Ameen Qudir

Published:
2018-10-14 21:41:56 BdST

উর্দু মোটেও আরবের ভাষা নয়: উর্দু ভাষার জন্ম ভারতেই


 


ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী,গুয়াহাটি
______________________________

উর্দু ভাষার জন্ম এই দেশে। আমাদের ভারতে। উর্দু মোটেও আরবের ভাষা নয়। তথাকথিত "পবিত্র" ভাষা ভাবারও যুক্তি নেই। উর্দু একান্তই একটি সাহিত্যের ভাষা। এবং কৃত্রিমভাবে জন্ম। সাহিত্যের বলেই এর একটি প্রয়োগিক মিষ্টি দিক আছে। পাঠান আমলের বিখ্যাত কবি আমির খসরু ফার্সি ও তখনকার দেশজ হিন্দি মিলিয়ে নতুন একটি ঠাঁট তৈরি করেছিলেন। সেটিই সম্রাট শাহজাহানের আমলে "উর্দু" হিসেবে রূপ লাভ করে। এই তথ্য জানিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর বিখ্যাত "পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা" প্রবন্ধে।
১৯৪৭-এর ৩০ নভেম্বর সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায় "রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিত" শীর্ষক বলতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অপরিসীম সমর্থন ব্যক্ত করেন যুক্তিতথ্য সহ। শরিয়তি মোল্লারা ক্ষেপে যায় এতে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মুজতবা ভাষণ অসমাপ্ত রেখেই সভাস্থল ত্যাগ করেন।
বাঙালি হওয়ার পরও একাংশ মানুষের ইসলাম ধর্মের নামে উদগ্র "ভাষাপ্রেম" কোন্ স্তরে থাকে সেটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের সময় একটি ঘটনা। ১৯১৯-এ রবীন্দ্রনাথ সিলেট ভ্রমণে যান। বিশ্বকবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সিলেটকে কবি "সুন্দরী শ্রীভূমি" নাম দিয়েছিলেন। কবির সংবর্ধনা যারা দিয়েছিল~সবাই বাঙালি। কবিও বাঙালি। দর্শক শ্রোতাও বাঙালি। তবুও অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি সৈয়দ আবদুল মজিদ ভাষণ দিলেন উর্দুতে। ("সৈয়দ মুজতবা আলী : জীবনকথা"--নুরুর রহমান খান, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ, পৃ.২০)। একাংশ মুসলমান বাঙালির এই যে বাংলাভাষার প্রতি বিদ্বেষ এটা নতুন নয়। এরা গোঁড়া। শরিয়তি। এরা বাংলাদেশের বিখ্যাত একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা-আন্দোলন(যা এখন "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস")-এরও বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমর তাঁর "ধর্ম রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা" বইয়ে লিখেছেন~
"পূর্ব পাকিস্তানের জামাতে ইসলামির আমির গোলাম আজম শুক্কুরে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটা মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল।...জামাতে ইসলামি নেতা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে বলেছেন যে, উর্দু হচ্ছে এমন একটা ভাষা যার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষার উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার সম্ভব।"(পৃ. ১০৩)
সৈয়দ মুজতবা আলীর সিলেটের ওই সভার অসমাপ্ত ভাষণটিই পরে বিস্তারিতভাবে "চতুরঙ্গ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় "পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা" নামে। ইসলামের নামে বাংলাভাষাকে ব্রাত্য করে জবরদস্তি আবরি ফারসি বা উর্দুকে চালানোর যে তীব্র ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস~তার বিরুদ্ধে তথ্য সহ বিশালভাবে আলোচনা করেছিলেন মুজতবা আলী। আজকের দিনে মুজতবার এই প্রবন্ধটি প্রত্যেক বাঙালির পড়া উচিত।
••••
এই উর্দু-প্রেমীদের ভোটব্যাংক অটুট রাখতে এবার খোদ পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় তৃণমূল সরকার। এর আগে পাঠ্যপুস্তকে "রামধনু"-কে "রংধনু" করার মধ্য দিয়ে ভোটের স্বার্থে তোয়াজ তোষণ শুরু করেছিল। এবার আরও ভয়ংকর।
গতকাল (২০-৯-২০১৮) উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের দাড়িভিটা গ্রামে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেন রাজেশ সরকার, তাপস বর্মন নামে দুই যুবক। স্থানীয় বাংলা মাধ্যমের স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা, সংস্কৃত বিজ্ঞান ইত্যাদির প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। অথচ সরকার সেখানে উর্দু শিক্ষকের নিযুক্তি দেয়। অথচ উর্দুভাষী পড়ুয়া প্রায় নেই সেখানে। দুহাজারের মধ্যে মাত্র আটটি। প্রশাসনের অদ্ভুত যুক্তি~উর্দু পঠনপাঠন শুরু না-হলে উর্দুভাষী পড়ুয়া সৃষ্টি হবে কী করে!!!!!????
তাহলে উদ্দেশ্য কী?! উদ্দেশ্য একটাই~তোষণ-তোয়াজ করে ভোটব্যাংক তৈরি।
স্বভাবিকভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়। এবং গুলিতে শহিদ হয় দুই ছাত্র।
••••
পাকিস্তান তার নিজের ধর্মীয় ও প্রশাসনিক স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন শহিদ হন। বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম।
মমতা ব্যানার্জি কীসের স্বার্থে এসব করছেন, সেটা আর রাখঢাক করে লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
••••
রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন আবারও বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ আহূতি দিল। আসলে বলা ভালো মাতৃভাষার জন্য...। এর আগে ঢাকায় ও শিলচর-করিমগঞ্জে মাতৃভাষার জন্য রক্ত ঝরেছে। খোদ পশ্চিমবঙ্গে এবার বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিল দুই ছাত্র। রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন ভাষাজননীর জন্য শহিদ হলো।
••••
ভাষা শহিদ রাজেশ আর তাপসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
আর তোয়াজ-তোষণ তথা খুনি মানসিকতাকে তীব্র ধিক্কার জানাই।
______________________________

ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী
বাংলা বিভাগ
কটন বিশ্ববিদ্যালয়
গুয়াহাটি
২১-৯-১৮।
লেখাটি বাংলার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে পাওয়া।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়