধি এরকম টাই ছিল মোটামুটি। সব প্রদেশেই।
পট পরিবর্তন হলো ইংরেজ রা ভারতের ক্ষমতায় আসার পরে। তারা কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা করে, সেখানেই প্রায় লন্ডনের আদলে ই নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে। এইবারে সরকারি কাজকর্ম ইংরেজি ভাষায় হতো বলে, কিছু দেশীয় মানুষকে ইংরেজি তে শিক্ষিত করা হলো নিজেদের ই কাজের জন্যে।
শুধু কলকাতা নয়, ইংরেজ দের আরো দুটি বড় কেন্দ্র ছিল, বোম্বাই এবং মাদ্রাজ । সেখানেও একই কাজ টি করা হলো, স্কুল কলেজ খোলা হলো। তাই, বঙ্গ, তামিল ও মারাঠা প্রদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও প্রচার হলো বেশি। তিন জায়গাতেই স্থানীয় বাঙালী, তামিল ও মরাঠীরা প্রচুর পরিমাণে সরকারি চাকুরি তে নিযুক্ত হলো।
কিন্তু গুজরাত বা রাজপুতানা বা মালাবার অঞ্চলে তা হয়নি। হয়নি পঞ্জাব এবং সিন্ধ বা বিহার, অাসাম ইত্যাদিতেও।
আর সার্বিক ভাবে ছোট ছোট দেশীয় করদ রাজ্যগুলিতেও একদল রাজকর্মচারী ছিলেন বৈকি।
কম বা ন্যূনতম ঝুঁকি, র নিশ্চিত চাকুরিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে পরের প্রজন্মের পক্ষে ব্যবসার ঝুঁকি নেওয়াও মানসিক ভাবে শক্ত বটে।

হয়তো এজন্যেই বাঙালী, তামিল, এবং মরাঠি খুব প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পাওয়া যায় খুব কম। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত ও শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষার দিকে এই তিন রাজ্যের মানুষ রা এগিয়ে ছিলেন অনেকটা ই। তদুপরি বঙ্গে দেশভাগ এবং ধর্মের নামে অধর্মের কারণে প্রচুর বাঙালী পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। তাঁরা শুন্য থেকে শুরু করে আগে তো থিতু হবেন, পরে ব্যবসার কথা ভাববেন,সেটিই স্বাভাবিক। ছোট ব্যবসা গুলি স্থানীয় মানুষরা করলেও প্রকৃত অর্থে শিল্পপতি হয়েছেন কম বাঙালী, কম মরাঠি ও কম তামিল রাই।
অথচ দেখুন এমন কি ব্রিটিশ রাজ চলাকালীন ও রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লঞ্চ ফেরির ব্যবসা ছিল, কিন্তু ইংরেজ দের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারেন নি।
একজন সূর্যসফল বাঙালী বা মরাঠি বা তামিল চিকিৎসক ও বড়জোর একটি নার্সিং হোম বা হাসপাতালের কথা ভাবেন বা তৈরী করতে পারেন, তবে বিভিন্ন রাজ্যে হাসপাতালের চেন এর কথা যদি আসে, তবে কন্নড় ডাঃ দেবী শেঠির নারায়ণ হৃুদয়ালয় বা নারায়ণ হাসপাতালের নামই শুধু মনে আসবে। অ্যাপোলো গোষ্ঠী র মতো বড় হাসপাতাল সারির শীর্ষে হয় রাজস্থানী নয় পারসিক টাটা গোষ্ঠী বা কন্নড় এসকর্ট গোষ্ঠী। গুজরাতি এবং রাজস্থানী, কন্নড়,পঞ্জাবী, উত্তর প্রদেশের কিছু গোষ্ঠী ও পারসিক রাই বিভিন্ন ব্যবসা ক্ষেত্রে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছেন।

মানুষের চিন্তা - ভাবনা ও পেশা যে অনেকটা ই পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এটিই তার সবথেকে বড় প্রমাণ ও বটে।।
*** মতামত ব্যক্তিগত ***।
কাউকেই ছোট বা বড় দেখানোর উদ্দেশ্যে ই লেখা নয় আদৌ।

_____________

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়