Ameen Qudir

Published:
2018-11-17 17:32:09 BdST

'এই যে ডাক্তার, সচিবদের নাকি গাড়ী-টারী দিবো, তোমাগো দিবো না?'


 

 

ডা. জামান অ্যালেক্স
________________________________

ফ্ল্যাটের এক আঙ্কেল সরকারি এক ব্যাংকের রিটায়ার্ড উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ভদ্রলোককে আমি বেশ সচেতনভাবেই অ্যাভয়েড করি, অবস্থা এরকম যে-লিফটের সামনে উনাকে দাঁড়ানো দেখলে আমি উঠানামার জন্য সিঁড়িকে বেছে নেই...

তবে সবসময় অ্যাভয়েড করা সম্ভবপর হয় না, এই যেমন সেদিনও সম্ভবপর হলো না। উনাকে এড়িয়ে লিফটকে বাইপাস করে মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাওয়া মাত্রই উনি হাঁক দিয়ে উঠলেনঃ

--এই যে, এই যে ডাক্তার..
--স্লামালিকুম আঙ্কেল
--ওয়ালিকুম। ঘটনা কি ডাক্তার? আমারে দেখলেই লিফট বাদ দিয়া সিঁড়িতে হাঁটা দাও-বিষয়টা কি?
--বিষয় কিছু না আঙ্কেল, একটু এক্সারসাইজ করা আর কি...
--না, না, এক্সারসাইজ-টেক্সারসাইজ কিছু না, অন্য সময় তো ঠিকই লিফটে চলো...আইচ্ছা বাদ দাও, আজকের ঘটনা শুনছো? ঐ যে এক গাইনী ডাক্তার তো বাচ্চা হওয়াইতে গিয়া বাচ্চার মাথাই কাইটা ফেলছে, শুনছো ঘটনাটা?(আঙ্কেল বেশ উত্তেজিত)
--জ্বি, শুনেছি। এটা এক ধরণের Destructive operation. বাচ্চার মা'কে বাঁচাতে এই ধরণের অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে...
--আর ঐটা শুনছো? অপারেশনের পর পেটের ভিতরে গজ-কাপড় রাইখা আসছে...
--হাজার হাজার অপারেশন করে, দুই-একটা ভুল তো হবেই, ইউরোপ-আমেরিকাতেও হয়...
--তোমাগো ডাক্তারগো এই এক সমস্যা, অপরাধ ঢাকার লাইগা এক ডাক্তার আরেক ডাক্তারের পক্ষ নাও...

কথা সত্য না, আমি আরেক ডাক্তারের পক্ষ নেই নাই।স্ট্যাটিসটিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউতে হাজার খানেক অপারেশনে কিছু ভুল হবেই, আমাদের দেখতে হবে সেই ভুলের পরিমাণ স্ট্যাটিসটিক্যালী সিগনিফিকেন্ট কিনা। এইসব তত্ত্বকথা বুঝার লোক এই আঙ্কেল না, লিফট থামার সাথে সাথে তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে নেমে গেলাম....

আরেকদিনের ঘটনা। বাসায় মেহমান আসবে, সবকিছুই আনা হয়েছে, গোল বেগুন আনা হয় নাই, মেহমান বেগুন ভাজা খেতে চেয়েছে। আমি বেগুন আনতে বাসার নিচে গেলাম। বেগুন দরদাম করছি, এমন সময় পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেনঃ" এই যে ডাক্তার, নিজেরা তো ভিজিটের একটা টাকাও কম রাখো না, গরীব সবজিওয়ালার সাথেও তোমাগো দামাদামি করতে হইবো!...."--পাশে তাকায়ে দেখি ফ্ল্যাটের ঐ আঙ্কেল। তার কাছে আমি কবে ভিজিট নিলাম সেটা মনে করতে পারলাম না। হাসিহাসি মুখ করে দামাদামি বাদ দিয়ে বাসায় বেগুন নিয়ে এসে দেখি সব বেগুন পোকায় খাওয়া, ডাক্তার পরিচয় জেনে সবজিওয়ালা নিজ হাতে সব বাছাই করে দিয়েছিলো....

সর্বশেষ একটা ঘটনা বলি।এবার উনার সাথে দেখা লিফট্ দিয়ে নামার সময়।লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম, দরজা খুলতেই দেখি আঙ্কেল ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন, ফেরত চলে গেলে বেয়াদব ভাবতে পারে, ভেতরে ঢুকতে হলো...

--এই যে ডাক্তার, সচিবদের নাকি গাড়ী-টারী দিবো, তোমাগো দিবো না?
--জ্বি না, দিবে না
--দিবো না কেন?
--আমাদের মনে হয় সে যোগ্যতা নাই, তাই দিবে না...
--যোগ্যতা নাই, সেইটা কথা না। কথা হইলো গিয়া সারাদিন তো আরেকজনের পকেট কাটতে থাকো তোমরা, এই টেস্ট, সেই টেস্ট। এমন কোন ডাক্তার আছে যার দুই-তিনটা গাড়ী নাই? সারাদিন চুরি-চামারি নিয়া থাকলে সরকারী গাড়ি পাইবা কেমনে?

মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়, উনার কথায় আমি লোহায় পরিণত হলাম। এতোক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি কেন এই লোকটাকে অ্যাভয়েড করি, গায়ে পড়ে উটকো ঝামেলা কে নিতে চায় বলেন?....

এইসব ঘটনার পর অনেকদিন পেরিয়েছে, উনার সাথে দেখা না হওয়াতে শান্তিতে দিন কাটছিলো। হঠাৎ তিনি বাসায় হানা দিলেন। বাসার লোক মারফত জানিয়ে দিলাম আমি ঘুমিয়ে আছি, এখন দেখা করা সম্ভব না। যে লোক প্রায়শই আমার সাহায্য নিয়ে আমাকে আমার পেশা নিয়ে কটুবাক্য শোনায়-তার সাথে কিছুটা বেয়াদবী করা অন্যায় না। দ্বিতীয়দিনও ফেরত দিলাম। তৃতীয়দিন আর ফেরত পাঠাতে পারলাম না, উনি নাকি আমার ঘুম ভাঙ্গা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। Summer wine গানটা শুনছিলাম, অগত্যা ভয়াবহ সুন্দর অপার্থিব এই গান বাদ দিয়ে তার সাথে ড্রয়িং রুমে দেখা করতে হলো...

--স্লামালিকুম
--ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া'বারাকাতুহু( জীবনে এই প্রথম তিনি সালামের পুরো উত্তর দিলেন)। তা বাবা আছো কেমন?
--এইতো চলছে
--আ হা হা, শরীরটা কেমন দুর্বল দুর্বল লাগে...

উনার গলার তারল্যে আমি মনে মনে বেশ বিস্মিত, পরিচয় হবার পর থেকে এত নমনীয় গলা আমি আর কখনো শুনি নাই। বিস্ময় কাটতে অবশ্য সময় নিলো না...

--হইছে কি, আমার মেয়ে তো এইবার MBA কমপ্লিট করলো..
--ওহ আচ্ছা
--বিয়া তো দিতে হইবো
--হুম
--তোমার আশেপাশে কোন ভালো ডাক্তার ছেলেটেলে থাকলে একটু দেইখো আর কি...
--জ্বি আচ্ছা...

উনি উনার মেয়ের বায়োডাটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন....

স্যরি টু সে, এই হলো টিপিক্যাল বাঙালি জাতি। সারাদিন ডাক্তারদের গালিগালাজ করার পর দিনশেষে মেয়ে হলে তার জন্য ডাক্তার জামাই আর ছেলে হলে শ্বশুরবাড়ির রোগশোকে ভোগা লোকজনকে দেখাশোনার জন্য একটি ডাক্তার মেয়ে তাদের চাইই চাই...

উনি বের হয়ে যাবার সময় একবার বললেনঃ ফ্যামিলির সবার ডাক্তার ছেলে পছন্দ, তাই তোমারে একটু জ্বালানো আর কি... কিন্তু তুমি তো বাবা তেমন কিছু বললা না, চয়েজ তো ঠিক আছে, তাই না?

আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বিদায় দিলাম। কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো না, মাথায় খালি ঘুরছিলোঃ "My silence doesn't mean I agree with you, It means your level of stupidity rendered me speechless ..."


___________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়