Ameen Qudir

Published:
2018-08-21 04:44:35 BdST

তিরিশ বছর আগেই আমাদের এই মফস্বল শহরে





দেবব্রত তরফদার
__________________________
তিরিশ বছর আগেই আমাদের এই মফস্বল শহরে অনেক জায়গায় বড় বড় বাগান ছিল , তার পাশের রাস্তা গুলো ছিল শুনশান সন্ধ্যা নামলেই পথ চলতেই ভয় । অধিকাংশ বাগানে ছিল অসামাজিক লোকের আড্ডা ,জুয়ার ঠেক । তারপর প্রমোটার বাহিনীর উদয় , শুরু হল বাগান নিধন । বর্তমানে আমার যেখানে বাস সেটি ছিল জমিদার চক্রবর্তীদের বাগান । পাশেই বড় একটি পুকুর। বাগানটি শেষ হয়েছে রেললাইন বরাবর । বাগানের জায়গাটি ছিল বেশ নিচু। ঘোর বর্ষায় পুকুরের সঙ্গে এক হয়ে বিশাল জলাশয়ের রূপ নিত । আশেপাশের লোকজনের প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে ছিল মাছ ধরার সরঞ্জাম । খ্যাপলা , শিটকে , বিত্তি দোয়াড়ি পলো এগুলোর অভাব ছিল না । এই দুই মাস ধরা মাছেই উদরপূর্তি আর রসনাতৃপ্তি। বর্ষার জল নেমে গেলে বিভিন্ন ঝোপঝাড় এর মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে ছিপ ফেলা জারি থাকতো । পুকুরটি নামমাত্র পয়সায় লিজ নিতো টুনু মালো। তার একটি বিশেষত্ব ছিল ।তার একটি বাক্যে তিনটি সাধারণ শব্দ থাকলে পাঁচটি খিস্তি থাকতো । এ ব্যাপারে তার চরম মুন্সিয়ানা ছিল । আমরা অনেকবার সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেও পারিনি। শেষ পর্যন্ত খিস্তিরাজ সম্মানে ভূষিত করেছিলাম। টুনুদা অবশ্য এই স্থানটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে । তার মতে তার দাদা ভিখু মালোর এই সন্মান পাওয়া উচিত। তা ভিখু মালোর ব্যক্তিত্ব ছিল এবং চেহারাটি দশাসই হওয়ায় আমরা তার সঙ্গে টক্কর দেবার সাহস দেখাইনি। তবে প্রতিবারই টুনু ক্ষতির হিসাব দেখালেও শীতের শেষে পুকুরে জাল টানলেও বড় বড় হাঁড়ি মাছে ভর্তি হয়ে যেত।
বাগান সাফ হবার পর পাড়ার ছেলেদের খেলার জায়গা গেল কমে। সাড়ে তিন কাঠা জমি দখল করে গড়ে উঠলো আমাদের রিভাইভ্যাল ক্লাব। শুরুতে আমি থাকতাম অন্য পাড়ায় । এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর এমন জড়িয়ে গেলাম যে এরা আমাকে আর ছাড়ল না ।তারপর বাড়ি টাড়ি কিনে এখানেই স্থিতু। এটা ছিল পঁচিশ বছর আগের কথা। টুনু মালোর পুকুরে ছুটির দিনে আমার বসা শুরু হলো। তখন পুকুর পাড়ে দু একটি ছিটে বেড়ার ঘর উঠেছে। কারো উপরে টিন কারো উপরে টালির চাল। উঠোনে তুলসী মঞ্চ এক কোনায় দুটি কলাগাছ। বেশ মনোরম পরিবেশ । এইসব বাড়িগুলো থেকে ছিপ ফেলার আদর্শ পরিবেশ। আমরা ভীমের বাড়ি থেকে ছিপ ফেলতাম। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একদিন বিবাদ হওয়ায় গেলাম পাশের ঘাটে। এর পাশেই দর্মার বেড়ার একটি বাড়ি । ছোট ছোট দুটি ঘর। ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল। পি ডব্লু ডি তে কাজ করেন ডি গ্রুপ স্টাফ । কথাতেই বুঝলাম গ্রামের লোক। আমাকে চেনেন বললেন । দু তিন বার বাড়ি থেকে খাবার জল এনে দিলেন। বাড়ির ভিতর থেকে একটি মহিলাকন্ঠ, তা সেখানেও গ্রামের টান আর শিশুদের গলার স্বর ভেসে আসছিল। সাধনদা মানে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হতো । তারপর আমারও চাপ বেড়ে যাওয়াই মাছ ফাছ ধরা বন্ধ ।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছু বছর । ২০০৪ সাল নাগাদ একটি ছেলে পড়তে আসলো। বি কম ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম । আঙুল দিয়ে দেখালো আমার বাড়ির উল্টো দিকের গলিতে । নিজের অবাক লাগলো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বাড়ি অথচ চিনিনা । প্রতিবছরই নতুন ছেলেমেয়েরা আসে তাদের মধ্যে দু এক জনের সঙ্গে অন্যরকম বন্ডিং তৈরি হয় । তা সাধনদার ছেলে শুভর সঙ্গে তৈরি হল সেরকম সম্পর্ক । তারপর তৈরি হল ওর পরিবারের সঙ্গে। আমার মেয়ে তিতির তখন খুব ছোট , শুভ হল তার অঙ্কন শিক্ষক । আর ছাত্রীর অত্যাচারে শিক্ষক তাল খুঁজে পায় না। শুভর সঙ্গে ভাব বেশি হল ওর ব্যাচের মৃন্ময় বান্টু আর এক বছরের সিনিয়রদের । তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সুবাদে। এরা ছিল প্রতীক অঞ্জন প্রশান্ত দীপঙ্কর। আবার তার আগের বছরের প্রজ্ঞা , মিলি , সুব্রত যারা আমার খুব কাছের ।এদের নিয়ে আমার একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল।চলল দিঘা, বর্ধমান ,হাজার দুয়ারী অভিযান। তাছাড়া ছিল আশেপাশের মেলা মঠ মন্দির মায়াপুর নদীর ধার। পরে চাকরি বাকরি পেলে শুভ প্রতীক এদের সঙ্গে হুইস্কি , রাম বা ভদকা অভিযানও হয়েছে। সময়ে এরা ছড়িয়ে গেছে কোলকাতা দিল্লী ব্যাঙ্গালোর নাইরোবি বা শিকাগোতে। বন্ডিংটা রয়ে গেছে তেমনই।
পাড়ার ছেলে শুভ ওর বাড়িতে যাতায়াত শুরু হলো। বাবা মায়ের সঙ্গে হলো পরিচয়। ততদিনে দর্মার বেড়া ভেঙে উঠেছে দুটি পাকা ঘর। গ্রামের মহিলা , লেখাপড়াও এগোয়নি বেশিদূর কিন্তু ব্যবহারে কুন্ঠাবোধ বা মালিন্য ছিল না। পরে এতটাই ঘনিষ্ঠতা হল যে শুধু বন্ধু আত্মীয়ের মধ্যে হয়। শুভর চাকরি , প্রথমে দিল্লী ও পরে ব্যাঙ্গালোর চলে যাওয়া।।এতেও ওর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অটুট। আমি পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কমই মিশতাম তাই আমার সম্পর্কে এরা উন্নাসিকই ভাবতো। পরিচয়ের সঙ্গে প্রৌঢ় স্বামী স্ত্রী ,তাদের বন্ধুর মত, ফেলে আসা কষ্টের দিনগুলোর গল্প করতে করতে আনমনা হয়ে যেত। এরপর প্রথমে মেয়ে অপর্ণা ও পরে শুভর বিয়েতে ওই পরিবারের আরো কাছে এসেছিলাম । অন্ধকারের দিনগুলো পিছনে রেখে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া । কিন্তু সবকিছুই যেন আগে থেকে ঠিক থাকে । বৌদির হল মারন রোগ। ক্যানসার হওয়ার সংবাদটি প্রথম দাদা শেয়ার করে আমার সঙ্গে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিরাট লড়াই। কেমোথেরাপি ,অপারেশন ,রে দেওয়া । বৌদি আমার জীবনের একটি অভিজ্ঞতা। তিল তিল করে প্রিয়জনের শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই সময়ের মধ্যে অনেক চেনাজানা লোক চলে গেছেন কিন্তু তাদের আগাম পরোয়ানা ছিল না। ডাক্তারের নিদানের সময়টিও শুভই প্রথমে আমাকে জানায়। এরপর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা , পুজো মানত। কতকিছুকেই আঁকড়ে ধরে মানুষ। আমার তো ভালোই লাগত , সুস্থই মনে হত। হাসিঠাট্টাও হত ।বাড়ি ফেরার সময় মন থাকতো ভারাক্রান্ত। পরে অবস্থা খারাপের দিকে। আমার স্ত্রী দেখা করতে যেতেন আমি বৌদির দিকে আর তাকাতে পারতাম না ।শেষ সময়ে কথা বন্ধ । চোখের ভাষা কি তা বুঝেছিলাম। অবাক লাগে মৃত্যুর কিছুক্ষন আগে স্পষ্ট গলার স্বর । " তোমরা কেউ আমায় নিয়ে যেতে পারবে না , আমার ছেলের সঙ্গে দেখা না করে যাবো না । " ভোরবেলায় শুভ এসে মুখে জল দিতেই সব শেষ। বিজ্ঞান মনস্ক মন দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি । উত্তর পাইনি।

গতবছর অষ্টমীপূজোর দিন পুজোমন্ডপে বৌদি লাল শাড়িতে সঙ্গে বিরাট পুজোর ডালা । আমি ঠাট্টা করে বলি -- এত বড় ডালা , ঘুষ নাকি। বৌদি বলেন -- আমায় তো ঘুষ দিতেই হবে । মা যদি আমার পরমায়ু বাড়িয়ে দেন।
হাসিটা কান্না হয়ে ঝরে পড়ে।
আবার একটা পুজো আসতে চললো। চারদিকে কাশ ফুল ফুটতে শুরু করেছে।

_________________________

দেবব্রত তরফদার। প্রথিতযশ লেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়