Ameen Qudir

Published:
2018-11-21 22:26:07 BdST

নবান্ন : অসাম্প্রদায়িক লোক উৎসব




দীপংকর গৌতম
___________________________

‘আকাশজুড়ে জল থৈ থৈ যুবতী চাঁদ আকাশ জোড়া। আলো গলে পড়ে মোম। চরাচরব্যাপী শূন্যতায় আমাদের সময়। তাঁর আচলের ঘ্রাণের মতো ধানের ঘ্রাণ। চোখের চতুষ্কোণে কুয়াশার রাজধানী। ওগো হেমন্তের মেয়ে আমি তোমার দ্বারে আমার ছায়ার সমান অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তোমার শরীরের নবান্ন ঘ্রাণ বড্ড নাকে লাগছে। ধূপময় গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিক। পাকা আমন ধানের কিড়া লাগে। এই নবান্নে আমাকে তুমি গ্রহণ করো। দেখ বুলবুলি ফিঙে শালিকের পালকে শীত অসারতা। তবু কুয়াশার স্বেদ আর মাটিবর্তী মেহনতি মানুষের ঘামের চৈতন্যে বুঁদ হয়ে থাকা আমি নবান্নের উৎসব নিয়ে তোমার কপালে এঁকে দেব ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের টিপ।’

প্রকৃতিতে এমন রূপ বিরাজ করে হেমন্তের একটি সময়ে যখন অগ্রহায়ণের দিন শুরু। শীত অসারতা ক্রমশ প্রকৃতিকে কেমন রুগ্ন করতে থাকে। কৃষকের রাশি রাশি ভাড়া ভাড়া ধান পড়ে থাকে দাওয়ায়। কিষান কিষানী কারো যেন ঘুম নেই। পথে পথে, উঠানে, চাতালে ভরা ধান। মাটির সোঁদা গন্ধের সাথে ধানের মিশেল সে গন্ধের মাদকতায় অস্থির হতে হয়। এ গন্ধ অতিক্রম করা যায়? এই ঘ্রাণই বাঙালির অযুত বছরের সিন্দুকে রাখা ধূপ। ভূমি কেন্দ্রিক সভ্যতার এই দেশ কৃষি প্রধান । এখানের উৎসব ফসল কেন্দ্রিক। হেমন্তে ধানের বৈভবে, ঘাণে অস্থির জীবকূল, তাদের স্থিরতা দেয় নবান্ন। নতুন ধানের পিঠে, পায়েস। হেমন্তের এই ঐশ্বর্য মণ্ডিত উপাদান স্মরণ করিয়ে দেয় তার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ নবান্নের কথা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার কবিতায় লিখেছেন—

মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকি;

নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা;

পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি;

একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা’

সুধীন্দ্রনাথের এমন আকিঞ্চন হৃদয়ে দোলা দেয়। মনে দোলা দেওয়ার পর আর কিছু লেখা যায় না। নবান্নের ঘ্রাণ আজন্ম লালিত অন্তর্গত গহীনের উৎসবের আমেজ নতুন স্বপ্ন ডাকে। পাড়া-পড়শী, আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে এ উৎসব যে ব্যাপ্তি নিয়ে পালিত হয় তাকে কৃষকের উৎসব শুধু নয়, কৃষিনির্ভর মেহনতি মানুষের বছরের মূল শস্য উৎপাদনের পর এ এক লোক উৎসব। বছরের মূল শস্য আহরণের এ সময় গাঙ্গেয় এ উপত্যকায় অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি কামনা এবং সন্তান ও পশুসম্পদের আকাঙ্ক্ষায় আদি যুগে এ ধরনের উৎসব চালু ছিল বলে জানা যায়। তার বাস্তব কিছু প্রমাণও পাওয়া যায় । উত্তর পশ্চিম ভারতের ওয়াজিয়াবাদে নবান্ন উৎসব পালিত হতো বৈশাখ মাসে। উৎসবের প্রচলন করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।

রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে বৈশাখী নবান্ন পালন করে ওখানকার অধিবাসীরা। দক্ষিণ ভারতেও প্রচলিত আছে এমন ধরনের নবান্ন উৎসব। তবে আমাদের অঞ্চলের এ উৎসব অন্যদের থেকে আলাদা। কারণ মধ্যভারত বা দক্ষিণ ভারতে বোশেখ মাসে রবিশস্য উৎপাদনে তাদের গোলা ভরে। তাই তারা তাদের প্রধান উৎসব করে। আমরা তখন পুণ্যাহ বা হালখাতার উৎসব করি। সাযুজ্য থাকে উৎসবে। শোষণ বঞ্চনার কথা উৎসবে থাকে না। তাই এসব কথা বলারও অপেক্ষা রাখে না। নবান্নের সর্বজনীনতা আছে। অনেক বড় করে আছে। আমি শৈশবে দেখেছি নবান্নের দিন পঞ্জিকা দেখে ধার্য করা হতো। একদিনে নবান্নের দিন ধার্য করা হতো পুরো পাড়ায়। সে অনুযায়ী আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভোরে নির্ধারিত একটা গাছ তলায় হাজির হয়ে কাককে নেমন্তন্ন করতাম। সবাই কোরাসে গাইতাম :

‘কাউয়া কো কো কো। আমাগো বাড়ি আইয়ো। নবান্ন শুভান্ন প্যাট ভরে খাইও।’

কাককে নারকেলের আচিতে নবান্ন দিয়ে অপেক্ষা করা হতো। কাক না খেলে অন্য কেউ খেত না। কোনো বাড়ি থেকে খবর আসত কাক নবান্নের সাথে কলাও খেয়েছে। তারপর শুরু হতো নবান্ন খাওয়া। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নবান্ন খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সে ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপনের প্রথা রয়েছে।

নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ, একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে এ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায় বলে তাদের ধারণা। এই নৈবেদ্যকে বলে কাকবলী। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। এর মধ্যে অনেক অঞ্চলের লৌকিকতার বিষয়াবলীকে ধরা যায়। কোনো অঞ্চলের লৌকিকতাকে পুরো অঞ্চলের সংস্কৃতি বলে চালানোর প্রবণতাটা আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের অন্তরায়। সর্বজনীনতার তো বটেই। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন প্রথা ছিল। সে অঞ্চলে আর্থসামাজিক অবস্থা, ভৌগলিক পরিস্থিতির মাপকাঠিতে সেখানকার মানুষের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আজ যেমন সব অঞ্চলের সংস্কৃতির একটা মোদ্দা বিবরণ পাওয়া যায়, আগে তা কল্পনা করা যেত না। সুতরাং কোনো অনুষ্ঠান কোনো সম্প্রদায়ের এ চিন্তাটাও সাম্প্রদায়িক, যেটা নবান্ন উৎসবের বিরোধী।

কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যেকোনো ঋতুতে এ উৎসব পালিত হয়। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ। উত্তর-পশ্চিম ভারতে নবান্ন উৎসব পালিত হয় বৈশাখ মাসে। সেখানে রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এ বৈশাখী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। দক্ষিণ ভারতেও প্রচলিত আছে এমনি ধরনের নবান্ন উৎসব। তারা ধান ও যব ঘরে তুলে এ উৎসব করে। অর্থাৎ বিষয়টা কৃষিও কৃষক সংলগ্ন এটা এক কথায় বলা যায়। বাংলাদেশের কয়েকটি আদিবাসীও তাদের ধান ফসল ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গানবাজনা এবং মদ্যপানের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে। উসুই জাতিগোষ্ঠী অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারোরা ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগাল্লা উৎসব।

হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা পৌষ মাসে গৃহস্থরা এ উৎসব পালনে মেতে উঠত। উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা। পরে দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়স্বজনদের নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণে ঘরে-বাসায় আলপনা আঁকা হতো। পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান এবং আত্মীয়স্বজনের আগমনে পল্লির মেঠো পথ প্রতিটি গৃহের পরিবেশ হয়ে উঠত আনন্দঘন মধুময়। সর্বত্র গুঁড়ি কোটার শব্দ, শাঁখের শব্দে গ্রামাঞ্চল হয়ে উঠত প্রাণবন্ত। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে বসত কীর্তন, পালাগান ও জারিগানের আসর। অগ্রহায়ণ মাসের উত্থান একাদশীতে মুখোশধারী বিভিন্ন দল রাতভর বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচগান করত। কৃষকরা নতুন ধান বিক্রি করে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ কিনত। বর্তমানে সেসবের অনেক কিছুই লোপ পেয়েছে। এখন সংক্ষিপ্তভাবে কেউ কেউ এ উৎসব পালন করে।

নবান্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। তবে অনেক ইতিহাসবেত্তা নবান্ন উৎসবকে হিন্দুয়ানী উৎসব বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ উৎসবের প্রধান অঙ্গ নতুন চালের তৈরি নানা উপকরণে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন। এরপর দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ আত্মীয়স্বজনকে নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবার নতুন গুড়সহ নবান্ন গ্রহণ করে। এ উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণে আলপনা আঁকা হয়। এ সময় পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান আর আত্মীয়স্বজনের আগমনে পল্লীর গৃহপরিবেশ হয়ে ওঠে মধুময়। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে বসে কীর্তন, পালাগান ও জারিগানের আসর। তবে আমাদের মনে হয় নবান্ন সবকালেই কৃষক, মেহনতি মানুষের উৎসব ছিল। প্রাচীন ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এটা যেভাবে পালন করত সেটাকে হিন্দুয়ানী বলে খারিজ করা যাবে না। কৃষি পেশার সাথে হিন্দু কৃষক ক্ষেত মজুর বেশি যুক্ত থাকার কারণে হয়তো তাদের মতো করে, পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে তার আগামী ফসল যাতে আরো ভালো হয় তা কামনা করতেন। আবার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে মসজিদে শিরনি দিয়ে শুরু হতো এ উৎসব। পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব হতো। পাইট খেলা হতো ইত্যাদি।

সুন্দরবন তারা হিন্দু-মুসলিম-সাঁওতাল সবাই ভালো থাকার জন্য, আগামীতে বেশি শস্যের কামনায় তার সত্য পীরের শিরনি দিত। বনদেবীর পালা বা গাজী-কালুর পালা করত।

আদিবাসী অন্যান্য সম্প্রদায়ও তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর ভিন্ন ভিন্ন নামে আর নিজস্ব রীতিতে নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে সোহরায় উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গান-বাজনা ও হাড়িয়া (নিজেদের তৈরি মদ) পানের মাধ্যমে বিভোর থাকে এ উৎসবে। উসুই আদিবাসী অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুমচাষি ম্রো আদিবাসীরাও চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূরিভোজ করায়। ফসল তোলার পর গারো আদিবাসীরা ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগাল্লা উৎসব। উৎসবের একটি বিষয় সর্বজন গ্রাহ্য তা হলো উৎসবের মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক অবস্থান ও ফসলের প্রকার ভেদ।

প্রাচীনকালে অন্য অঞ্চলের নিয়ম কানুন আরেক অঞ্চলে জানা কষ্টসাধ্য ছিল বলে এক এক অঞ্চলের উৎসবের উপাচারে ভিন্নতা আছে। তবে কৃষক-মজদুর শ্রেণির উৎসব ফসল কেন্দ্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ । এসব উৎসবের মধ্য দিয়ে মনে হয় নবান্নের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসব চালু করেছে কৃষক, ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষ। আমাদের অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক ,ক্ষেতমজুর যে কোনকালে সাম্প্রদায়িক ছিলো না, তার প্রমাণ ফসল কেন্দ্রিক উৎসব। সাম্প্রদায়িকতা চালু করেছে বিত্তবানেরা। মানুষকে যারা ভাগ করেছে তারা নিরক্ষর কৃষক নয়। তাহলে নবান্নসহ কোন উৎসব আমরা পেতাম না। সব সম্প্রদায় যে নবান্ন উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে এমন নয়। তবে নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ কম-বেশি সবাইকে স্পর্শ করে, কিছুটা হলেও দেয় উৎসবের আনন্দ। তাই ইতিহাসের ধূসর পথরেখা ধরে সজীব বর্তমানে এলেও মনে দোলা দেয় একটি লাইন ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন’।

অগ্রহায়ণের নতুন ধান ঘরে আনার আগে মা লোক দিয়ে মাটি এবং গোবর গুলিয়ে বাড়ির আঙিনা ও ধানের গোলা লেপে পরিপাটি করতেন। লোকজন নতুন ধানের আঁটি মাথায় করে এনে ফেলত লেপে রাখা ওই উঠোনে। এরপর মাড়াই করে ধান রোদে শুকিয়ে মচমচে করা হতো। মা সেই ধান ঢেঁকিতে পিষে চাল তৈরি করতেন। এরপর সন্ধ্যায় ওই চাল গুঁড়া করে তৈরি করা হতো পিঠা-পায়েস। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব। আগে নবান্ন উৎসবে খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা করা হতো। যে যত বেশি খেতে পারত তাকে উপহার দেওয়া হতো। নগরায়ণ আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হয়েছে খেলার মাঠ। তেমনি গ্রামীণ জনপদে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে, কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা।

গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি। আগে কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে আউশ-আমন-বোরো ধান। বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ধান বাজারে আসায় নতুন ধানের গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ে ওইসব ধান উৎপন্ন হওয়ায় গ্রামবাংলার ঐত্যিবাহী নবান্ন উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। ধানের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত সব কাজই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে। এখন ধান উৎপাদনে আগের সেই পরিশ্রমও যেমন নেই, তেমনি চালের মজাও নেই।

উৎপাদনশীল মানসিকতার মধ্যে যে স্বাভাবিক নিবেদন আছে, তা নবান্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়; যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ভক্তি, প্রেম ও লোক-সংস্কৃতির আবহমান বহুমাত্রিক মনোভঙ্গি। আর এসব মিলেমিশে পুষ্টি লাভ করেছে নবান্ন নামের লোক উৎসবটি।

হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় সোনালি ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের সোনালি রং দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এই শোভার কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলাভরা ধানে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেকরকমের খাবার, বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের ম-ম গন্ধে ভরে ওঠে। এ কথা তাকে শেখাবে কে? গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে শহর, আমাদের উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পেশা। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নাগরিক লোক উৎসব করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে হচ্ছে। এটাকে ফেরানো যাবে না। তবে উৎসবকে ধরে রাখতে দরকার আন্তরিকতা। এসব লোক উৎসবকে বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে তাড়ানোর অন্য কোনো মন্ত্র নেই।

 

কৃতজ্ঞতা

১. আশরাফুল হক, নতুন ধান্যে হবে নবান্ন

২. ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, নবান্ন : আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের গর্বিত অনুভূতি

৩. পল্লব সেনগুপ্ত, বাঙালির পালা-পার্বণ

_____________________________

লেখক দীপংকর গৌতম বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিশারদ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়