Ameen Qudir

Published:
2018-10-11 23:42:40 BdST

সুখ কাকে বলে : কয়েকটি টুকরো গল্পে বলছি


 

 


ডা. জোবায়ের আহমেদ

___________________________


কয়েকদিন আগে কুমিল্লায় বাসায় গেলাম।আমি যখন বাসায় পৌঁছাই তখন আম্মা রান্না ঘরে বড় ছেলের জন্য রান্না করছেন। আমি আমার মা এর বড় ছেলে।
আমি রান্নাঘর এ গিয়েই আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
বেচারি ঘামে ভিজে একাকার। সেই ঘামে নাক ঘষলাম আমি।মা কে চুমু দিলাম। আম্মা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেন,দাঁড়াও, ঘাম মুছে নেই।আমি মা কে জড়িয়ে রাখলাম।অন্য ভাই বোন ও আব্বা দেখছেন মা ছেলের আবেগপূর্ণ মিলন।
মায়ের মুখের মিষ্টি হাসি ও ঘামের গন্ধে আমি খুঁজে পাই সুখ।।আমি খেয়াল করলাম আব্বার চোখ ভিজে উঠছে মা ছেলের ভালবাসা দেখে।সেই ভেজা চোখে সুখ খুঁজে পেয়েছি আমি।

আমার দাদি আমাদের একমাত্র আবদার এর জায়গা ছিলেন।খুব মনে পড়ে দাদি কে।আব্বার প্রতি একটা গভীর ভালবাসা ছিল দাদির। গরুর মাংস খেতে খুব পছন্দ করতেন।
আমি যতবার বাড়ি যেতাম, দাদির জন্য গরুর মাংস নিয়ে যেতাম।গরম ভাত, সাথে গরুর মাংস ভুনা খাচ্ছেন দাদি, সাথে কত রকম এর গল্প।খাওয়ার পর পা দুটো মেলে পান খেতে খেতে গল্প বলে যাচ্ছেন দাদী, আমি শুয়ে থাকতাম দাদীর পায়ের উপর।।
দাদির গরুর মাংস খাওয়ার দৃশ্য দেখে দেখে আমি সুখ অনুভব করতাম।

দাদাভাই তখন মর্ডান হসপিটাল এ ভর্তি।
রাতে প্রেসার লো হয়ে গেল।আমি এবং আব্বা রাত তিনটায় কাঁচা ঘুম থেকে উঠে রানীর দীঘির উত্তর পাড় থেকে হসপিটালে গেলাম।সকাল পর্যন্ত কয়েকবার প্রেসার মেপেছিলাম আমি।
দাদাভাই অনেক দোয়া করেছিলেন সেদিন।
পরে দাদাভাই এর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল।নিয়ে গেলাম ল্যাব এইড এর আইসিইউ তে।
ভেন্টিলেটর এ দেওয়ার আগে দাদাভাই আমার হাত ধরে আছেন।বল্লেন,তোদের জন্য মায়া লাগে ভাই।আরো কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছে কিন্ত সময় যে আর নেই।
যেতে হবে।। আইসিইউ তে যখন দাদাভাই, তখন ক্লান্ত শরীরে ল্যাব এইড এর ফ্লোরে রাতে ঘুমাতাম আমি।এর আগেও দাদাভাই অ্যাপলো হসপিটাল ও কুমিল্লার সিডি প্যাথ এ চিকিৎসা নিয়েছেন।তখনো ফ্লোরে ঘুমাতে হয়েছে দাদাভাই এর এ্যাটেন্ডেন্ট হয়ে।
সেই কয়েক টা রাত ফ্লোরে ঘুমিয়ে আমি অনেক সুখ পেয়েছিলাম যেটা অনেক দামী কিং সাইজ বেডে ঘুমিয়েও পাইনি অনেক রাতে।।
আব্বা স্কয়ারে ভর্তি হলেন।আমি সিলেট থেকে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছলাম রাত ৪ টায়।হসপিটালে গিয়ে দেখি এ্যাটেন্ডেন্ট এর সোফায় ঘুমাচ্ছে বোন জামাই শরীফ।আমি আব্বার খোঁজ নিয়ে ক্লান্ত শরীরে একটা চেয়ারে বসে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। বাবার জন্য চেয়ারে বসে ঘুমানো সেই কয়েক ঘন্টায় যেই সুখ পেয়েছিলাম, তা পাইনি অনেক কাল।।

গত বছর আব্বাকে হজ্জ করিয়ে আনলাম।
এর আগের বছর দালালের খপ্পরে পড়ে যেতে পারেন নি।খুব কষ্ট পেয়েছিলেন না যেতে পারার জন্য।এইবার ও শেষ সময়ে এসে যাওয়া টা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
আব্বা ভেঙে পড়লেন।আমি বিভিন্ন মাধ্যমে দালাল কে চাপে ফেলে যেদিন ভিসা টা আব্বাকে দেখাই, আব্বা আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন।সেদিন বাবার গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে সুখ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি।।

আমার মা খুব অসুস্থ।একদিকে ডিসফাংশনাল ইউটারিন ব্লিডিং, অন্য দিকে পিত্তথলির পাথর এর তীব্র কলিক এ তিনি কাতরাচ্ছেন।আমি তখন মেডিকেল এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।বিভিন্ন জন এর কাছে টাকা ধার চাচ্ছি।।এক বড়লোক কাকার কাছে টাকা ধার চাইলাম।তিনি বল্লেন এটা তোমার বাবার দায়িত্ব। তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া কর।আমি বল্লাম মা এর অপারেশন দরকার।এনিমিক হয়ে যাচ্ছেন।গল স্টোনের ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন খুব।সন্তান হয়ে মা এর এই কষ্ট মানা যায়না।
আমি অনেক রিকোয়েস্ট করলাম উনাকে।
উনি বিরক্ত হয়ে আমাকে ফকির বলে গালি দিয়ে বসলেন।বল্লেন আমার রক্ত নাকি ভিক্ষুকের রক্ত।
আমার রক্ত ভিক্ষুক এর রক্ত এটা ভেবে আজো সুখ পাই।।

ড.দেলোয়ার কাকা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন।রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্ত আমাদের হৃদয় এর গভীরে বসবাস করেন তিনি।
উনি আমার জীবনে অনেক প্রভাব রেখেছেন।একদিন সুখের ডিফিনিশন শেখালেন।
জীবনে সুখী হতে চাইলে কারো কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করার কথা বল্লেন।
উনি আমাকে বলতেন, তুমি যাদের জন্য অনেক কিছু করবে তারাই তোমাকে বড় বড় আঘাত গুলি দিবে।
কিন্ত অন্যের জন্য কাজ করে সেই সুখ তুমি পাবে সেটা দাণ বা করুণা গ্রহীতা তা পাবে না।
অনেক টা মাদার তেরেসার মত বলেছেন।
তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষ কে ভালবাসতে না পারো,তাহলে অদৃশ্য ইশ্বর কে কি করে ভালবাসবে।?

আমাদের এলাকার অনেক বড় শিল্পপতি, টাকার পাহাড়,ব্যাংক বীমা,গার্মেন্টস কি নেই উনাদের।
স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের সেই বড় কর্তা ব্যক্তিজীবন এ নিঃসন্তান।উনার সাথে একবার গল্প হয়েছিল আমার।উনার হাত থেকে বরুড়া ফাউন্ডেশন এর বৃত্তির ফাস্ট প্রাইজ নিয়েছিলাম আমি।
এত টাকার পাহাড়ের মাঝে থেকেও গভীর বিষাদ এ ভরে থাকে উনার মন।

পাঁচ তলার আলীশাল বাড়িতে একাকী বসবাস করেন আমার এক খালামনি।দামী গাড়িতে চড়েন।
ভাল ভাল খাবার খান,দামী পোষাক পরেন।
কিন্ত যখন রাত নেমে আসে তখন তিনি একা।
শূন্যতা ঘিরে ধরে উনাকে।
ছেলে মেয়েরা দেশে বিদেশে নিজের সংসারে ব্যস্ত।
নাতী নাত্নী বিহীন এই বিস্বাদ জীবন এ উনি হাঁপিয়ে উঠছেন।সব কিছু আছে উনার।কিন্ত
সুখে কি আছেন উনি?

কিছু মানুষ আছেন, হয়ত উনারা সংখ্যায় অল্প কিন্ত আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন।মায়া করেন।স্নেহ করেন।আদর করে সন্তানের মত জড়িয়ে ধরেন।
পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেন।সাহস যোগান।
নিজের গাছের লাউ, পেয়ারা,পেঁপে,আম পাঠান।
দেশী একটা মোরগ নিয়ে আসেন।বাড়ি থেকে নানা রকম পিঠা বানিয়ে নিয়ে আসেন।বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে আসেন।আমার অভাবের দিনে নিজের হাতের সোনার বালা বিক্রি করে টাকা ধার দিয়ে পাশে দাঁড়ান।
সূদুর আমেরিকা থেকে সাহায্যের হাত বাড়ান।
সেই অল্প সংখ্যক মানুষ এর তীব্র মায়ায় পূর্ন আমার প্রান।সুখে ভরে আছে আমার হৃদয়।।

The Best feeling of happiness is when you are happy because you have made somebody else happy.
____________________________________

ডা. জোবায়ের আহমেদ ।সুলেখক। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪২ ব্যাচ।
এবং
Executive Director at Dr.Jobayer Medicare Center
former Resident Medical officer at ড.এম এ রহমান হসপিটাল
Former Intern Doctor at Sylhet MAG Osmani Medical College Hospital
Studied MBBS at Sylhet MAG Osmani Medical College

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়