Ameen Qudir

Published:
2018-10-21 23:43:30 BdST

বাবাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে


 



অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
________________________________

বাবাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

যখন ডাক্তারি পড়তাম,হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরলে খাবার টেবিলে জননীর অত্যাচার/ভালবাসা/উৎকন্ঠা টের পেতাম। সব মা সন্তানদের গাবদাগোবদা বানিয়ে ফেলার চেষ্টায় যে কেন এত আগ্রহী বুঝতাম না।হয়তো হস্টেলে থেকে ভাল খেতে পাই না,এই ধারনায় তিনি বদ্ধমূল থাকতেন।যাই হোক। মাকে অ্যাভয়েড করতে পারি। কিন্তু মেনুতে যখন তিন রকম মাছ ইত্যাদি থাকত, বাবার সাথে টেবিলে বসতে ভয় পেতাম আমি। মাছটা আমার অপছন্দ নয়। কিন্তু মাছ খেলেই কোন এক অজানা কারণে আমার গলায় কাঁটা আটকাবেই। তবুও বাবা আমাকে মাছ খাওয়াবেনই। কারণ মাছ হলো....ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছোটবেলা থেকেই বাবা মাঝেমাঝেই ইংরেজিতে কথা বলেন আমার সাথে। বিশেষ করে খাবার টেবিলে। আমার জননী ইংরেজি খুব বেশি বোঝেন না। বাবা এই সুযোগে তাকে জ্বালাতে ছাড়েন না। খানিকটা জটিল ইংরেজি বলে মাকে বলতেন, ”হেই লেডি, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?” মা রেগে গিয়ে বলেন, "নো, ওগুলো বুঝি না।” বাবা বলতেন , ”ইংরেজি বোঝে না। মূর্খ মহিলা।” এটুকু বাংলায়। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন তার সহধর্মিনী।

বাবার সাথে বিকেলে কখনো কখনো হয়তো লুডু খেলা হত। খেলায় চুরিতে বাবা ওস্তাদ। গুটির চাল দেবেন এমনভাবে, হাতের সাথে কাঁচা গুটি পাকা হয়ে যেতে সময় লাগে না। কিন্তু স্বীকার কখনোই করেন না। ওটা নিয়ে কথা তুললে বলেন, খেলায় পারি না বলে আমি নাকি ঝগড়া করি। আমার নাকি উকিল বা পুলিশ হওয়া উচিত ছিলো,ডাক্তার না হয়ে।। রেগে যেতাম।

গত দুবছরে তাঁর দুটো জটিল একটা অপারেশন হলো। বেডে শুয়ে থাকা বাবাকে দেখে মায়া লাগত আমার। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, মাঝে মাঝেই উঠে একটু আধটু হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু তিনি হাঁটেন খুব কম।

আমরা বকাবকি করি। তিনি একটু হাসেন। বলেন, ”আমি তো হাঁটতেই চাই। কিন্তু শরীরের ভেতরের টিস্যুগুলো দুই ভাগ হয়ে যে ঝগড়া শুরু করে দেয়।” আমি অবাক চোখে তাকাই। তিনি বলে যান, ”একদল টিস্যু বলে, ওঠ, একটু নড়াচড়া কর, পেপার পড়, একটু ঘুরে ফিরে বেড়া। আবার অন্যদল টিস্যু বলে, কোনো দরকার নেই। উঠতে গেলেই দেখবি এখানে ব্যাথা, ওখানে ব্যাথা। তারচেয়ে আরামে আছিস, আরামে থাক। নড়াচড়া করার কোনো দরকার নেই। এরাই মনে হয় দলে ভারি। তাই আমি শুয়ে থাকি।” হাসবো না ধমক দেবো বুঝে উঠতে পারি না আমি।

আমার বাবার মতো ঘুমকাতুরে মানুষ পৃথিবীতে বিরল।সারারাত ঘুমের পর সকালে, তারপর দুপুরে, তারপর আবার সন্ধ্যায় ঘুমোতে তার কোনো আপত্তি নেই। আর রাতে ঘুম নষ্ট করার তো প্রশ্নই আসে না। আবার এই মানুষটার মতো পরিশ্রমী মানুষও খুব কম দেখেছি আমি। কাজের সময় খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে বিরতিহীনভাবে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি তাকে। রিটায়ার করার পর,আমার মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের চক্র পাল্টে গেছে।

সময় কেটে যায়। বয়স হয়ে যাচ্ছে বাবার। তবু সেন্স অফ হিউমার কমেনি একটুও। এবার বিজয়ার প্রণাম করলাম। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন.
'এই পূজোও পার করলাম রে...কেমন বুঝচিস !'
আমি বুঝতে চাইনি। মাথা নিচু করে চোখ চেপে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি।
________________________________________

- অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস । বাংলার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। থাকেন কলকাতায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়