Ameen Qudir

Published:
2018-11-24 22:33:19 BdST

কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরামর্শ দিচ্ছেন কথাশিল্পী ডা. মোহিত কামাল


 

 

অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
____________________________

কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা
শৈশব পেরিয়ে কৈশোর কাল। তারপরেই শুরু হয় তারুণ্য। জীবনের একপর্যায় অন্য পর্যায়ের বিকাশ ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এককালের বৈরী পরিবেশ পরবর্তীকালে নানা ধরনের মানসিক সংকট তৈরিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত রাখতে তাই শিশুকাল থেকেই নজর রাখা জরুরি। অতি নজর নয়, অতিরিক্ত প্রটেকশন নয়, শিশু-কিশোর পরিচর্যায় যথাযথ সচেতনতাই পারে সুন্দর তারুণ্য উপহার দিতে। অথচ আমরা কী দেখি? বর্তমান বিশ্বে কিশোর-তরুণরা সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব মানসিক অসুস্থতার অর্ধেকই শুরু হয়ে যায় ১৪ বছর বয়সে। আরও দেখা গেছে এসব অসুস্থতার বেশিরভাগই অবহেলিত বা অগোচরে থেকে যায়। এর পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, শিশু ও উঠতি বয়সী তরুণের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। এরা আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না। মানসিক স্বাস্থ্যের ত্রুটিপূর্ণ বুনিয়াদ নিয়ে এরা বড় হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, এ ধরনের উঠতি বয়সি তরুণদের প্রতি পাঁচজনে একজন অর্থাত্ বিশ্বজনগোষ্ঠীর ২০% মানসিক রোগে ভোগে।



বর্তমান বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধির (নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস্) প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরায়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মানসিক চাপ, বংশগতি ও অন্যান্য শরীরবৃত্তিক কারণ ও মনোসামাজিক কারণ মানসিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬ ভাগ ও শিশু-কিশোরদের শতকরা ১৮ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিপুল জনগোষ্ঠী প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও চিকিত্সা প্রাপ্তির তথ্যের অভাবে সময়মতো চিকিত্সা সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে জনগণের কর্মক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যা জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে অন্তরায়।

মাদকাসক্তি তরুণ সম্প্রদায়ের ভেতর মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকের সহজলভ্যতা, মাদক চোরাচালান, কৌতূহল, বন্ধুদের চাপ, আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের মনোসামাজিক কারণে মাদকাসক্তি শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকাসক্তি থেকে পরবর্তীকালে চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সম্প্রদায়। অনেক সময় তাদের মধ্যে অবাধ্যতা, তুচ্ছ কারণে বিরোধ, ভাঙচুর, সহিংস আচরণ ও দেশীয় সংস্কৃতি-বিরুদ্ধ জীবন আচরণ লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় আত্মহত্যা প্রচেষ্টা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের বেশিরভাগের মধ্যে বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। নগরায়ন, অভিভাবকত্ব, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অবাধ আকাশ সংস্কৃতি, মূল্যবোধের পরিবর্তন এসবের জন্য দায়ী। যুববয়সীদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার লক্ষ করা যায় যা অনেক সময় আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। অপরাধের বড় এক অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভর করে সংঘটিত হয়। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হানছে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো। মূল্যবোধহীন ব্যবহারকারীরা প্রযুক্তিকে তাদের ভোগ ও আয়েশের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তথ্যবিকৃতিসহ ব্যক্তিগতভাবে শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীদের অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এভাবে তাদের মানসিক অবস্থার ক্ষতি করে। এমন ঘটনা ভার্চুয়াল জগতে এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেল করার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। অপরাধী চক্র তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য ইন্টারনেটকে গোপনীয় মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সহজে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ভুয়া সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অথবা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে পারও পেয়ে যাচ্ছে তারা।

মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তির ফলে চাকরি হারাতে হচ্ছে। তখন তাদের মানসিক হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তির ফলে বন্ধ্যাত্বসহ মাইগ্রেনের প্রচন্ড ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, ঘুমের মধ্যে হাঁটা, কথা বলা, মেরুদন্ডে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে। এছাড়া হাতের কবজি, কান ও ঘাড়ের সমস্যা হতে পারে। কিশোর-তরুণরা তার মৌলিক দায়িত্ব পালন না করে কাজে সময় ব্যয় না করে সময় কাটাচ্ছে ফেসবুক, ইমু, টুইটার, ভাইবারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি সত্যিই কি আমাদের সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক, না কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সমাজসচেতন মানুষদের। তরুণদের কমিপউটার, মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপক্ষে নই আমরা। এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যত্ বিনির্মাণের দিকে আমাদের তাকাতে হবে, যা যা করার দরকার তাই করতে হবে। ছেলেমেয়েদের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।

আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে, সামাজিক কিংবা পারিবারিক প্রেক্ষাপট থেকে ভায়োলেন্স প্রতিরোধের জন্য সততার সঙ্গে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত আছে অনেক কারণ। কোনো শিশু-কিশোর-তরুণ নির্যাতনের শিকার হলে দ্রুতই ক্ষত নিরাময়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনগত সাপোর্ট দিতে হবে। সমাজপতিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বও অনেক বেশি। নির্যাতনকারীর সাজা না হলে সমাজে শিশুনিপীড়ন নির্মূল করা যাবে না। আমরা উল্টো চিত্র দেখি, যে কিশোরীটি ধর্ষিত হলো, তার ওপরই নেমে আসে সামাজিক নিপীড়ন। মা-বাবাও ওই সময় নিজের মেয়েটিকে ভর্ত্সনা করেন। ফলে, নির্যাতিত শিশুটি নিজের পরিবার কিংবা সমাজ থেকেও পায় অমানবিক যাতনা। এই ধরনের যাতনার কারণে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে কেউ কেউ।

আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। ঘর থেকে শিশু নির্যাতন রোধের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে প্রথম। নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত, এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবার থেকে। সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ শানিত করতে হবে। মূলকথা এজন্য প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা; সাইবারবুলিং কি তা বাবা-মাকেই বুঝতে হবে প্রথম। সতর্ক পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা আছে কিনা তা বোঝার। এজন্য পাসওয়ার্ড যাতে শিশুরা না পায় সে-ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যদি কেউ জেনেও যায় তবে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে হবে। অপরিচিত বা প্রমাণবিহীন কোনো সূত্র থেকে প্রেরিত কোনো বার্তা (ইমেইল, টেক্সট মেসেইজ, ফেসবুক মেসেইজ) যেন তারা না খোলে এবং নিজেদের ছবি পোস্ট না করে, সে-শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য প্রচারণা চালাতে হবে, ক্লাব করতে হবে, যাতে সাইবারবুলিং বিষয়ে সচেতনতা বাড়ে। নানা কারণে কোনো কোনো শিশু অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে পারে। ভায়োলেন্স কিংবা অ্যাগ্রেসিভ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। দুরন্ত ও বেপরোয়া শিশুদের আমরা অনেক সময় শাস্তি দিই। মনে রাখা জরুরি, শারীরিক শাস্তি শিশুকে আরও বেশি মারমুখী ও বেপরোয়া করে তুলতে পারে। যিনি শাস্তি দিচ্ছেন, তার প্রতিও ‘নেগেটিভ অ্যাটিচ্যুডে’র বীজ রোপিত হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে সেটির ভয়াবহ প্রকাশ ঘটতে পারে। আরও মনে রাখা জরুরি, যারা শৈশবে নির্যাতনের শিকার হয়, ভায়োলেন্সের কারণে দৈহিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা ভোগ করে, তারাই আবার নির্যাতনকারী হয়ে উঠতে পারে। অপরাধী হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে সমস্যা প্রতিরোধে সামাজিক স্তর থেকে শিশুদের হতাশা দূর করতে হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। চিকিত্সার মাধ্যমে দুরন্ত, অবাধ্য ও দুর্ধর্ষ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে শিশু-কিশোরদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা জরুরি। শিশুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হলে উঠতি বয়সী তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য হবে সুসংহত। এভাবে গড়ে তোলা সম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম। যেকোনো সংকটে তরুণদের বোধের জগতে নেমে তাদের বুঝতে হবে। তখন যথাযথ সাপোর্ট না পেলে মানসিক রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায় তাদের। ছেলেদের অধিকাংশই তখন মাদকের ফাঁদে পড়ে আর বেশিরভাগ মেয়েই আত্মহত্যার পথে পা বাড়ায়।

পছন্দনীয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে, শিক্ষাজীবন শেষ করে উপযুক্ত সময়ে চাকরি না পেলে হতাশায় তলিয়ে যেতে থাকে তারা। হতাশা থেকে আসে বিষণ্নতার রোগ, ভুল পথে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় তখন। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা, বন্ধু বা স্বজনদের সাপোর্ট দিতে হবে। এভাবে আমরা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারি। আনন্দময় শৈশবই পারে মেধাবী ও দক্ষ কৈশোর এবং তারুণ্যময় কাল উপহার দিতে।

আমাদের প্রতিটি পরিবারের উচিত তার ছেলে কিংবা মেয়ের গতিবিধি লক্ষ করা। সে কার সঙ্গে মিশছে, কার সঙ্গে খেলছে, যার সঙ্গে চলছে তার স্বভাব ও নৈতিক দিক গভীরভাবে লক্ষ করা দরকার। কেননা একবার আক্রান্ত হলে প্রতিকার কঠিন হয়ে পড়তে পারে। আর তখন সত্যিকার অর্থে এর দায়ভার নিতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে।
___________________________________

লেখক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল : মনোবিদ, শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্ধী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়