Ameen Qudir

Published:
2018-08-19 20:04:23 BdST

"ডাক্তার স্যার, ভালো আছেন?"


 

ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন


___________________________


কোরবানি ঈদের আর মাত্র দুইদিন বাকি।আজ আমার শেষ ডিউটি।ডিউটি শেষ করেই সোজা রেলস্টেশন।টিকিট আগেই করা আছে,শুধু যেয়ে বসে পড়ার অপেক্ষা।এতদিনেও এই শহর আমাকে তার প্রেমিক বানাতে পারলো না,বুঝলাম না ব্যর্থতাটা কার-আমার না এই যন্ত্রনগরীর।

বার বার চোখ না চাইতেও হাতঘড়ির দিকে চলে যাচ্ছে।এখন বাজে দুপুর ৩ টা,ডিউটি শেষ হবে রাত ৮ টায়।আরো ৫ ঘন্টা!শেষের দিকে সময় কেন যেন পার হতেই চায় না।আল্লাহ আল্লাহ করতেসি,যেন বেশি ঝামেলার কোন রোগী না আসে।এখন দেখা যাক,আল্লাহ কি রাখসেন কপালে।

সন্ধ্যা ৭ টা,ঝিমুচ্ছি,এমন সময় হট্টগোল।অবাক হয়ে দেখি একে একে চারজন রোগী ইমার্জেন্সী ঢুকছে।ব্যাপার কি?সবগুলো হয় পেট চেপে আছে,নয়তো মাথায় গামছা বেধে রেখে রক্ত পড়া বন্ধ করতে চাচ্ছে।এক্সিডেন্ট হলো নাকি?যেটাই হোক,উঠে পড়লাম চেয়ার থেকে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে।ঘড়ির দিকে তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলাম,কি হবে ঘড়ি দেখে?

হিস্টরি নিয়ে কিছুটা অবাক হলাম।এরা সবাই গিয়েছিলো হাটে গরু কিনতে,একসাথে।গরুর দামদর করছিলো।এমন সময় হঠাৎ কি হলো,কোত্থেকে এক ইয়া বড় ষাঁড়,ভোজবাজির মতো উদয় হয়ে এদের এসে গুতিয়ে গেলো।পুরো হাট ভর্তি লোক,কাউকে কিছু না করে শুধু এদেরকেই ইচ্ছে মতো নাকি গুতিয়েছে,লাথি মেরেছে।একে তো বিরাট আকৃতির ষাঁড়,তার উপর এর রুদ্ররূপ দেখে ভয়ে আর কেউ কাছে যাবার সাহস করেনি।ষাঁড়টা যেমন ভোজবাজির মতো এসেছিলো,তেমনি এদের গুতিয়ে লাথি মেরে উধাও হয়ে গেলো।কোথায় গেলো,কেউ খুজেও পেলো না।

যা ই হোক,রোগীগুলোর অবস্থা দেখলাম।ভালোই লাত্থি গুতা খেয়েছে।সবাইকে দেখে,প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে তারপর যখন ডিউটি হ্যান্ডওভার করে বেরিয়ে গেলাম,তখন ঘড়ির কাটা দশটার ঘর পেরুচ্ছে।দেরি হলেও ভালোই লাগছে,অন্তত বাড়ির জন্য রওনা তো হতে পারলাম শেষমেশ।
রিক্সা পাচ্ছিলাম না,তাই হেটেই রওনা দিলাম।সামনে পেলে উঠে যাবো-এই হচ্ছে পরিকল্পনা।পথে সেই গরুর হাট টা পরে,যেখানে আজ সেই পাগলা ষাঁড় এই লোকগুলোকে গুতিয়েছে।হাট পার হয়ে এগোচ্ছি,এমন সময় কেউ একজন ডাক দিলো,
"স্যার ভালো আছেন?"
নিশুতি রাতে যদি জনমানবশুন্য এলাকা থেকে কেউ নিজেকে আড়াল করে জানতে চায় আমি কেমন আছি,ভালো থাকার কি কথা?
তবুও,ভয় কে প্রশ্রয় দিলাম না।গড়া খাকড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
'কে?কে কথা বলে?'
"স্যার আমাকে চিনবেন না।আপনি আমার নাম শুনেছেন,কিন্তু কখনো দেখা হয়নি।"
'আরে ভাই সে তো বুঝলাম,কিন্তু কে আপনি?সামনে আসেন,তারপর কথা বলেন।আড়ালে লুকিয়ে থেকে কথা বলা এ কোন ধরনের অভদ্রতা?'
"স্যার,আমার আসতে সমস্যা নাই।কিন্তু আমি আপনার সামনে আসলে আপনার সমস্যা হতে পারে।তাই আসছি না।"
এই কথা শুনে আমার পেটের ভাত সব চাল হয়ে গেলো।কোন রকমে বললাম,
'ক কেন?তা হবে কেন?আপনি কে?ডাকাত?ছিনতাইকারী?'
"স্যার,আমি এগুলোর কিছুই না।ইনফ্যাক্ট,আমি মানুষই না।এইগুলো হাবিজাবি করা মানুষের কাজ,আমাদের না।"

আমার তো এই কথা শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়।
'তাইলে কে ভাই আপনি?এইভাবে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?আপনি কি ভুত?ভুত বলতে কিছু নাই,আমি জানি।এইসব বাদ দেন,আমি চললাম।'
"স্যার,আপনারা মানুষেরা বড়ই অধৈর্য।আমি হচ্ছি সেই ষাঁড়,আজ দুপুরে ওই চারটাকে আমিই গুতিয়েছি,লাথি মেরেছি।"
কি বলে এইসব!ষাঁড় কথা বলে?ফাইজলামী?বুঝলাম,কেউ আড়ালে থেকে আমার সাথে মজা করছে।এবার ভয়ডর সব চলে গেলো,সেই জায়গা দখল করলো রাগ।
'ওই ফাজিল,ফাইজলামী করেন?ষাঁড়?ষাঁড় মানুষের মতো কথা বলে?আপনি গাজা খাইতে পারেন,আমি খাই নাই।দেখেন,বাড়ি যাচ্ছি,মন মেজাজ ভালো আছে,খারাপ কইরেন না।যদি কিছু বলতে চান তো বলেন,নইলে আমার সময় নষ্ট কইরেন না।'
"ঠিক আছে স্যার,আপনার যখন বিশ্বাস হলো না কি আর করা।"

এই বলে টুনটুন শব্দ করে কেউ একজন আমার পেছনে এসে দাড়ালো।আমি ততক্ষণে ভয়ে জমে গেছি।কোন রকমে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম,আমার পেছনে একটা ইয়া বড় ষাঁড় এসে দাড়িয়েছে।হলায় আবার একটা ছোট্ট সুন্দর ঘন্টা বাধা,মাথা নাড়ার সাথে সুন্দর করে বাজছে টুনটুন টুনটুন।

ষাঁড় আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
"এইবার বিশ্বাস হলো স্যার?প্লিজ ভয় পাবেন না।আমি ওদের গুতিয়েছি বলে আপনাকে গুতাবো না।আমি এসেছি আপনাকে দুইটা কথা বলার জন্য।আপনার কি একটু সময় হবে?"

এই অত্যন্ত ভদ্র বিনয়ী ষাঁড়ের কথা শুনে আমি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।এখনো যে কি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি কিংবা কেন যে ভোঁ দৌড় দিচ্ছি না,সেটা নিজের কাছেও পরিষ্কার হচ্ছে না।সম্ভবত আমার নার্ভাস সিস্টেম অসাড় হয়ে গিয়েছে,তাই মস্তিষ্কের নির্দেশ পা'য়ে পৌছাচ্ছে না।

ষাঁড়টা আমার দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো কে জানে,মাথা খানিকটা নেড়ে বলতে শুরু করলো,
"স্যার,আমার ষাঁড় জন্মে তো আর আপনাদের মতো কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না,এখন ভুত হবার পর বলতে পারছি।
ওরা,যাদের গুতিয়েছি,গত ঈদের সময় আমার ছোট ভাইকে একসাথে কিনে নিয়ে যায়।কোরবানি করার উদ্দেশ্যে।সব ঠিক ছিলো,কিন্তু এরা সবগুলো কোরবানির পর আমার ভাইয়ের গায়ে উঠে রক্তাক্ত অবস্থায় সেলফি তুলে,সেটা আবার ফেসবুকে আপলোডও করে।চিন্তা করতে পারেন স্যার,এরা কত বড় অমানবিক?কুরবানির মতো মহৎ একটা উৎসব এদের কাছে স্রেফ একটা মজা,শুধুই পশুর মাংস খাওয়া আর আনন্দ ফুর্তি করা?এর ভেতরের তাৎপর্য এদের কারো মাথা কিংবা অন্তরের কোথাও নাই?
আমার যে মালিক ছিলো,তার ছোট ছেলে সেই ছবি নিয়ে আসে আমার কাছে,আমাকে দেখিয়ে সে কি কান্না তার।অনেক ভালবাসতো ছেলেটা আমাদের,খুব কষ্ট পেয়েছিলো তার আদরের গরুর সাথে এই আচরণে।
সেই রাতেই আমি দড়ি ছিড়ে বের হয়ে যাই।ওই চার বদমাশ তখন হিন্দি গানের সাথে নাচানাচি করছিলো।দেখে আমার মাথায় পুরো রক্ত উঠে গেলো,আমি ওই অবস্থায় ওদের গুতোতে গেলাম।কপাল খারাপ ছিলো স্যার আমার,কিভাবে যেন ওরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যায়,তারপর হাতের কাছে একটা লোহার রড পেয়ে এমনভাবে আমাকে পেটায়,ওখানেই আমি শেষ।এরপর আমাকে একটা ডোবায় ফেলে দিয়ে যে যার মতো শহরে চলে যায়,আর আমি ভুত হয়ে ওদের একসাথে পাবার জন্য এইখানেই অপেক্ষা করতে থাকি।আমি এতোদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম স্যার,আজ ওদের চারজনকে একসাথে পেয়ে আর সুযোগ নষ্ট করিনি।ইচ্ছে মতো গুতিয়েছি,সেদিনের শোধ তুলেছি।স্যার ওদের অবস্থা কি এখন একটু বলবেন?শুনে মনে শান্তি লাগতো আমার।"

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে ষাঁড়টা।ওর সব কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।জিজ্ঞেস করলাম,
'তোমার নাম কি?'
ধরা গলায় ষাঁড়টা বললো,
"আর নাম স্যার।আমার নাম ছিলো লালু,ভাইয়ের নাম ভুলু।একসময় মালিকের ছোট ছেলে আমাদের দুই ভাইকে কতো আদর করে ডেকে ডেকে খাবার খাওয়াতো,গোসল করিয়ে দিতো।বাদ দেন স্যার,ওদের কথা বলেন।কি অবস্থা?"

কষ্ট লাগছিলো ষাঁড়টার জন্য।বললাম,
'ভালোই আহত হয়েছে।তবে জীবনের আশঙ্কা নেই।'
"খুশি হলাম স্যার।হাজার হলেও মানুষ তো নই যে একেবারে মরে গেলেও কোন খারাপ লাগা কাজ করবে না।
যা ই হোক স্যার,আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম।আপনার ট্রেন ছেড়ে গেছে অলরেডি।এখন কিভাবে যাবেন বাড়ি?"
আরে তাই তো!গল্প শুনতে শুনতে একেবারে ভুলেই গেছি বাড়ি যাবার কথা।সত্যিই তো,এখন আমি বাড়ি যাবো কেমন করে?কিন্তু এইসব এই ষাঁড় কে বলে কি লাভ?
একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম,
'জানি না।দেখি,যাই আগে স্টেশনে।দেখি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কি না।'
ষাঁড়টা একটু নিচু গলায় বললো,
"স্যার,যদি আপনার আপত্তি না থাকে,আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দিতে পারি।ট্রেনে গেলে তো কাল দুপুরের আগে পৌছুতে পারতেন না,আমি আপনাকে এক মুহূর্তে পৌছে দেবো।যাবেন?"
এইবার আমার মুখ হা হয়ে গেলো।বলে কি?
'কি করে?'
"স্যার শুধু আমার পিঠে উঠে আমার গলাটা একটু শক্ত করে ধরে থাকবেন,পারবেন না?বাকি দায়িত্ব আমার।"

পরিশিষ্টঃ
সেই রাতে আমি বাড়িতে পৌছে গেলাম ঠিক রাত বারটায়।গ্রামে তখন অনেক রাত,আমার আগমনে তখন বাড়িতে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়েছে।এতোদিন পর তাদের খোকা বাড়িতে এসেছে,সে কি কম আনন্দের কথা?

ষাঁড়টা আমাকে বাড়ির উঠানে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নেবার সময় আমি একটা অদ্ভুত আবদার করে বসি।
'তোমার সাথে একটা সেল্ফি তুললে কি তুমি আমাকে গুতানোর জন্য কাল থেকে খুঁজতে শুরু করবে?'
ষাঁড়টা হা হা করে হেসে ওঠে।কিছু না বলে মুখ বাড়িয়ে দেয়।আমি আর দেরি না করে সেল্ফি তুলি।তুলে কিছু বলতে যাবো,দেখি ষাঁড়টা নাই।একেবারে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে,যেমন সেদিন লোকগুলোকে গুতিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলো।

এখনো আমি মাঝে সেই সেল্ফিটা দেখি।সেখানে ষাঁড়টাকে দেখা যায় না,শুধু আমার ছবিটাই উঠে আছে।অথচ আমার পরিষ্কার মনে আছে,ছবি তোলার সময় স্পষ্ট ষাঁড়টার ছবি উঠেছে।আমি মাঝে মাঝে দ্বিধান্বিত হয়ে যাই,আসলেও কি সেদিন এমন কিছু ঘটেছিলো?নাকি পুরোটাই কল্পনা আমার?তাহলে আমি সেই রাতে বাড়ি ফিরলাম কেমন করে?

আমার হিসেব মিলে না।আমি মেলাতেও যাই না।থাকুক না হয় কিছু অমীমাংসিত হিসাব।।
________________________________

 

ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
০২ ব্যাচ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়