Ameen Qudir

Published:
2018-09-05 15:46:39 BdST

তালাক ! তালাক! তালাক! সংসার ভাঙ্গন রোধে করনীয়



অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম
________________________________

সম্প্রতি প্রথম আলোতে একটি লিডিং নিউজ হয়েছে যে দেশে দিন দিন তালাকের হার বাড়ছে। এতে আরো উল্লেখ করা হয় যে নারীরা অধিক হারে তালাকের আবেদন করছে এবং ঢাকায় দিনে একটি তালাক।

প্রতিটি মানুষ জীবনে দুটি বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে - এক হচ্ছে তার সন্তান ও দ্বিতীয় হচ্ছে তার দাম্পত্য জীবন।আমরা সবাই চাই একটি নিরাপদ, সুখী,মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্য জীবন। প্রতিটি বিয়ের প্রাক্কালে সবার মনে এই প্রার্থনা থাকে " আজীবন আমরা একত্রে থাকবো "।

আমরা সবাই যদি " পারফেক্ট " হতাম তাহলে হয়তো এই প্রতিজ্ঞা আজীবন ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু মানুষ মাত্রই রয়েছে খুঁত, ক্রটি ও দোষ। আমরা বদলে যাই, জীবন বদলে যায় এবং এই " বদলে যাওয়া একে অপরকে বলতে ভুলে যাই "।

বছরের পর বছর একই বিছানায়, একই ছাদের নীচে বাস করেও অনেকেই নিজেদের মধ্যে কানেক্টেড ফিল করে না

।মনে রাখা ভালো প্রেম বা বিয়ের প্রথমদিকের " ভালোবাসার উন্মাদনার " উচ্ছ্বাস বড়জোর ২ বছর থাকে। তারমানে এ নয় ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে বা ভুল মানুষকে চয়েজ করেছি।

ভালোবাসা কোন নির্দিষ্ট অবস্থা নয়,এটি একটি কর্ম, জীবন দক্ষতা -যা প্রতিনিয়ত প্রদর্শন করতে হয় ও প্রাকটিস করতে হয়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে তালাকের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তালাকের আবেদনে কাজীরা স্বামী / স্ত্রী বা অভিভাবকদের কতগুলো গৎবাঁধা বুলি বা অভিযোগ নামা বলে দেয় সেখানে উল্লেখ করতে। গভীর মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণে তালাকের জন্য বহুবিধ কারনকে দায়ী করা হয়।

তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারন হচ্ছে -

দাম্পত্য জীবনে "কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া" ( কমিউনিকেশন ব্রেকডাউন)

এবং স্ব-ইচ্ছায় দাম্পত্য জীবনে ইতিবাচক " বিনিয়োগের " অভাব (লেক অব ইনটেনশনাল ইনভেস্টমেন্ট ইন ম্যারেজ) ।

এছাড়া রয়েছে ঃ

পরকীয়া প্রেম/দাম্পত্যে অবিশ্বস্ততা ;
শারীরিক /আবেগীয় নির্যাতন ;
মাদকাসক্তি;
যৌন সমস্যা ;
মৌলিক বিশ্বাস, মুল্যবোধে বড় ধরনের অমিল;
শ্বশুর পক্ষীয় লোকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ;
আর্থিক /সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণে অবহেলা ;
যৌতুক বিষয়ক জটিলতা ;
ঈর্ষান্বিত পার্টনারের যন্ত্রনা ;
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ও অনৈতিক ব্যবহার
;প্রতিশোধ প্রবনতা;
বন্ধু /আত্মীয়দের কাছে নিরন্তর অপর পক্ষের বিরুদ্ধে বদনাম করে যাওয়া ;
সন্তানদের কায়দা করে নিজ পক্ষে নিয়ে অপর পক্ষকে( বিশেষ করে স্বামীকে) জব্দ করার চেষ্টা ;
অযত্ন, অবহেলা, পরিত্যক্ত করে রাখা - ইত্যাদি শত কারণ।

তবে যে " যোগাযোগ ঘাটতি /বৈকল্য " এর কথা বলেছি সেটি গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্যে ৪ ধরনের যোগাযোগ সমস্যা দেখা দিতে পারে

ঃ১।আত্ম সমর্পণ বা বিরোধিতা থেকে বিরত থাকা ( ইল্ডিং)--

তিক্ততার এক পর্যায়ে এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে তারা আর কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে,সমঝোতায় আসতে চেষ্টাই করে না।

তারা পারস্পরিক ঘৃনা, অবজ্ঞায় সব ধরনের যোগাযোগ এড়িয়ে চলে- ভাবখানা এমন, এসব নিয়ে আলোচনা বৃথা।
ফলে তীব্র ক্ষোভ, বিরক্তি,অসন্তুষ্টি জমতে থাকে ও ধীরে ধীরে বিষন্নতায় ভুগতে থাকে।

২। নিশ্চল/নির্বাক হওয়া( ফ্রিজিং)-

এ ক্ষেত্রে তারা কোন বিষয়ে আলোচনা করতে " বিলম্বিত " করার পন্থা নেয় বা স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলে।
ফলে নিজেদের মধ্যে বরফাচ্ছাদিত একটি দেওয়াল তৈরি হয়।তাদের মধ্য দিন দিন উদ্বেগ -টেনশন বাড়তে থাকে।

৩। পালিয়ে বেড়ানো ( ফ্লাইট) -

নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা অন্য দিকে অধিক মনোযোগ দিয়ে নিজকে ব্যস্ত রাখতে চায়।এভাবে তারা একে অপর থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কেউ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে,
কেউ মাদকাসক্ত হয়,
কেউ পর্ন দেখে,
কেউ সারাক্ষণ কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে
আবার কেউ বা " কাজ পাগল" হয়ে সারাক্ষণ অফিস / ব্যবসা স্হলে দিন গুজরান করে।

৪। যুদ্ধ / প্রতিযোগিতা /প্রতিদ্বন্দ্বীতায় লিপ্ত হওয়া (ফাইট)--

এটি হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের যোগাযোগ বিপর্যয়।
এরা সবসময়
একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা,বদনাম করতে থাকে ;
অনবরত অভিযোগ, নালিশ করতে থাকে ;
খুটিনাটি বিষয়েও সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে
;তর্ক - বিবাদ তাদের রুটিন ওয়ার্ক;
এমনকি মৌখিক ভাবে গালাগালি করে অপর পক্ষকে পরাস্ত করতে না পেরে হাতাহাতি, মারামারিতে লিপ্ত হয়

।এ মারামারিতে কেউ কাউকে বিন্দু মাত্র "ছাড়" দিতে রাজি নয়-
তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা যে করেই হোক "জিততে" হবে

( যদিও শারীরিক সামর্থ্যে পুরুষ এগিয়ে বলে বাহ্যিক ভাবে মনে হয় পুরুষ জিতেছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে নারী ও তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যায়)।

এ যুদ্ধ এমন যুদ্ধ যে তাদের জিদ ও পণ থাকে " না জেতা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবো "।
প্রায় প্রতিদিন তাদের এরকম খন্ড যুদ্ধ চলতে থাকে ও

তাদের উভয়ের মধ্যে " ভয়ংকর "সব প্রতিশোধ স্পৃহা জাগতে থাকে

( সেটি তালাক দেওয়া থেকে, মামলা, হামলা এমনকি খুন খারাবি কিম্বা আত্মহত্যা) ।

তবে এরকম বেদনাদায়ক চিত্রের পাশাপাশি উজ্জ্বল, সুখী দাম্পত্য জীবনের উদাহরণ ও অসংখ্য।

লক্ষ লক্ষ মানুষ তেমন কষ্টদায়ক দাম্পত্য সমস্যা ছাড়াই সুখী,গর্বিত ও আনন্দিত সংসার জীবন যাপন করছেন।

তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা পূর্ণ, পরস্পর জিতবে(উইন -উইন)তেমন একটি কার্যকর, গঠনমূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়।

যোগাযোগ একটি দক্ষতার ব্যাপার। তাই সবাই এটি অর্জন করতে পারে। সুখী দাম্পত্য জীবনে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা ও দায়বদ্ধতা।

তদুপরি থাকে " পার্টনারশিপ" এর দায়িত্ব -যেখানে দুই ব্যক্তি সারাজীবনের জন্য একে অপরের সঙ্গে মিশে থাকে আবার অন্য দিকে নিজের ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য ও বজায় রাখে।

ড. সুসান হেইটলার " পাওয়ার অব টু" প্রতিষ্ঠা করেন দাম্পত্য সম্পর্ক পুনর্গঠিত করার জন্য। তিনি দম্পতিদের ৩টি " এল" দক্ষতা অর্জন করতে বলেন( লিশ্চেন,লাভ,লার্ন)।

সেগুলো হলো

১।মনোযোগ দিয়ে শোনা ( লিশ্চেন)-

খুঁত, ক্রটির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে যা "সঠিক " ও অপর পক্ষ কি বলতে চাচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শোনা।

একটি কথা আছে " আমরা (অন্যকে) বোঝার জন্য শুনি না,কি জবাব দিতে হবে তার জন্য শুনি "।

এ জন্য কথা কাটাকাটি, গালাগালি, হাতাহাতি হয়

।প্রথমে অন্য পক্ষের ক্ষোভ, অভিযোগ, নালিশ সহমর্মিতার সঙ্গে শুনতে হবে।পরে ঠান্ডা মাথায় ও সুকৌশলে ভিন্ন মত থাকলে তা বুঝিয়ে বলতে হবে

।২। ভালোবাসা ( ল্যাভ)-

ভালোবাসাকে মাঝে মাঝে রিচার্জ করতে হয়,রিনিউ করে নিতে হয়।ভালোবাসা মানে পার্টনারের প্রতি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি ছুড়ে দেওয়া।

প্রতিদিন কিছু ইতিবাচক উষ্ণতা ছড়িয়ে দিন-

সমর্থন, উৎসাহ প্রদান,
ক্ষমা চেয়ে নেওয়া,
সেবা যত্ন,
কোমল কন্ঠে ভালোবাসার কথা বলা,
জড়িয়ে ধরা।

আমার চেম্বারে এক বিবাহিতা রুগিনী স্বামীর বিরুদ্ধে অনুযোগ করে বলেন

" প্রতিদিন ভালোবাসলে কি হয়? প্রতিদিন আবেগ থাকলে ক্ষতি কি? এর জন্য তো কোন টাকা পয়সা লাগে না স্যার "।

৩। শিখতে হবে( লার্ন)--

দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে হলে কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয়।আমরা কেউ মায়ের পেট থেকে এগুলো শিখে আছি না।জীবন থেকে এগুলো শিখে নিতে হবেও প্রাকটিস করতে হবে।

এগুলো নিজে ব্যবহার করে দেখুন অন্য পক্ষের আচরনে ও নাটকীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

পরিশেষে বলবো " হয় আমার পথে চলো না হয় রাস্তা মাপো" ( মাই ওয়ে বা হাইওয়ে) এরকম মনোভাব পরিহার করে
" পারস্পরিকআনুগত্য "(মিউচুয়াল সাবমিশন) মেনে নিলে, দাম্পত্য জীবন হবে অনেক সহজ

।প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতার ও জেতার হিংস্র পথ পরিহার করে

বিনম্র পারস্পরিক আনুগত্য অবলম্বন করলে ভবিষ্যতের আরো বেদনাদায়ক, অপমানকর " হারও লজ্জা " থেকে নিজকে মুক্ত রাখতে পারবেন।
_________________________

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম।

মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটউট ও হাসপাতাল

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়