Ameen Qudir

Published:
2018-10-25 02:48:44 BdST

কোজাগরী জ্যোৎস্না : কিছু স্মৃতি, কিছু কষ্ট


 

 

দেবব্রত তরফদার, কথাশিল্পী
____________________________

চপলাপিসি আর খুশি দিদি গতকালই উঠোনটা গোবর দিয়ে সুন্দর করে লেপেছে আর সেই সঙ্গে মাটির দেওয়ালগুলো। আজকে মুরগি ছাড়া বারণ । বাবা এইসব কথা মাঝে মাঝে শোনেননা তাই মুরগির ঘরের দরজায় তালা । নাহলে নিকানো উঠোনটা যা তা করবে । শুধু তাই নয় নষ্ট করবে বড়মার উঠোনও । জেঠুৱা অবশ্য মুরগি পোষেন না কিন্তু হাঁস আছে ওদের , তারা আরো যন্ত্রণার । কিন্তু আমাদের তাতে সমস্যা নেই কেননা তারা নদী থেকে সোজা উঠে ওই উঠোন দিয়ে ঘরে ঢোকে । আতপ চাল মিহি করে গুঁড়ো করে জল মিশিয়ে আলপনা দিচ্ছে মেজদি । দেওয়ালের আল্পনাগুলো বসুধারার মতো। ছোটদি আবার তাতে বৈচিত্র্য আনার জন্য মাঝখানে দিয়েছে সিঁদুরগোলার ফোঁটা । নদীর পাড় থেকে উঠোনের মাঝখান দিয়ে ঘর পর্যন্ত আঁকা হয়েছে লক্ষ্মীর পা । লক্ষ্মী জল থেকে উঠে আসবে -- বলে মেজদিকে ক্ষেপিয়েছি । এখন হাতজোড়া । না হলে ওর হাতটা একটু বেশিই চলে। আমি ঘুষি বাগালে অবশ্য পারবে না কিন্তু মা তাহলে আমায় আস্ত রাখবে না। ছোট বোনটা অনেক্ষন আল্পনা দেবে বলে ঘ্যান ঘ্যান করছিল মায়ের কাছে। অবশেষে একটু চালগোলা পেয়ে তুলসী তলায় আঁকতে বসেছে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এর মতো লক্ষ্মীর পা । খারাপ হলে বলা যাবে না , তাহলে বাড়ি মাথায় করবে। আল্পনা দেয় ও বাড়ির নদি আর বড়মা , তবে সেরা দিদি। এখন একগাদা নারকেল নিয়ে বসেছে সকাল থেকে। কলাপাতার উপর সাদা স্তুপ। দিদির কাল ছুটি শেষ পরশুদিন মিশনারি হোস্টেলে চলে যাবে। তাই মন খারাপ খুব।
দশমীর পরদিন থেকেই মুড়ির চাল তৈরি , মুড়ি ভাজা , খই ভাজা , বাছা , তিল ছোলা ভাজা চালভাজা , চিড়ে ভাজার কাজ হয়ে গেছে । মুড়কি , মোয়া , তিলের নাড়ু , চালভাজা চিড়েভাজার নাড়ু এসব কালকেই করা হয়ে গেছে । গরম মোয়া আর নাড়ু দ্রুত পাকাতে হয় তাই সবাই হাত লাগায় । আমার দুর্ণামের কারনে তখন কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। অল্প তিল আর ভাঙা গোলমরিচ দিয়ে বানানো গরম মোয়ার স্বাদ হাজার লক্ষ টাকাতেও মিলবে না। আজ শুধু নারকেল নাড়ু মোহনভোগ আর গাওয়া ঘিয়ের লুচি। এই একটা দিনেই মা গাওয়া ঘিয়ের লুচি বানায় । আমাদের গরু অদূরীর দুধের সরবাটা ঘি। মা নিজে হাতে বানায়। তার সুবাস ছড়িয়ে যাবে সারা পাড়াময়। আর মায়ের মত নাড়ু এই গ্রামের কেউ বানাতে পারে না। চিনির সঙ্গে গুড় ম আর সঙ্গে অদূরীর ঘন দুধ মিশিয়ে স্বর্ণাভ চকচকে গোলাকার বস্তুটিকে অপার্থিব বলা যায় । সরপুরিয়া সরভাজা কে বলবে তফাতে থাক।

আজ মায়ের উপোস । আমাদের জন্য ডালসিদ্ধ আলুচচ্চড়ি আর ঘি। বাড়িতে লেগহর্ন রোডআইল্যান্ড মুরগির ডিম আছে যথেষ্ট ।অমলেট হলে জমে যেত , কিন্তু আজ ওসব বন্ধ। খাওয়ার পর নাড়ু পাকানো শুরু হলো। আমাকে দলে নেয়নি। কুলোর উপর কলাপাতা আর কাঁসার বগি থালায় রেখে ঠান্ডা করতে দেওয়া হল। একটি থালা মিটসেফের উপর ,ঘরের ভিতর থেকে জানলা দিয়ে বোধকরি হাতে পাওয়া যাবে।
কিন্তু বাড়িভর্তি লোক একটু অন্ধকার হলেই ম্যানেজ হয়ে যাবে।
বাবা দোকানে বেরিয়ে গেলেন। বিকেল হয়ে আসছে। পাট কাচা শেষ । এখনো নদীর ধারে পাটকাঠির গাদা দেওয়া। জল এরপর হু হু করে কমতে শুরু করবে। একটু আধটু শীতের আভাস পাওয়া যায়। সন্ধ্যা লাগতেই ও পারটা ধোঁয়া ধোঁয়া । সারা পাড়া থেকে নাড়ু মুড়কি বানানোর জন্য গরম গুড়ের সুবাস ভেসে আসছে । দূরে সন্ধ্যার শাঁখের শব্দ ভেসে আসছে। ঘোষপাড়ায় অনেক চাষিবাড়িতে প্রতিমা গড়ে পুজো হয় সেখান থেকে কাঁসর ঘন্টার শব্দ ভেসে আসে । এমন সময় আমাদের ধানের মরাই এর পাশ দিয়ে ঢাউস একখানা চাঁদ উঠলো। আর একটু পরেই চাঁদের আলোয় হাসতে লাগলো নদী আর আলোর বন্যায় ভেসে গেল চরাচর।
আমাদের গ্রামে একজনমাত্র ব্রাহ্মণ । আহিভূষন চ্যাটার্জি বা ভূতোথাকুর। সাত গাঁয়ে তার জজমান। বাপ আর দুই ছেলেই পুজো করে । কখনো ব্রাহ্মণী গ্রামের জেলে বা কামার বাড়িতে গিয়ে ফুল বেলপাতা ফেলে দিয়ে আসেন ঠাকুরকে। ছেলেরা বাইরে গেলেও ঠাকুরমশাই গ্রামেই পুজো করেন। শেষ পুজো আমাদের বাড়িতে করে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি ফেরেন। তারপরেও অনেক্ষন জাগতে হয় । মুসলিম পাড়ার বাচ্চা ছেলেরা বালিশের ওয়াড় হাতে করে প্রসাদ চাইতে আসে। আর সবাই একসঙ্গে -- লক্ষ্মী পুজোর ভুজো দাওনা , এইসব বলে একটা ছড়া কাটে তারস্বরে , রাত বারোটা অবধি।
রাত বাড়ে। পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে কাঁসরঘন্টার শব্দ ভেসে আসে। কিন্তু খবর নিয়ে আসলো মেজদি যে , ভূতোথাকুর সাতঘাটা গ্রামে পুজো করতে গেছে আজ আসতে পারবে না। রাত আটটা নাগাদ বামনি বুড়ি আসলো পুজো করতে দুটো ফুল বেলপাতা ফেলে অং বং করে চলে গেল। বাবা চলে এসেছিলেন দোকান থেকে ,বামনির কান্ডকারখানা দেখে রেগে গিয়ে মাকে বললেন -- তোমার সংসার , তোমার লক্ষ্মী তোমার আপন , তোমার লক্ষ্মী ওই বামনিবুড়ির হবে কি করে।তোমার মত করে পুজো কর ।
আর বাড়ির কাজের লোকেরা জোরগলায় বাবাকে সমর্থন করে। আমাদের বাড়ির তোয়াজ কাকা , নূর ইসলাম দাদা ,বনমালী মামা, সুবল দাদা সবাই খুব ভালো জোকার ( উলু ) দিতে পারতো। চপলা পিসি তার মেয়ের হাত থেকে বড় শাঁখটা কেড়ে নিয়ে গাল ফুলিয়ে ফু জুড়লো ,এত দম তার যেন থামবেই না আর ।কাকা দাদাদের জোকার ধ্বনিতে ভরে উঠলো আকাশ , ছড়িয়ে গেল বোধহয় ওপারের গ্রামে । কেউ তুলে নিয়েছে কাঁসর । এরই মধ্যে হ্যারিকেনের আলোয় গলবস্ত্র হয়ে বসলেন মা । চোখবুজে আবৃত্তি করতে লাগলেন হাজার বার করা লাইনগুলি
দোল পূর্ণিমার নিশীথে নির্মল আকাশ ।
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস ।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ ।
কহিতেছে নানা কথা মুখে আলাপন।।
সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে মায়ের কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়লো আকাশে বাতাসে। পুজো শেষ হতে দেরি হবে। নদীর ধারে পাটকাঠির গাদায় বসে আছি। মেয়েদের ব্রতকথায় পড়েছিলাম। এক রাজার সন্তানকে সাপে কামড়ানোর পর এক ওঝা তাকে বাঁচিয়েছিল । রাজা অনেক পুরস্কার দিতে চাইলে ওঝা তার স্ত্রীর শেখানোমত বলে -- কোজাগরী লক্ষীপুজোর দিন সমস্ত নগরবাসী যেন আলো না জ্বালে। সেইদিন লক্ষ্মীদেবী আকাশে বিচরণ করতে করতে মর্ত্যে কোথাও আলো দেখতে না পেয়ে সোজা ওঝার ঘরে। আর ওঝার কোনো দুঃখই থাকলো না । যদিও সে ধনী হয়নি।

সে সময় আমাদের উঠোনে গোলাভরা ধান , গোয়ালে গরু বাছুর , বাবার ব্যবসা জমজমাট বাড়িতে একগাদা কাজের লোক। মনে হচ্ছিল মায়ের প্রার্থনায় লক্ষ্মীদেবী আমাদের উঠোনে নেমে আসবেন ঠিক।

এসব সাতচল্লিশ বছর আগের কথা । বড় জামাইবাবু নেই , দিদি বেহালার বাড়িতে একা।ছোট বোনটি আর্থারাইটিসে শয্যাশায়ী । মায়ের স্মৃতিভ্রম কিন্তু পুরোনো কথা মনে পড়ে কখনো কখনো , বড়মা এখনো আছেন কিন্তু কতদিন দেখা হয়নি। আজো লক্ষ্মীদেবীর পুজো হলো শান্তনুর দশকর্মা ভান্ডারের কেনা দেড় কেজি ধানে । গিন্নির সুগার তাই নাড়ু মুড়কির পাঠ উঠে গেছে । নদীটা প্রায় শেষ । ঢাউস চাঁদটা কিন্তু আজও উঠবে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাবে চরাচর। কিন্তু ইট কাঠের শহরে সে জ্যোৎস্নার দেখা মেলেনা কতোদিন। লক্ষ্মীদেবী এখনো নামেন তাঁর ঐশ্বর্যের ডালি নিয়ে কিন্তু গ্রামের গৃহস্থবাড়ি একেবারেই অন্ধকারে ,তাঁর গন্তব্য এখন আম্বানি নীরব মোদি , প্রমোটার আর রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীদের ঘরে।

________________________________

 

দেবব্রত তরফদার। এপার বাংলা ও ওপার বাংলা: দুই বাংলার হাজার হাজার পাঠক হৃদয় জয় করা লেখক। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। তার সদয় সম্মতিতে লেখা ডাক্তার প্রতিদিনেও প্রকাশ হচ্ছে।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়