Ameen Qudir

Published:
2018-08-14 16:16:56 BdST

থাপ্পড়: তরুণ ডাক্তার কথাশিল্পীর লেখা গল্প




প্রীতম মন্ডল
________________________________

"মা প্লিজ পড়তে যাবো না আজ।" বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে কথা গুলো বলল অদৃজা।
" কেনো রে ? শরীর খারাপ নাকি? জ্বর টর এলো নাকি আবার? কতো বার বলেছি স্কুল যাওয়ার সময় ছাতাটা মনে করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিবি! কি যে করিস না তুই! ভাল্লাগে না আমার!" মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে জ্বর আছে নাকি একবার দেখলেন সুমিত্রাদেবী।
একে টানাটানির সংসার। দিন আনি দিন খেয়ে সঞ্চয়ের ভান্ডার প্রায় শুন্য। পাড়ার মোড়ে জামা কাপড় সেলাই করার দোকানে যদিও বা একটা কাজ জুটেছে, যে মাইনে মাস শেষে আসে তাতে মা বেটির খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে অধিকাংশ সময় হাতে কিছু থাকে না। অনেক কষ্টে মেয়ের জন্য একটা সেভিংস একাউন্ট খুলে তাতে সাধ্যমত টাকা জমিয়ে আসছেন এক বছর ধরে। আর কিছু হোক আর না হোক, মেয়েটার যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সুমিত্রাদেবী। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যা বাড়ছে তাতে খাওয়ার খরচ বাদ দিলে জমতে থাকা টাকার পরিমাণও কমছে। সখ আহ্লাদ তো বাদই দিলাম।
আগে লোকের বাড়িতে কাজ করতেন সুমিত্রাদেবী। মাস ফুরোলে ভালো টাকা মাইনেও পেতেন। মেয়ের সেভিংস, মাসে দু বার মাংস, আর অসুস্থ শাশুড়ির ওষুধের পরেও বেশ কিছু টাকা সহজেই হাতে থেকে যেতো। স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব থাকলেও সুখ ছিল অনেক। কিন্তু যে আকাশে রামধনু ওঠে সে আকাশে বৃষ্টিও হয়, আর সে বৃষ্টি সমস্ত সুখের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে বিসর্জন দেয় অতল সাগরে। বাড়ির মালিক যখন টাকা দিয়ে শ্রমের সাথে সাথে ওনার শরীরটাকেও কিনতে চাইলো তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না সুমিত্রাদেবী। মাস গেলে মোটা টাকার আতঙ্কের চেয়ে কম টাকার সম্মান অনেক ভালো। তাই লোকের বাড়ির কাজ ছেড়ে সেলাইয়ের দোকানে কম টাকার চাকরিতে যোগ দেওয়া।
" না না, আমার কিছু হয়নি মা। শরীর ঠিকই আছে।" মায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো অদৃজা।
" কিছু হয়নি তো পড়তে যাবি না কেন টিউশনি?" জিজ্ঞেস করলেন সুমিত্রদেবী।
" এমনি যাবো না। ভালো লাগছে না আজকে যেতে।" হালকা গলায় উত্তর দিলো অদৃজা।
" কি জানি বাবু! তোর যে কি হয় মাঝে মাঝে বুঝিনা। কাল ও গেলি না, আগের সপ্তাহেও দু দিন গেলি মাত্র, এরকম করলে কিকরে পড়াশোনা করবি কি জানি!" আলনায় জামা কাপড় গোছাতে গোছাতে কথা গুলো বললেন সুমিত্রাদেবী। দেওয়ালের দিকে চোখ পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস গলা দিয়ে নামলো। অদৃজার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো মেয়েটাকে আর একটু ভালো করে মানুষ করতে পারতেন উনি।
এই সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, " কে?"
"বৌমা বাড়ি আছো নাকি?" একজন বৃদ্ধের গলা।
সুমিত্রাদেবী বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন বাড়িওয়ালা নিত্যানন্দবাবু এসেছেন। ভদ্রলোক মানুষ হিসেবে ভালোই। সুমিত্রাদেবীকে স্নেহের চোখেই দেখেন। অদৃজাকেও ভালোবাসেন যথেষ্ট। সুমিত্রাদেবী বললেন," ও কাকাবাবু আপনি! আসুন না ভেতরে আসুন।"
" না না আর ভেতরে যাবো না। বলছিলাম যে দু মাসের ভাড়া তো বাকি আছে, তা ওটা যদি পেতাম....."
"আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এই মাসের শেষেই সব টাকা মিটিয়ে দেবো।" নিত্যানন্দ বাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন সুমিত্রদেবী।
" আসলে বুঝতেই তো পারছো, বুড়ো মানুষ, অসুখ বিসুখ জড়িয়ে আছে গায়ে। ওষুধ কিনতেই সব টাকা চলে যায়। এই ভাড়ার উপরেই বেঁচে আছি একরকম।" নিত্যানন্দ বাবু বললেন।
" আসলে কাকাবাবু, মেয়ে এবারে মাধ্যমিক দেবে। ওর অঙ্ক টা একটু অসুবিধা হচ্ছে বলে দু মাস হলো একটা টিউশনি দিয়েছি। ওর স্কুলের কাছেই একজন স্যার পড়ান সপ্তাহে দুদিন। সুজিত বাবু।তো ওখানেই বেশ কিছু টাকা চলে যাচ্ছে।"
" আমি সব বুঝি বৌমা! কিন্তু কি করবো বলো, আমারও তো টাকা লাগে।"
" আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান কাকাবাবু, আমি এই মাসের শেষেই সব টাকা মিটিয়ে দেবো।"
" আচ্ছা বেশ! চলি তাহলে আমি"
" আসুন, সাবধানে যাবেন।"
নিত্যানন্দ বাবু চলে যাওয়ার পর ঘরে এসে খাটের এক কোনায় বসলেন সুমিত্রা দেবী। কি করে টাকা জোগাড় হবে উনি জানেন না। অদৃজার নতুন টিউশনিতে প্রত্যেক মাসে হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। সে যাক, মেয়ের পড়াশোনার সাথে আপোষ করতে নারাজ তিনি। বাড়ি ভাড়াটাও কম না। এক কামরার ছোট ঘরে এদিক থেকে ওদিক ফিরলেই দুনিয়া শেষ। আগে যেখানে থাকতেন সেই বাড়িটা অদৃজার স্কুল থেকে দূরে। ভাড়াও কম ছিল। রাত বিরেতে টিউশনি থেকে মেয়েটা একা বাড়ি ফেরে, সব সময় একটা ভয় কাজ করত বুকের মধ্যে। অগত্যা বাধ্য হয়ে স্কুলের কাছে বেশি ভাড়ার বাড়ি নিতে হয় সুমিত্রাদেবীকে। নিত্যানন্দ বাবু নেহাত ভালো মানুষ তাই দু মাসের ভাড়া না পেয়েও গলা চড়িয়ে কথা বলেন না। কিন্তু এভাবে থাকার মধ্যে একটা অপমান আছে, সেটা নিজের আত্মসম্মানকে বার বার আঘাত করে। বিনে পয়সায় কারুর করুনার পাত্র হয়ে থাকালে মাথা নিচু হয়ে যায়। যেটা সুমিত্রাদেবীর বিধবা শাড়িতে লাগলে মৃত স্বামীরও অপমান হয়।
পরের দিন কাজ থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল সুমিত্রাদেবীর। পুজো আসছে, জামা কাপড় সেলাইয়ের কাজের চাপ বেশি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাড়ির গলিতে ঢুকতেই, কয়েকজন মাঝ বয়সী ছেলে ওনার পথ আটকালো। এদের সবাইকেই উনি চেনেন। লোকাল ক্লাবের মেম্বার আর লোকাল নেতার পা চাটা ভৃত্য। এদের কুকর্মের খবর গোটা পাড়ায় আর কারো জানতে বাকি নেই। যতটা সম্ভব সুমিত্রদেবী এদের এড়িয়েই চলেন।
" কি চাই কি?" জিজ্ঞেস করলেন সুমিত্রা দেবী।
" পুজো আসছে তো বৌদি, চাঁদাটা দিতে হবে তো নাকি!" ওদের মধ্যে থেকে একজন বললো।
" কত টাকা চাঁদা?" জিজ্ঞেস করলেন সুমিত্রদেবী।
" বেশি না, গত বারে যা ছিল এবারেও আমরা সেটাই রেখেছি। মাত্র এক হাজার।"
শুনেই বুকটা কেঁপে উঠলো সুমিত্রাদেবীর। এমনিতে মাথার উপর এতো ঋণের বোঝা তারউপর এতো টাকা চাঁদা দিলে মুশকিল। উনি বললেন," এতো টাকা চাঁদা?"
" কোথায় এতো টাকা! এবারের থিম নারী নির্যাতন। একটু খরচা তো হবেই বৌদি। মেয়েদের সম্মান বলে কথা।!" সবাই হেঁসে উঠলো ওরা।
" আমি অতো দিতে পারবো না।" বুকে সাহস নিয়ে বললেন সুমিত্রা দেবী।
সামনের যে ছেলেটা হাসছিল সে মুখ ফিরিয়ে সুমিত্রাদেবীর দিকে তাকিয়ে আসতে আসতে বলল, " বৌদি, মেয়েটা বড় হচ্ছে। রাত্রে একা যাতায়াত করে। একবার ভাবুন তো ওর যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায় আপনার কি হবে!! এবারের ফাংশনে ওর নাচ কিন্তু চাই ই চাই আমাদের।"
আঁতকে উঠলেন সুমিত্রাদেবী। গলা শুকিয়ে আসছে, কাঁপছেও একটু। রাগে সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণার বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজেকে সামলে বললেন, " আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দিয়ে দেবো!" বলেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। প্রচন্ড রাগে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই অপমান আর কতদিন সহ্য করবেন উনি! মেয়ের মুখ চেয়ে আর নিজেকে কত ছোট করবেন! এর কোনো সদুত্তর নেই ওনার কাছে।
বাড়ি ঢুকে দেখলেন অদৃজা আজও শুয়ে আছে। ঘরের লাইট নেভানো, পাখা চলছে। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে রাগ আরো বেড়ে গেলো সুমিত্রা দেবীর। একপ্রকার চিৎকার করেই বললেন, " তুই আজও যাসনি পড়তে?"
" না, ভালো লাগছে না।" বিছানায় উঠে বসে বলল অদৃজা।
" ভালো লাগছে না মানে ? কি পেয়েছিস টা কি তুই?" বলে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে মেয়ের গালে একটা চড় মারলেন সুমিত্রাদেবী তারপর গলা আরো চড়িয়ে বললেন," আমি এখানে সারাদিন খেটে খেটে পয়সা রোজগার করবো, সেটা কি তোর বাড়িতে ঘুমানোর জন্য?? আমার খাটনির কোনো দাম নেই না!! পড়বি না তো বলে দে। শুধু শুধু টাকা গুলো নষ্ট হয় না আমার।"
মায়ের কথা শুনে অদৃজা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মা কে খুব কম সময়ই এরকম রাগতে দেখেছে ও। কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলো সে।
" কিরে? চুপ করে আছিস কেন এখন? অন্য সময় তো মুখে খুব কথা ফোটে। এখন বেরোচ্ছে না কেন?" জিজ্ঞেস করলেন সুমিত্রাদেবী।
অদৃজা কোনো কথা না বলে এক হাতে গলা থেকে ওড়নাটা সরালো। তারপর বুকের কাছে সালোয়ারটা নামিয়ে ধরলো একটু। একটা কালো কালশিটে দাগ ফর্সা চামড়ায় আগুনের মত মনে হচ্ছে। গলার কাছেও কিছু দাগ অস্পষ্ট। সুমিত্রা দেবী জিজ্ঞেস করলেন, " এগুলো কিসের দাগ?"
অদৃজা কাঁপতে কাঁপতে বলল," মা আমি তোমাকে এতদিন বলিনি কিছু। সুজিত বাবু ভালো পড়ান ঠিকই কিন্তু মানুষ ভালো না। আমার গায়ে পড়ানোর অছিলায় যেখানে সেখানে হাত দেয়। আমি প্রথমে বুঝতাম না, কিন্তু পরে আর সহ্য করতে পারিনি মা আমি।" ঝর ঝর করে বন্যার মত দু চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে অদৃজার। সে বলে চলল," সেদিন সবাই চলে যাওয়ার পর আমাকে দাঁড়াতে বলেছিল। তারপর আমাকে জোর করে.......। উনি বলেছেন এসব বাড়িতে বললে আমাকে আর পড়াবেন না।" নিঃশ্বাস আটকে আসছে অদৃজার। সেই সাথে সুমিত্রাদেবীরও। অদৃজার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন সুমিত্রাদেবী। দুজনের শরীর কাঁপছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হল সুমিত্রাদেবীর। স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক সময় এক বেলা খেয়ে মেয়েটাকে মানুষ করেছেন। মেয়ে বুকে থাকলে মায়ের খিদে মরে যায়। সেই মেয়ের শরীরের দাম ওই হাজার টাকার থেকে অনেক বেশি।
এরপর থেকে মেয়েকে আর পড়তে যাওয়ার জন্য জোর করেননি সুমিত্রাদেবী। কিছুদিন পর কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় লোকজন কম, নেই বললেই চলে। গলির মোড়ে অন্ধকার জমে আছে ঘন। এখন কেমন একটা সতর্কতা চলে এসেছে নিজের মধ্যে। একটা রাগ সবসময় লেগে থাকে চোখে। মেয়ের শরীরে দাগ মানে ওনার শরীরেও দাগ। এসব ভাবলে হাঁটু কেঁপে যায়, গা জ্বলে ওঠে। হঠাৎ পেছন থেকে একজন ডাকল, " সুমিত্রাদেবী?"
সুমিত্রদেবী পেছন ফিরে দেখলেন অদৃজার অঙ্কের স্যার সুজিতবাবু। ওনাকে দেখেই সারা গায়ে একটা তীব্র ক্ষোভ সতেজ হয়ে উঠলো সুমিত্রাদেবীর। চোয়াল শক্ত করে বললেন, " আপনি...!"
" বলছিলাম, অদৃজা বেশ কয়েকদিন হলো পড়তে যাচ্ছে না। কি ব্যাপার বলুন তো? শরীর খারাপ নাকি?" জিজ্ঞেস করলেন সুজিত বাবু।
সুমিত্রা দেবী কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ থাকলেন। তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে ডান হাতে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন সুজিত বাবুর গালে। তারপর সুজিত বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন," আপনি মানুষ, অশিক্ষিত জানোয়ারের মত আচরন করবেন না আর।"
থাপ্পড় মারার শব্দটা জোরেই ছিল। সেটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সুমিত্রাদেবী বাড়ির পথে এগিয়ে গেলেন। বাড়িতে অদৃজা অপেক্ষা করছে ওনার জন্য। পুজো সত্যিই আসছে।
______________________________

প্রীতম মন্ডল। ইনটার্ন চিকিৎসক। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়