Ameen Qudir

Published:
2018-08-21 05:10:35 BdST

উৎসব সবিশেষ বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর


লেখার সঙ্গে প্রতিকী ছবি দেয়া হল। কাহিনির চরিত্রের ছবি নয়।


ডা.ছাবিকুন নাহার
________________________
১.
গত কয়েকদিন থেকেই ছেলেটা সাইকেল সাইকেল করছিলো।
: মা আমি যাবো...আমি যাবো...
: আচ্ছা যাবে, আগে একটু বড় হও তারপর।
: না আমি এখনি যেতে চাই, তোমরা থাকবে গাড়িতে, আমি পাশাপাশি যাবো।
: আচ্ছা দেখা যাক।
মনেমনে ভাবি, যার ওয়াশরুমে যেতে বডিগার্ড লাগে, সে যাবে একা একা সাইকেল নিয়ে স্কুলে! যাহ্ ফুট! কিন্তু মুখে বলি, আচ্ছা। বাচ্চাকাচ্চাকে হ্যাঁ বলতে হয়। কিন্তু এই হ্যাঁ যে এমন জান বের করে দিবে কে জানত? অস্থির ছটফট লাগছে, যেনো এখনি কলিজা ফেঁটে চৌচির হয়ে যাবে! বাচ্চাটা ঠিকঠাক আছে তো? কে জানে?

আমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কী ঘূর্নিঝড় বয়ে যাচ্ছে ভেতরে। বিশ্বাস করতে পারছিনা, গুল্লুটা এটা করতে পারল? একা একা কখনো ওয়াশরুমেও যায় না। মিহন, খালা অথবা কাউকে না কাউকে দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে। প্রতিবারই মিহন বলে,
'ভাইয়া, ভূত বলে কিছু নেই, তাইনা মা?'
' হুম।'
'দেখলে মা ও বল্ল ভূত বলে কিছু নেই?'
উপায় না পেয়ে অহন তার প্রিয় রং পেন্সিল, খেলনা এসব ঘুষ দিয়ে মিহনকে পাহারা দিতে রাজি করায়।

রাতে ঘুমানোর সময় হয় আরেক দফা ঘুষ লেনদেন। দুজনেই চায় তাদের মা তার দিকে মুখ করে ঘুমাবে। একজন বলে, 'আমার মা, আমার দিকে থাকবে।'
আরেকজন বলে, 'না আমার মা। আমি আম্মুর পেটে হয়েছি, তোমাকে তো কিনে এনেছে।'
'আরেহ! তোমাকে কিনে এনেছে। আমি জানি, আমি বড় নাহ্?'
এরপর শুরু হয় চিৎকার চেঁচামিচি, মারামারি কান্নাকাটি। কে মায়ের পেটে হয়েছে, কাকে কিনে এনেছে এসব নিয়ে। ফলে ঝগড়া এড়াতে তাদের মাকে মমির মতো টানটান শুয়ে থাকতে হয়। এক চিমটিও কারো দিকে হেলে থাকার উপায় নেই। বেচারা মা এখন স্ট্যাচুর মতো সোজা। একদম।

সেই ভীতুর ডিমটা সাইকেল নিয়ে ... একা একা... কিভাবে সম্ভব! রাস্তায় কত গাড়ি ঘোড়া... কত কী যে ওতপেতে থাকে। রাস্তার নিয়ম কানুন জানে না এখনো। স্কুলের পথ চিনবে কি? গতিদানবরা আমার বাচ্চাটাকে... নাহ্ চোখ জ্বালা করে ওঠে। আল্লাহ তুমি মালিক, রহম করো খোদা।

আজাদ ৯৯৯ ফোন করে। 'হ্যালো...হ্যাঁ পুলিশ কন্ট্রোল রুম? শুনছেন, একটা বিপদে পড়েছি। আমার বাচ্চা একা একা সাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। স্কুলে যাবে বলে। না না আগে কখনো একা যায়নি।' এটুকু কথা বলতেই জাঁদরেল লোকটা কয়েকবার খেই হারলো যেনো। তাবুও ঠিকঠাক কি বলতে চায় বুঝা গেলো না।

: তো? বাচ্চা তো যেতেই পারে।

: আরেহ না, আপনি বুঝছেন না, বাচ্চাটার বয়স মাত্র নয় বছর। কখনো বাসার কম্পাউন্ডের বাইরে একা সাইকেল চালায়নি, রাস্তা তো দূরে থাক।

: বলেন কি? স্কুল কোথায়? নাম কি স্কুলের? আপনার বাসা কোথায়?

: স্কুল কাকরাইল। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ। বাসা ধানমন্ডি সাতাইশ।

: ও মাই গড! সাতাইশ থেকে কাকরাইল! থ্রির বাচ্চা! সাইকেল নিয়ে একা একা!

এবার আজাদের কন্ঠে কান্নার মতো হাহাকার ঝরে পড়ল।
: আপনি তো জানেন না অফিসার, ও এখনো ছোট। ক্লাস ওয়ানে লটারিতে কোথাও নাম উঠল না। রাগে ওয়ান বাদ দিয়ে টু তে এডমিশান টেস্ট দেয়ালাম। বাচ্চা আমার চান্স পেয়ে গেলো। এখন থ্রিতে পড়ে। না হলে সে টু এ পড়ত।

: বাচ্চার নাম, কি ড্রেস গায়ে ছিলো, কোন কোন রুট দিয়ে আপনারা স্কুলে সাধারণত ওকে নিয়ে যান সেসব একটু ডিটেইলস দরকার ছিলো।

: নাম আহনাফ সাদিদ অহন। স্কুল ইউনিফর্ম সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট। আইডি কার্ড গলায়। পিছনে স্কুল ব্যাগ। অরেঞ্জ কালার ছোট সাইকেল।
ছোট কথাটায় একটু বেশি জোর দিলো আজাদ। বুঝাতে চাইল এই সাইকেল বাসায়, অল্প জায়গায় চালানোর জন্য। বড় রাস্তায় এটা দিয়ে কিভাবে কি...
আজাদের গলা ধরে আসে।

পুলিশ অফিসারের কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখা গেলো। বলল, 'আপনি চিন্তা করবেন না, নিকটস্থ থানায় একটা জিডি করেন। দেখি কী করা যায়।'

: সে না হয় করব। আমরা এখন স্কুলের দিকে যাচ্ছি। আপনি একটু যদি কর্তব্যরত সার্জেন্টদেরকে বলে দেন...আমরা সাধারনত ধানমন্ডি সাতাইশ থেকে সাইন্সল্যাব, শাহবাগ,শেরাটনের মোড় ক্রস করে কাকরাইল অথবা নিউমার্কেট, শহিদ মিনার, দোয়েলচত্বর, হাইকোর্ট মৎস্যভবন হয়ে কাকরাইল, এই দুটো রুট ব্যবহার করি। প্লিজ অফিসার প্লিজ, কিছুু একটা করেন। আমার বাচ্চাটা...
ভয়ে আজাদ কথা বাড়ায় না। বললেই অমঙ্গল হানা দেয় যদি?

২.
: তুমিই তো আশকারা দিলে। কাল যখন বলছিলো সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতে চায়। আমি মানা করেছিলাম। তুমি ইশারা করলে, চুপ করে গেলাম। এখন দেখো...

: আমি কি জানতাম নাকি? সত্যি সত্যি ও যাবে?
সকাল সকাল উঠে রান্না করলাম, মিহনকে রেডি করিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলাম। বিচ্ছুটাকে তো তুমি চিনো, এক মুহূর্ত তার কাছ থেকে নড়ার কায়দা নেই। ট্যাগ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ অহন সেখানে গিয়ে বলল, 'মা যাই।' বুঝতে একটু সময় লাগল, 'যাবে মানে? কই যাবে!' তড়িৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো! মিহনকে রেখে উঠতে গেলে শুরু করল কান্না। সাথে সাথে ড্রাইভারকে ফোন করলাম,

'হাসান, অহনকে আটকাও। কুইক!'

'ম্যাডাম, অহন তো চলে গেছে।'

'কখন?'

'এই একমিনিট হলো।'

'কী বলো! তুমি গাড়ি নিয়ে পিছে পিছে যাও। তাড়াতাড়ি।'

হাসান নিউমার্কেট পর্যন্ত গিয়ে পায়নি। কোন দিক দিয়ে যে গেছে ছেলেটা? তুমিতো তখনো ঘুমে। এই ঘুমে সব গেলো। জেগে থাকলে বাচ্চাটা এটা করার সাহস পেত না। রাগ কান্না মাখামাখি হয়ে কন্ঠ বেয়ে ঝরে পড়তে থাকে।

একজন আরেকজনকে দোষারোপ করছি, না নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিচ্ছি ঠিক তা বুঝছি না। যতক্ষন পরস্পরকে অভিযুক্ত করছি, ততক্ষণ ঠিক আছে। বাদবাকি সময় রাজ্যের নীরবতা গাড়ি জুড়ে। সন্তানের অমঙ্গলের আশংকায় বাবা মায়ের নীরবতা ভয়ঙ্কর! সহ্য করা কঠিন।

আশ্চর্য, সময় শেষ হচ্ছে না যেনো! স্কুলে যাব আগে তারপর বাকি সব। পুলিশ বলছে নিকটস্থ থানায় জিডি করতে। জিডি শব্দটা শুনলেই ভয় লাগে। খোদা, আমাকে এই পরিস্থিতিতে পরতে হলো!

সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন দেয়া হয়েছে। স্কুলের গার্ডকে বলেছি, ওকে দেখা মাত্র যেনো আমাদের জানায়। স্কুলের স্যারকেও ফোন দিয়েছি। এতক্ষণে তো ওর স্কুলে পৌঁছে যাওয়ার কথা। একা একা কথা বলছি। কন্ঠে মৃত্যুপুরীর শীতলতা, যেনো ঠোট নড়ছে কথা বের হচ্ছে না।

ছেলেটা এই সেদিন হলো। এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার। নার্সের কোল থেকে ওটি টেবিলে শোয়া আমার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছিলো। কী মায়া! কী মায়া! আমার চোখ ভরে যায় জলে। কেবিনে দিতে না দিতেই শুরু করল হামহুম কান্না, খাবারের জন্য। এদিকে সিজারের পর তিন দিন লাগে বাচ্চার ফিডিং আসতে। নব্য ডাক্তার মা আমি, বাচ্চাকে বুকের দুধ ছাড়া কিছুই দিবে না বলে পণ করেছি। আমি অন্তত এ ক্ষেত্রে পুরাই সেকেলে। দুই বাচ্চাকে আল্লাহ প্রদত্ত খাবার ঠিকঠাক দিয়েছি। নীরেট শক্তপোক্ত আমার বাচ্চাকে ফিডিং দিতে না পেরে সে কি কান্না। বাচ্চা কাঁদে, সমানতালে আমিও কাঁদি। উড়নচন্ডি বালিকার এমন মাতৃরূপে পুরো ইউনিট হা হয়ে গিয়েছিলো। আজকে কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই সেদিনের কথা অথচ...

অহন সাইকেল প্রথম প্রথম ঘরেই চালাতো। এই সাইকেল চালাতে গিয়ে কত বকা যে খেয়েছে বাচ্চা আমার। প্রথমে শো কেসের কাঁচ ভাঙ্গল। ধরাম। আমার তো আত্মা রাম খাচা ছাড়া। এই কাঁচ হাতে পায়ে ঢুকলে আর দেখতে হতো না। এরপর গেলো মিহনের উপর দিয়ে। মুহূর্তেই বাচ্চাটার উপরের পাটির সামনের চারটি দাঁত নাই হয়ে গেলো। নিজেই সাইকেলের ব্যালান্স রাখতে পারে না, তার উপর ভাইকে নিয়ে চালানো, সোজা কথা! এরপর দিলাম তার সাইকেল চালানো বন্ধ করে। না করে উপায় আছে? সারাক্ষণ টেনশনে থাকি! কি হয়, না হয়। আর দেখেন এখন কী হলো?

ভাবতে ভাবতে স্কুলে এসে পৌঁছি। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামি। গেটে দারোয়ান জানায় এখনো নাকি স্কুলে আসেনি। হৃৎপিন্ডটা তখন লাফিয়ে বের হওয়াটা মাত্র বাকি! তারপরও স্যারের বাসা, এদিক ওদিক ইতস্তত খুঁজে বেড়াই। সবখানে নাই... নাই...

হঠাৎ স্কুলের মাঠ ভর্তি লোকজনের মাঝে আমরা দেখতে পাই একজন মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমো খাচ্ছে। আপাত কঠিন মায়ের চোখ ভর্তি জল।

: এই মটু তুই ভয় পাস নি?

: একদম না।

: যদি...

ধুরর ওসব চিন্তা করে কাজ নেই। মন জুড়ে এখন একটাই সান্ত্বনা, ছেলে বড় হয়ে গেছে! একা একা চলতে শিখে গেছে। যাক পৃথিবীতে যত তাড়াতাড়ি একা চলতে শেখা যায়, ততই মঙ্গল।
______________________________

ডা.ছাবিকুন নাহার। সুলেখক। মেডিকেল অফিসার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়