Ameen Qudir
Published:2018-11-27 01:16:05 BdST
একটি মোমবাতি ও এ কজন অমর শিক্ষক
ডা. মৃণাল সাহা
_____________________________
প্রফেসর ডা: এম, এ, খন্দকার,
এফ, সি,পি,এস (মেডিসিন),
এম.ডি ( কার্ডিওলজি)
বাংলাদেশের প্রবীণতম হৃদরোগ চিকিৎসক। বলা যায় বাংলাদেশের কার্ডিওলজির গুরুদের গুরু। সারাজীবন অজস্র মানুষের হার্টের চিকিৎসা দিয়ে এসেছেন। স্যারের খ্যাতি দেশ জোড়া, সারা দেশে উনার অনেক গুনগ্রাহী। মেজাজটা একটু কড়া বলে রোগীরা তার সাথে ভয়ে ভয়ে কথা বলত, রোগীরা এত আস্তে কথা বলত যে বেশীর ভাগ কথাই কান্নার মত শোনাত। এই প্রবীণ চিকিৎসকের ব্যক্তিত্বের কাছে কিছুই টিকতো না৷ রোগী অন্তপ্রাণ এই ডাক্তারের কাছে আসলে রোগীরা ভাবতো মৃত্যু পরাজয় মেনে নিয়েছে৷ তিনি হলেন বটবৃক্ষের পর্বতসম বিদ্বান ডা: খন্দকার এর বর্তমান বয়স ৮০ এর কাছাকাছি। তিনি এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আজ বাংলাদেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উনার অগনিত রোগী।উনার অনেক ছাত্রছাত্রী আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন দেশের আনাচে কানাচে। খন্দকার স্যার এমন কয়েকজন ডাক্তারকে নিজ তৈরী করেছেন যাদের মাঝে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন, হয়তো এটাকেই বলে প্রজন্মে বিলীন। এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল! এত ছাত্রছাত্রীর মাঝে সারা জীবনে হাতে গোনা কয়েকজনই উনার প্রিয় হতে পেরেছিলো। এদেরই একজন হলেন ডাক্তার রাজীব।
ডা: রাজীব শাহরিয়ার
এম.বি.বি.এস, এফ, সি, পি, এস।
এম.ডি ( কার্ডিওলজি),
এম, আর, সি, পি ( ইংল্যান্ড)।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়েকজন ইন্টারভেনশানাল কার্ডিওলজিষ্ট আছেন তাদের মাঝে ডা: রাজীব হলেন বেষ্ট অব দ্যা বেষ্ট। বয়স ৪৬-৪৭ হবে। মাঝারি উচ্চতা, একেবারে ফর্সা আর অদ্ভুত সুন্দর চেহারার অধিকারী ডা: রাজীব কে পছন্দ করেন না এমন লোক পাওয়া কঠিন।সবচেয়ে বড় ব্যপার হচ্ছে, তার আছে পরিশ্রম করার এক অদ্ভুত গুন আর প্রচন্ড আন্তরিক ব্যবহার। তার অসাধারন হাসি আর আন্তরিক উপদেশ শুনে অনেক রোগীই ভালো হয়ে যায়। কথিত আছে ডা: রাজীব এর চেম্বারে যে একবার যায় তাকে আর দ্বিতীয়বার সেই রোগের জন্য যেতে হয়না। কিন্তু মানুষ বারবার যায়, শুধু তাকে দেখতে, তার কথা শুনতে। নতুন কিছু উপদেশ এর আশায়। এত অল্প বয়েসে প্রফেসর হয়ে যাবার পরেও তার এতটুকু অহংকার নেই। গরীব, ভি আই পি সব রোগীই তার কাছে সমান।
(২)
ছাত্র অবস্থায় ডা. রাজীব সারাদিন ওয়ার্ডে পড়ে থাকতেন। অসম্ভব মেধা আর পড়াশোনায় নিবেদিত প্রান ছিলেন তিনি। সবাই তাকে মিষ্টার ডিপেন্ডেবল ডাকত। খন্দকার স্যার এর মত কঠিন শিক্ষকও ডা. রাজীবকে অন্যচোখে দেখতেন। স্যার সবার সামনে বলেই ফেললেন, আমি প্রয়োজনে মরে যাব, তবু রাজীব ছাড়া কাউকে দিয়ে আমার এঞ্জিওগ্রাম করাব না। আমার ছাত্র একজনই যা শেখার শিখেছে,আর বাকি গুলা সব আহাম্মক এর দল।সেদিন দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ চোখে পানি দিয়েছিলেন ডা. রাজীব। সেদিন তার এতটুকু অহংকার হয়নি বরং আরো অনেক বেশী দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। খন্দকার স্যার এখন রিটায়ার্ড। প্রফেসর ডা. রাজীব শাহরিয়ার এখন কার্ডিওলজির প্রধান। সম্ভবত তিনিই দেশের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপক।
খন্দকার স্যার মাঝে মাঝেই রোগীদের বকাঝকা করতেন। অনেক স্টুডেন্ড উনার ভয়ে কোর্স ছেড়ে দিত। একদিনের ঘটনা, স্যার তার রুমে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। ডা. রাজীব তখন পোষ্ট গ্রাজুয়েশান এর একজন ছাত্র। একটা গরীব রোগী। বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হল। জুনিয়র ডাক্তাররা কুল কিনারা করতে না পেরে স্যার কে কল দিলেন। স্যারের এই এক সমস্যা, উনার মুড বুঝতে পারা অনেক কষ্টকর। কখন যে বিরক্ত হয়ে রুম এর দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়বেন কেউ জানেনা। সে যাই হোক ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশান (VF) এর রোগীকে ডিসি শক ( DC SHOCK) দেয়ার সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারছিল না তাই স্যারকে ডাকা। স্যার শ্রেফ বলে দিলন উনি যেতে পারবেন না।
কিছুক্ষন পর আবার স্যারকে ডাকতে এলেন ডা: রাজীব। স্যার গজ গজ করতে করতে এলেন, দেখলেন। ডিসি শক দিতে বললেন কিন্তু পেশান্টকে আর বাঁচানো গেলো না। স্যার এর উপর একটু অভিমান হলো। এটাই ডাক্তার রাজীব এর জীবনের প্রথম পরাজয়। ব্যাপারটা তার মাথায় কাঁটার মত গেঁথে গেছে।স্যার একটু আগে আসলে পেশান্ট বাঁচত কিনা সেটা বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে পরাজয় এর ক্ষতটা একটু সহনীয় হত। জীবনে প্রথম পরাজয় একজন সফল মানুষ কখোনই ভুলে যান না।
(৩)
আরেকদিনের ঘটনা, প্রাইমারী পিটিসিএ ( Primary percutenious trans coronary angiogram) করতে হবে একটা পেশেন্ট এর। পেশান্ট একজন বাস এর ড্রাইভার। পুরো সংসারে উনিই আর্নিং মেম্বার। তারা সব কিছু নিয়ে প্রস্তুত হতেই স্যার এর কল আসলো এক শিল্পপতির বাবা হার্ট এটাক করেছেন। স্যার চাইলেই এই এঞ্জিওগ্রাম বাদ দিয়ে ওই রোগী দেখতে যেতে পারতেন। কিন্তু স্যার সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ওদেরকে বুঝিয়ে বল, আমি এঞ্জিওগ্রাম সেরেই চলে আসব। জুনিয়র ডাক্তার দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উনাকে যেন ভর্তি করা হয়।
তারপর স্যার বাস চালকের এঞ্জিওগ্রাম করলেন, এঞ্জিওপ্লাস্টিও করে দিলেন। তারপর ছুটলেন, ওয়ার্ডের ভি আই পি রোগী দেখতে। দেখে ওই রোগীকে ঔষধ দিয়ে ফিরে আসতে আসতে ডা: রাজীব কে বললেন, বুঝলে, আগে শিখতে হবে, কাকে সেইভ করলে বেশী লাভ। ওই সময় ওই এঞ্জিওগ্রাম করে আমরা শুধু সেই বাসড্রাইভারকেই বাঁচাইনি বাঁচিয়ে দিয়েছি ওর পুরো পরিবারকে। ৮০ বছরের বৃদ্ধ শুধুমাত্র টাকা আছে বলে গুরুত্বপূর্ন রোগীর আগে চিকিৎসা পাবেন, এটা আমার কাছে হবেনা, এ অধর্ম। তাই, আগে বুঝতে হবে কার বেঁচে থাকা বেশী গুরুত্ত্বপূর্ন সবার আগে দায়িত্ব তারপর আবেগ! সেদিন স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন ডা. রাজীব।
(৪)
ইমারজেন্সীর দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন ডাক্তার রাজীব। একজন প্রফেসরকে সচরাচর এভাবে দৌঁড়াতে দেখেনা কেউ। একটা ছেলে এসেছে সাডেন চেষ্ট পেইন উইথ কার্ডিওজেনিক শক। অনেকক্ষন তাকে মনিটর করলেন। অবস্থা এই বাড়ে এই কমে।রীতিমত যমে মানুষে টানাটানি। এ সময় সেল ফোনে একটা কল আসলো। মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল প্রফেসরের। চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন। দুই মিনিট পর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। ছেলেটার এরিদমিয়া ডেভেলপ করেছে। এ ধরনের রোগীকে দ্রুত ট্রিটমেন্ট করতে হয়। শক দেয়া, এমিওডারন দেয়া বারবার মনিটর করা এসব করছেন। একটু পরে মোবাইল বের করে আগের ফোন নাম্বারে কল ব্যাক করে বললেন, স্যারকে আগে প্রাইমারী কেয়ার দাও আমি আসছি। ডাক্তার রাজীব একটু বিচলিত হয়ে উঠলেন। একটু পরেই নিজেকে সামলে নিলেন। দ্রুত মনিটর দেখছেন, সিস্টার জুনিয়র সবাইকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন।
এই ধরনের পেশান্ট খুব কমই ব্যাক করে তবু বারবার স্যাচুরেশান দেখছেন, ইসিজি দেখছেন। এই পেশান্ট গুলোর ম্যানেজমেন্টই আসল, প্রপার টিম ওয়ার্ক না থাকলে এই ধরনের পেশান্ট ম্যানেজ করা যায়না। তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই আছেন।অনেক চেষ্টার পর , পেশান্ট একটু স্ট্যাবল হলে এক জুনিয়র কন্সালটেন্ট এর কাছে দায়িত্ব দিয়ে ছুটলেন অন্যদিকে। খুব বেশী তাড়াহুড়া করছেন না ইচ্ছে করেই। খন্দকার স্যারকে একটা ক্লিনিকের সি সি ইউ তে ভর্তি করা হয়েছে। একটা বিস্কিট মুখে নিয়ে আস্তে আস্তে রওনা দিলেন সেদিকে। স্যার অসুস্থ্য, যার হাতে কার্ডিওলজীর হাতে খড়ি, তার হৃদস্পন্দন শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন ধীর পদক্ষেপে!
(৫)
তখন দুপুর ২ টা। ডাক্তার রাজীব শাহরিয়ার ঢুকলেন তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর ডা. এম,এ খন্দকার স্যারকে দেখতে।ডা: রাজীবকে দেখেই স্যার এর হুঙ্কার,
- খুব বড় প্রফেসর হয়ে গেস, না? এত দেরী হল কেন?
- মাথা নীচু করে ডা: রাজীব পালস, বিপি দেখেন, মুখ তুলে মনিটর এর দিকে তাকান। ইসিজি রিপোর্ট দেখেন, আনস্টেবল এঞ্জাইনা, NSTMI হতেও পারে। স্যার এর পায়ের কাছে একান্তবাধ্যগত ছাত্রের মত চুপ হয়ে বসে থাকলেন। দ্রুত থ্রম্বোলাইসিস করার সিদ্ধান নিতে হয় কিনা সে জন্য করেকটা রিপিট ইসিজি করা হলো৷ স্যার এর বয়স আর আদার কোমর্বিডিটির জন্য ভয় যাচ্ছে না। স্যার এখন কি এনক্সাপেরিন শুরু করি, ট্রপ আই দেখে পরে প্রয়োজনে এঞ্জিওগ্রাম করে পিটিসিএ করা যাবে!
- স্যার বললেন, এত বুঝানো লাগবে না, তোমাদের এমনি এমনি শিখাইসি নাকি। তোমার উপরে ফেইথ আছে। এঞ্জিওগ্রাম তুমি করবা? তাহলে আমি রাজী।
নিজে কত পেশেন্ট ভাল করেছেন, আজ নিজের ছাত্র,নিজের সৃষ্টির কাছে নিজেকে সমর্পন করে খন্দকার স্যার যেন অনেক তৃপ্তি পেলেন।
- স্যার আবার বললেন, দেখ রাজীব আমার কিন্তু মনে আছে, আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে আমার ডাক্তার মেনে নিয়েছিলাম। তোমার কি মনে আছে? আমি আমার নিজের জন্যই প্রজন্ম তৈরি করেছি, আজ দেখো আমি কত নিশ্চিন্ত, আমাকে বিদেশ যেতে হবে না!
- রাজীব এর চোখ ঝাপসা হতে থাকে, চোখের কোনে জল জমে। স্যার এর জন্য টেনশানে হোক অথবা নিজের প্রতি স্যার এর আত্মবিশ্বাস এর আনন্দেই হোক তার চশমার কাঁচ ঘোলা হতে শুরু করে। স্যার এর মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তার রাজীব চলে আসেন। আসার সময় বলেন, স্যার আপনি টেনশান করবেন না, আমি সব ব্যবস্থা করছি।
(৬)
সকাল থেকেই ডা. রাজীবের ব্যস্ততা। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি। মাথায় একটাই টেনশান কিভাবে স্যারকে সুস্থ করে তোলা যায়। তার প্রতি স্যার এর এত আস্থাকে কোনভাবেই বিফল হতে দেয়া যাবেনা! ECHO, ECG, CREATININE, BT, CT, URINE RE, RBS, CBC ইত্যাদি পরীক্ষার রিপোর্ট খুব মন দিয়ে দেখেলেন যাতে কোন রিস্ক ফেক্টর অজানা না থাকে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই ক্যাথল্যাব এর দরজায় চলে আসেন প্রফেসর রাজীব। সবাই প্রস্তুত। রুমে পিন পতন নীরবাতা। মেশিনের একটানা শব্দ যেন সবার বুকে অদৃশ্য হাতুডির মত আঘাত করেই যাচ্ছে । সতর্ক ডাক্তার লোকাল এনেস্থেসিয়া দেয়ার পর ফিমোরাল ক্যাথেটার করা হল। এঞ্জিওগ্রামের প্রোব ফিমোরাল আর্টারীরর ক্যাথেটারে প্রবেশ করালেন। হার্টের ইমেজিং এ ডাই এর অবস্থান দেখে ব্লক কোথায় নিশ্চত হতে চাইলেন। হ্যা, লেফট এন্টেরিয়র ডিসেন্ডিং এ একটা বড় ব্লক, ৮০% এর মত। ওই একটাই ব্লক। খুব সাবধানে বায়ো-এবসরবেন্ট করোনারি স্টেন্টিং ইনসার্ট করালেন ( Angioplasty)। তারপর আস্তে আস্তে প্রোব উইথড্র করে বেরিয়ে এলেন। হাফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। ব্যাপারটা এমন না যে এইটা অনেক কঠিন কাজ। আসলে সিনিয়র কোন ডাক্তার এবং শিক্ষক যখন রোগী হন , তখন অনেক ছোট রোগও চিকিৎসক এর কাছে বিশাল মনে হয়। আর যিনি সব বুঝেন, জানেন এবং তার থেকে জুনিয়র কেউ যখন তার কাজ করবে তখন সেই জুনিয়র ভয় পাবেই, লজ্জা পাওয়াটাও স্বাভাবিক।
(৭)
দুইদিন পরের কথা। প্রফেসর খন্দকার তার বাসায় বসে আছেন। ডা. রাজীব এলেন স্যারকে দেখেতে। স্যার এখন সম্পূর্ন সুস্থ্য। স্যারকে সালাম করে বারান্দায় বসলেন দুইজন।
-রাজীব বললেন, স্যার আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। স্যার তো আবাক! স্যার বললেন, কি ব্যাপার বলো তো?
-রাজীব বললেন, সেদিন আমার দেরী হয়েছিল তাই আমি সরি স্যার। কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে শিখিয়েছিলেন কোন রোগীকে আগে দেখতে হবে আর কোনটা পরে। আপনার কন্ডিশান আমি জানতাম তাই ওই ক্রিটিক্যাল ইয়াং পেশান্টকে সময় দিয়েই আমি এলাম। স্যার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন।
- অধ্যাপক রাজীব এরপর বললেন, স্যার, ওই রোগীটা এরিদমিয়ার পেশান্ট ছিল। আমার জীবনের প্রথম পরাজয় ছিল, একটা এরিদমিয়ার পেশান্ট। অনেক কষ্ট করেও আমরা ওই পেশান্ট কে বাঁচাতে পারিনি। আপনি সেদিন আপনার রুমেই ছিলেন, কিন্তু কেন জানিনা আপনি আসলেন না, আমরা শক দেব কি দেব না ভাবছিলাম। এর অনেকক্ষন পর অনেক রিকোয়েস্ট করে আপনাকে পেশান্ট দেখালাম, আপনি শক দিতে বললেন, কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। সেদিন আপনাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি, আমি চেয়েছিলাম আপনার সেই ভুল এর একদিন বিচার হোক।
আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, আমি জীবনে আপনাকে খারাপ হতে দেখিনি, তাই আমি চাইছিলাম, একটা শাস্তি আপনি পান, এরপর একজন সৎ মানুষ হিসেবে আপনার প্রস্থান হোক। আপনি যখন বুকের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন ওই এরিদমিয়ার পেশান্ট দেখে আমি আস্তে আস্তেই এসেছি আপনার কাছে, যাতে আপনি সেই কষ্টটা বুঝতে পারেন, যে কষ্ট আমরা নিজের অজান্তেই রোগীদের দিয়ে থাকি। তবে বেশী দেরী করিনি, কারন, যদি আপনাকে হারাতাম, আমি নিজেই নিজের কাছে চির অপরাধী হয়ে থাকতাম।
আজ থেকে আপনি আমার কাছে শুদ্ধতম ব্যক্তি। স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন। আমাকে ক্ষমা করবেন। এই বলে স্যার এর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলেন, স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন। নিজের সৃষ্টি এভাবে যদি নিজেকে ছাড়িয়ে যায়,কান্না ছাড়া আর কি থাকে? এ কান্না আনন্দের, এ কান্না গর্বের, এ কান্না বিজয়ের, এ কান্না ভালোবাসার।
(৮)
ধীর পায়ে হেটে যান ডা. রাজীব। কিছুটা ক্লান্ত। পেছনে পড়ে থাকে যুগ শ্রেষ্ঠ পুরুষ, যিনি নিজ হাতে গড়েছেন ডা: রাজীব এর মত অনেক গুলো মোমবাতি, যারা আলো ছড়াচ্ছেন লক্ষ প্রানে।রাজীব তাকিয়ে দেখেন পেছনে দাঁড়ানো ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতির গলে পড়া মোমের মত খন্দকার স্যার এর চোখ বেয়ে নেমে যাচ্ছে আনন্দাশ্রু। কিছু মোমবাতির আলো নিভে যায় না, অনেক অনেক আলোর মাঝে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। খন্দকার স্যার তেমনি একজন। খন্দকার স্যার যেন একটি মোমবাতি। খন্দকার স্যারদের মৃত্যু নেই ।
_______________________________
ডা. মৃণাল সাহা, সুলেখক।
আপনার মতামত দিন: