Ameen Qudir
Published:2018-08-19 18:35:31 BdST
অমর বঙ্গবন্ধুর সাজে অনবদ্য ভূমিকায় ডাক্তারের সন্তান
ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
___________________________
আহনাফ তাজওয়ার আরিয়ান।
আমার একমাত্র সন্তান।
এখন ওর বয়স সাড়ে চার বছরের কিছু বেশী।
যখন ওর বয়স আড়াই তিন বছর,
দুএকটা শব্দ উচ্চারন করতে শিখেছে কেবল তখনও ওর মুখে উচ্চারিত সীমীত অপরাপর কয়েকটি শব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শব্দগুলো হলো 'জয় বঙ্গবন্ধু', 'বাংলাদেশ', 'মুক্তিযুদ্ধ' এবং 'জয় বাংলা'।
'বঙ্গবন্ধু' শব্দটির উচ্চারন বাচ্চাদের জন্য বেশ কঠিন হওয়ায় শব্দটি ও তখনো সঠিকভাবে উচ্চারন করতে পারতো না ঠিকই তবে ওর সেই ভাঙা ভাঙা উচ্চারনের মাঝেও ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা, অতল আন্তরিকতা আর অপার শ্রদ্ধা-ভক্তি।
এখন অবশ্য তেমনি আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়ে 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি সঠিকভাবে উচ্চারন করতে শিখেছে আরিয়ান।
ছেলেটি আমার যখনই কোন সমবয়সী খেলার সাথী পায় তখনই 'মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ' খেলা শুরু করতে চায়! সেই সাথী যদি এই 'মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ' খেলায় আগ্রহী না হয় তবে ও খুব হতাশ হয়ে পড়ে।
আমরা বাসায় যদি কখনো কোন হিন্দি গানের সুর ভাজতে চাই তাতে ওর ঘোর আপত্তি,
"বাবা বাংলা গান গাও,
বাবা মুক্তিযুদ্ধের গান গাও,
বাবা বঙ্গবন্ধুর গান গাও।"
এইতো দু'দিন আগের কথা।
আরিয়ানের মা ফেসবুকে অনলাইন শপিঙের একটি লাইভ ভিডিও দেখছে।
ভিডিওতে ভারতীয় ও পাকিস্তানী বিভিন্ন ড্রেসের প্রোমো দেখাচ্ছে, বর্ণনা দিচ্ছে।
আরিয়ান যখন 'পাকিস্তানী' শব্দটি শুনলো তার কান খাঁড়া হয়ে গেলো, সাথে সাথে মা'র কাছে ছুটে গিয়ে বললো,
"মা পাকিস্তান পঁচা, পাকিস্তান দুষ্টু, তুমি পাকিস্তানের জামা কিনবা না।"
(এর আগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে গিয়ে আমরা পাকিস্তানকে ওর সামনে দুষ্টু আর পঁচা হিসেবেই চিত্রিত করেছি। বাবা-মা হিসেবে আমরা গর্বিত যে আমরা আমাদের সন্তানকে এ্যান্টিপাকিস্তান ভ্যাক্সিন দিতে পেরেছি, ওর মনে পাকিস্তানের প্রতি গভীর ঘৃণা প্রোথিত করতে পেরেছি।)
ধরুন, সে খেলা করছে একা বা কারো সাথে।
তখন যদি টিভিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বা মুক্তিযুদ্ধের কোন গানের সুর বেজে ওঠে সাথে সাথেই খেলা বন্ধ করে সে তার সমস্ত মনোযোগ টিভির দিকে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে!
এমন কি টিভির খবর কিংবা টকশোর মাঝেও যদি বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলো উচ্চারিত হয় তখনও সে একই কাজ করে!
পত্রিকায় বা কোন পোস্টারে যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে তখন গভীর আগ্রহ আর ভক্তি নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ছবির দিকে- "বাবা দেখো দেখো বঙ্গবন্ধু।"
প্রায় বছর খানেক আগের কথা।
আরিয়ানের মা তাকে বলেছে যে বাবা অফিস থেকে ফিরলে তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে।
আরিয়ানের খুশি আর ধরে না।
আরিয়ান হয়তো ভেবেছিলো-
বঙ্গবন্ধু তার সাথে কথা বলবে!
তাকে আদর করবে!
তাকে কোলে তুলে নেবে!
তাই বুঝি আরিয়ানের চোখে মুখে শুধুই আনন্দ আলোকের ঝিলিক!
আরিয়ান তখনো জানে না বঙ্গবন্ধু আর নেই।
আরিয়ান তখনো বুঝে না শারিরীক বঙ্গবন্ধু কখনোই তার সাথে দেখা করতে পারবে না!
তার সাথে কথা বলতে পারবে না!
বঙ্গবন্ধু__________________
আমরা ৩২ নম্বরে গেলাম।
পুরোনো মূল ভবনের পিছনে যে আর্কাইভ ভবনটি নতুন তৈরি হয়েছে আগে সেখানে গেলাম।
শুরু থেকেই আরিয়ানের চোখেমুখে অন্যরকম এক আনন্দ খেলা করছে- আজ বঙ্গবন্ধুর সাথে তার দেখা হবে!
আর্কাইভগুলো উপরতলা থেকে দেখতে দেখতে নিচে নামতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিফ্লোরে সজ্জিত আর্কাইভগুলো দেখতে দেখতে আমরা নিচে নামছিলাম।
যতটুকু সম্ভব ছবির নেপথ্যের ইতিহাসগুলো শিশুতোষভাবে মাত্র দু'একটি ছোট ছোট বাক্য দিয়ে ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
কিছু কিছু হয়তো তার মাথায় ঢুকছিলো অধিকাংশই হয়তো মাথায় ঢুকছিলো না।
বঙ্গবন্ধুকে দেখার অধির আগ্রহ যেন তার আর শেষ হতে চায় না। তার ধর্য্য যেন আর বাঁধ মানতে চায় না!
বারবার তার প্রশ্ন,
"বাবা বন্দুবন্দু কই, আমি বন্দুবন্দু যাবো।"
"মা আমাকে বন্দুবন্দু নিয়ে যাও।"
তখনও আরিয়ান 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ভালোভাবে উচ্চারন করতে শিখিনি।
আর্কাইভগুলো দেখতে দেখতে আমরা যখন ১৫ আগস্টের কাছে চলে এলাম তখন থমকে গেলাম আমি আর আরিয়ানের মা।
আমাদেরকে থমকে দিয়ে আরো বেশী থমকে গেল আরিয়ান!
আগস্টের শোকাবহ ইতিহাসটা আমাদের জানা।
আরিয়ান তখনো জানেনা।
আরিয়ানকে যখন জানানো হলো কিছু দুষ্টু লোক বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে মেরে ফেলেছিলো ছেলেটা আমার হঠাৎ করে নিভে গেলো!
কোন অন্ধকার ঘরে জ্বলতে থাকা একমাত্র মোমটিও যখন নিভিয়ে দেওয়া হয় তখন যেমন করে নিকষ অন্ধকারে ঘরটি ডুবে যায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার অধীর আগ্রহ আর অপার আনন্দে জ্বলতে থাকা আরিয়ানের মুখটিও ঠিক তেমনি হঠাৎ করে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো!
চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো!
ও আর এখানে থাকবে না, আর কিছু দেখবে না।
আমরা একেবারে নিচে নেমে আসলাম।
কিছুক্ষণ ওকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলাম।
বঙ্গবন্ধুর কবুতরের ঘর দেখালাম, সেখানে কিছু কবুতরও ছিলো।
আরিয়ান আগ্রহ নিয়ে দেখলো।
এরপর আমরা পুরাতন মূল ভবনে গেলাম।
ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম, আরিয়ানকে দেখালাম।
ও ব্যাথাতুর মন নিয়ে সব দেখলো-
দেওয়ালে, জানালার কাচে গুলির চিহ্নগুলো দেখলো,
বঙ্গবন্ধুর জামা পাঞ্জাবি পাদুকা লুঙ্গি পাইপ সবই দেখলো,
থরে থরে দেওয়ালে সাটানো নিহতের ছবিগুলো দেখলো,
রাসেলের ছবি দেখে স্বপ্রতিভ প্রশ্ন, "এই বাবুটা কই ?"
তাকের উপর রক্ষিত একটা কদুর তেলের শিশিও ওর নজর এড়াতে পারিনি-
"বাবা এই তেল কে মাখতো, বন্দুবন্দু ?"
সবশেষে আমরা সেই সিড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম যে সিড়ির উপর শোকাবহ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বাংলাদেশের মানচিত্রটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো।
আরিয়ান আরো একবার মুষড়ে উঠলো!
এখানেও দেওয়ালে দেওয়ালে কাচের আবরনে মমি করা গুলির চিহ্ন!
সিড়ির উপর গোলাপের পাপড়ি ছিটানো,
এক কোনে কাচের ফুলদানিতে গোলাপগুচ্ছ,
পাশের দেওয়ালে বঙ্গবন্ধুর সেই হৃদয়বিদারক পোট্রেটটি ঝুলানো।
আরিয়ান অনেকক্ষণ পোট্রেটটির দিকে চেয়ে রইলো।
আরিয়ান ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে,
আরিয়ান ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছে ওর আকাঙ্খা কখনোই আর পুরোন হবার নয়!
বঙ্গবন্ধু কখনোই আরিয়ানকে আদর করতে আসবে না!
বঙ্গবন্ধু কখনোই আরিয়ানকে কোলে তুলে নিতে আসবে না!
বঙ্গবন্ধু কখনোই আরিয়ানের সাথে খেলতে আসবে না!
আরিয়ান জেনে গেছে দুষ্টু লোকেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার মতো লাখো কোটি অবুঝ শিশুর আকাঙ্খাটা পাখা মেলার আগেই গলাটিপে মেরে ফেলেছে!
আমরা তিনজনই মনমরা কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
এই কষ্টের মাঝেও একধরনের ভালো লাগা গর্বের অনুভূতিতে আমার বুকটা ভরে উঠলো।
কতোই বা বয়স আরিয়ানের ?
তখন মাত্র সাড়ে তিন।
এই বয়সেই-
আমি আমার সন্তানকে তার জাতির জনককে চেনাতে পেরেছি!
এই বয়সেই-
আমি আমার সন্তানকে তার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে চেনাতে পেরেছি!
এই বয়সেই-
আমি আমার সন্তানকে তার জাতির আজন্ম শত্রুদেরকে চেনাতে পেরেছি!
এই বয়সেই-
আমি আমার সন্তানকে তার জাতির ইতিহাসে হাতেখড়ি দিতে পেরেছি!
এই বয়সেই-
আমি আমার সন্তানকে তার জাতির ইতিহাসের স্রষ্টাদের চেনাতে পেরেছি!
না! আলাদা করে লাঠি ধরে ওকে কিছু শেখানো লাগেনি।
আমার বাড়ির পরিবেশ, আমাদের(ওর মা আর আমি) গল্প আলোচনা থেকেই ও শিক্ষা নিয়েছে ঠিক যেমন করে আমি শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার মা-বাবা-চাচা আর দাদা দাদির কাছ থেকে।
বাচ্চারা খুবই অনুকরনপ্রিয়।
আমি যেমন আমার পরিবার থেকে অনুকরনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনেছিলাম, শিখেছিলাম ঠিক তেমন করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং আমার পাঠ্যবই থেকেও শিখেছিলাম।
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে।
১৯৮৫ সালে আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি।
তৃতীয় শ্রেণীর একটা পাঠ্যবই ছিলো 'পরিবেশ পরিচিতি'। আমরা সবাই বলতাম 'সমাজ বই'।
সেই সমাজ বইয়ে বঙ্গবন্ধু, প্রেসিডেন্ট জিয়া ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ছবি দিয়ে তিনজন সম্পর্কেই নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া ছিলো।
আমি কিন্তু আমার মনের গভীরে বঙ্গবন্ধুর ছবিটিই গেঁথে নিয়েছিলাম।
আজও সেই ছবিটি আমার চোখে সূর্যের মতো জ্বল জ্বল করে ভাসে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধই আমাকে সেই শৈশবেও আমার আদর্শের নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বেছে নিতে মূল ভূমিকা রেখেছিলো, আমাকে আরো বেশী উদ্দীপ্ত করেছিলো।
আমিও আমার সন্তানকে তার জন্মভূমির স্রষ্টাকে চিনিয়ে গেলাম, তার জাতির ইতিহাসের স্রষ্টাদের চিনিয়ে গেলাম।
বাকি কাজটুকু রাষ্ট্রের।
রাষ্ট্র যেন তার এই কাঁচা চেতনাকে আরো শাণিত করার দায়িত্ব নেয়।
রাষ্ট্র যেন আমার সন্তানের প্রজন্ম এবং অনাগত সকল প্রজন্মের চেতনাকে শাণিত করার দায়িত্ব গুরুত্বের সাথেই কাঁধে তুলে নেয়।
________
ছবিটি ২০১৭'র ১৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আরিয়ানের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে 'যেমন খুশি তেমন সাজো' চ্যাপ্টারের।
এই সাজের পরিকল্পনা ও পরিচ্ছেদ সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।
এই সাজের পুরো ক্রেডিট আরিয়ানের মা'র(নীল নুরাইয়া)।
______________________________
শিশুটির বাবা মায়ের ছবি । নীল নুরাইয়া.ও ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
_____________________________
লেখক ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ;স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক;চিকিৎসক পরিষদ, বিএসএমএমইউ।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ শাখা ,দিনাজপুর।
আপনার মতামত দিন: