Ameen Qudir

Published:
2018-08-14 15:54:10 BdST

ডাক্তার কথাসাহিত্যিকের লেখা গল্পছকুর মৃত্যু: ডাক্তার কথাসাহিত্যিকের লেখা গল্প


 



অধ্যাপক ডা.অনির্বাণ বিশ্বাস
__________________________________

 

এই ছোট্ট গঞ্জের কোলঘেঁষে প্রায় কোয়ার্টার মাইলব্যাপী শুধু বাঁশ আর বাঁশ। বাঁশঝাড়ের ঘনত্বের কারণে সূর্য ডোবার আগেভাগে এদিকে অন্ধকার নেমে আসে। আর এখন তো বেশ রাত।

ছকু তাড়াতাড়ি সর্টকাটে বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।মাছের আড়তে।ও মাছের ব্যবসা করে।ইলিশ উঠতে শুরু করেছে। এসব নানা ভাবনায় আনমনা হওয়ার কারণেই হয়তো ছকুর পা হড়কে গেল। বর্ষার জলে বাঁশঝাড়ের তলে ছপছপ করছে। একটা গর্তে ছকুর পা পরল। ফোঁস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সেটা বেরিয়ে এসে ছকুর পায়ে ছোবল দিল...হারামি শালা। কিন্তু পায়ে না লেগে ছোবল লাগল চটির মাথায়। ছকু সবেগে পা ঝাড়া দিয়ে সাপকে ছুড়ে ফেলে। জাত কেউটে। পালিয়ে না গিয়ে ঘুরে প্রচন্ড বেগে আরেক ছোবল। এবার সরাসরি ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে। তীব্র ভয়ে ছকুর চিৎকার.. 'মাগো' । সাপটি হয়তো আঘাত করতে তৃতীয়বার ফণা তুলেছিল বা পালিয়েই যেত। কিন্তু ছকু টর্চের আলোয় চিকচিকে ফণা দেখে ফেলল। সে উন্মাদের মত বাঁ পা দিয়ে উদ্যত ফণা সবেগে কুচলে দিল। সাপটি লম্বালম্বি হয়ে মোচড় খেতে থাকল।

বাড়ি পর্যন্ত হয়তো সে ফিরে যেতে পারত।পারত কি ? তার আগেই ছকুর চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। সে বুঝলো বিষ গোড়ালি ছেড়ে ওপরের দিকে রওনা দিয়েছে। বাঁচার আর কোনো আশা নেই। সুতরাং মালতীর পাশে রাতে যেভাবে সে ঘুমিয়ে থাকে, সেভাবেই রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ল।

এর কিছুক্ষণ পর ছকু যে-নিথর শরীরটিকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখল সেটি তার নিজের।নিজেকে এভাবে ফেলে যাওয়ার ইচ্ছা হলো না ছকুর। সে অদূরে তেঁতুল গাছের নিচে অপেক্ষা করতে থাকল। স্বামীকে ফিরতে না দেখে মালতী নিশ্চয় কাউকে না কাউকে খুঁজতে পাঠাবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী ! নিজের লাশ তো আর নিজে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। সাপে কাটার আগেও চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। টর্চের আলো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না অথচ এখন সে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এমনকি লাশটির আশপাশে ছোট ছোট পোকামাকড়ের উপস্থিতিও লক্ষ করে। তারা সার বেঁধে ছকুর কান আর নাকের ছিদ্রে ঢুকছে। পোকামাকড় নাকি আগে থেকে অনেক কিছু বুঝতে পারে। সম্ভবত তারা ছকুর মৃত্যুর খবর জেনে গিয়েছে। মেয়েটার কথা মনে পরছে।ওর জন্য মাঝেমধ্যে মন খুব কাঁদে। সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল বেলী। এক রাতে বেলীকে মাঝখানে রেখে তারা স্বামী-স্ত্রী ঘুমিয়েছিল। সকালে দেখল মেয়ে নীলবর্ণ, হিমহিম ঠান্ডা। সাপের দেশের মানুষ! দুমাস-ছমাসে দু-একজন মানুষ সাপের দংশনে মরে এই দেশে। হাতে দাঁতের নিশানা চিনতে তাদের ভুল হয় না। বুঝে গিয়েছিল জাতসাপ।

ছকু ওর শরীর দেখতে থাকে।কী মায়ার শরীর ছিল তার! প্রতিদিন দুবেলা গায়ে লাইফবয় সাবান ঘষে চান করত। একবার অন্তত দুই প্যাকেট সানসিল্ক শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করত। এসব নিয়ে মালতী অনেক ক্যাঁচ ক্যাঁচ করেছে। তার ধারণা, বাজারের ফুলকির জন্য ছকু শরীরে সুগন্ধি মাখে। মালতীর সে-অভিযোগ অবশ্য পুরো মিথ্যে নয়। ফুলকি খুব ডাঁটের মেয়ে। খদ্দের পছন্দ না হলে বসে না...কী ব্যাপার কেউ এখনো আসছে না কেন? মালতী কি ভেবেছে ছকু ফুলকির ঘরে? কিন্তু বিয়ের পর ছকু একটি রাতও মালতীকে ছেড়ে ঘুমোয়নি। মেয়েমানুষের গায়ে যে লেবুর ঘ্রাণ থাকে সেটা মালতীকে না চিনলে ছকু জানত না। এই ঘ্রাণে সাংঘাতিক নেশা আছে। ওর গায়ের গন্ধ ছাড়া ছকুর ঘুমই আসবে না, এটা মালতী জানে, তাহলে ? বসে থাকতে থাকতে ছকুর হাই ওঠে।

"ছকু...ছকু.." চিৎকারে ছকুর টনক নড়ে।রফিক ,জগু এবং আরও কয়েক জন টর্চ নিয়ে ওকে খুঁজছে। অবশেষে টর্চের আলো ওর মুখে স্থির হল।ছকুর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে।ছকু স্থির।সবাই ছকুকে ঘিরে দাঁড়ায়।জগু ফিসফিস করে বলে "ছকু মরছে ! ওরে সাপে কাটছে..."

ছকু এখন ওর বাড়ির উঠোনে শুয়ে আছে। মালতী ছকুর বুকে উপুর হয়ে কাঁদছে। সে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করছে। উঠোনভর্তি লোকে লোকারণ্য। ওর পাশে কে একজন কুপি রেখে গেল। বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের চিমনি ঘোলা।হঠাৎ সম্মিলিত মানুষের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। ওঝা বারেক আলী এসে গেছে। এ-তল্লাটের নামিদামি ওঝা। কথিত আছে, সে তিনদিনের সাপে কাটা মরা মানুষকে জীবিত করতে পারে। তার মন্ত্রে এত শক্তি যে, পদ্মগোখরা পর্যন্ত সাতদিনের রাস্তা পেরিয়ে এসে বিষ তুলে নিয়ে যায়। এসব এলাকায় সাপের ওঝার অভাব নেই। তবে বারেক আলীকে সবাই আনতে পারে না। তার রেট বেশি।দুই ভাই কফিল এবং মফিল বারেক আলীর শিষ্য। তারা ছায়ার মতো ওস্তাদকে অনুসরণ করে।

বারেক আলী এসেই কাজে লেগে পড়ে। সে গম্ভীর হয়ে ছকুর শরীর ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে। তার হাতে হলুদ রঙের গুঁড়ো। বারেক আলী সেই গুঁড়ো দিয়ে ছকুর চারপাশে একটি বৃত্ত রচনা করে। ছকু জানে এর নাম লক্ষ্মণ রেখা। ওঝার দল ছাড়া কোনো মানুষ বা প্রাণীর এর ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। কফিল-মফিল প্রায় ধাক্কা দিয়ে লোকজন সরাতে থাকে। "সরেন সরেন বাতাস বন্ধ করবেন না। লক্ষ্মণ রেখার মধ্যে কেউ পা রাখবেন না। ঋতুবতী, বিধবা মা-বোনেরা উঠোনে থাকবেন না। কারো শরীরে তাবিজ-কবজ থাকলে সে চইলে যান। না হলে তাবিজ কাইটে যাবে।বাড়ির কে আছেন?" কফিল হাঁক দেয়।
"এই যে আমি" জগু,ছকুর জ্যাঠার ছেলে আগায়।
"চিকিৎসার কাজে আমাদের কয়েকটা জিনিস লাগবে। এই ধরেন, তাজা নিমের ডাল। পাত্তা শুদ্ধ আনবেন। মান্দার কাঁটা, কাঁসার বাটি, লালসালু কাপড়। তাত্তাড়ি করেন। খানিকটা সাদা কাপড় আইনেন "।হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেকদিকে একেক লোক ছুটে যায়। ওস্তাদ চোখ বন্ধ করে ছকুর মাথায় হাত রেখে অনুচ্চস্বরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে।
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করে, "ওস্তাদ, জান আছে?" ওস্তাদ কিছু বলে না কিন্তু মফিল চিৎকার করে, "থামেন সব, কেউ কোনো কথা কবেন না। ওস্তাদকে কখনো মুর্দা ছুঁতে দেখছেন?" মফিল তুলা রাশির জাতক। সে হাত চালান দিয়ে বিষ কোন পর্যন্ত উঠেছে সেটা নির্ণয় করবে। ছকু বহুবার এই দৃশ্য দেখেছে। হাত চালানোর জন্য ওস্তাদ মন্ত্র পড়ছে ।
"থুরু বুরু বিষ
থুরু বুরু খাস
থুরু বুরু খাইয়া বিষবশ্যা হইয়া যাস,
দোহাই মা পদ্মা দোহাই ঈশ্বর করণী দোহাই মোনাইসা দেবী ছু ছু ছুও"
ওস্তাদ মন্ত্র প'ড়ে ছকুর সাপে কাটা জায়গায় তিনবার থুথু ফেলে তারপর মফিলের হাতে চাপড় দেয়। থুথুতে ছকুর শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে।মফিলের হাত চলতে চলতে ছকুর ডান পায়ের হাঁটুর ওপরে এসে থামে। অর্থাৎ বিষ এখন এই পর্যন্ত।
ওস্তাদ উপস্থিত লোকজনকে সামনে রেখে বলে –"ভাই সকল, বিষ কোমর অবধি উঠে নাই। কিন্তুক জাত কেউটে কাটছে। খুব কঠিন বিষ। নামাইতে গিয়া আমার জান কবজ হইয়ে যাইবে। কিন্তুক আল্লাহ-রসুল সাক্ষী, মা মনসার দিব্যি, বারেক আলী জান কবুল কইরা হইলেও রোগীর শরীর থেইকে বিষ নামাইয়াই ছাড়বে "
ওস্তাদের এই ঘোষণায় জনতা চিৎকার করে সায় দেয়।অল্পসময়ের মধ্যে মান্দারের কাঁটা, নিমের ডাল, সাদা কাপড়, লালসালু সবকিছু চলে আসে। সাপে কাটার জায়গায় মান্দারের কাঁটা ফুটিয়ে রাখা হয়। ওস্তাদের দ্রুত তালের মন্ত্রের সঙ্গে দুই সাগরেদ নিমের ডাল দিয়ে ছকুর শরীরে পেটাতে থাকে। ছকু মন্ত্র শোনে,

"হাটের বিষ ঘাটের বিষ
অজগর কালকুটের বিষশঙ্খনী, পদ্মিনী
আর যত বিষধরের বিষ যদি তুই ছকুকে না ছেড়ে যাস
তবে কামরূপ কামাখ্যার মা মনসার মাথা খাস "
কিছু সময় পরপর মফিল হাত চালান দিয়ে দেখছে বিষ কতদূর নামল। প্রায় দুই ঘণ্টা ঝাড়ার পর মফিল ঘোষণা দিলো বিষ হাঁটুর কাছে নেমে এসেছে।উঠোনের লোক কমছে না, বরং বাড়ছে। দূর-দূরান্ত থেকেও লোক আসছে।

আলোর স্বল্পতার কারণে ছকুর চেহারায় কোনো পরিবর্তন এলো কি না, নীল রঙের জায়গায় রক্ত লাল হলো কি না সেটা লোকজন ঠাহর করতে পারে না।কিন্তু সময় যত বাড়তে থাকে ছকুর মনে হলো ওস্তাদের মন্ত্রের গতিও বাড়ছে। যখন ভোরের আলো ফুটল তখন গ্রামের বিধু মাস্টার এসে অন্য কথা বললেন। উনি ছকুর হাত, নাক-বুক ইত্যাদি পরীক্ষা করে ঘোষণা করেন, "এ তো মারা গেছে। এসব ভণ্ডামি রাখুন আপনারা। ঝাড়ফুঁক বন্ধ করুন। আগে হাসপাতালে নিতে হত। যতসব কুসংস্কার"।
উপস্থিত জনতা স্পষ্টতই সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং দুদলে ভাগ হয়ে যায়। একদল ঝাড়ফুঁকের পক্ষে, অন্য দল হাসপাতালের পক্ষে।ওস্তাদ কিঞ্চিৎ কূপিত হন। তিনি বলেন, "ভাইসব, আমি বলতেছি রোগী বাঁইচা আছে। সাপে কাটলে সাতদিন পর্যন্ত জান থাকে শরীলে। আপনেরা কি চান রোগী সুস্থ হইয়া উঠুক? যদি চান তো আমি চিকিৎসা চালাই যাব বাকি ওপরে আল্লাহ আর মা মনসা ভরসা। আর না চাইলে আমি চললাম"
এবার জনতা দ্বিধান্বিত হয়। তারা সহসা কিছু বলতে পারে না তারপর সমস্বরে বলে, আমরা চাই রোগী সুস্থ হোক। বিধু মাস্টার কোনো কথা না বলে স্থান ত্যাগ করেন। ফলে আবারো পূর্ণোদ্যমে মন্ত্র চলতে থাকে।বেলা বাড়ে। মানুষ বাড়ে। ওস্তাদ-সাগরেদের মুখে ফেনা জমে গেছে। রাত জাগার লাল চোখ, শ্রান্তি। মানুষের চোখে-মুখে হতাশার ছায়া। কারণ ছকুর শরীর নীল থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। মফিলের হাত ছকুর পায়ের গোড়ালিতে বিষ আবিষ্কার করেছে প্রায় দু-ঘণ্টা আগে। কিন্তু তার নিচে আর বিষ নামে না। বিষ নামলে তো ছকু উঠে বসার কথা।এমন সময় মৌলভি সাহেব এলেন। এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি। পোস্টমাস্টার। তিনি ছকুর মুখের দিকে তাকিয়ে রায় দিলেন, ছকু আর নেই। তার কথায় উপস্থিত জনতার তেমন কেউ দ্বিমত করল না। তিনি পরামর্শ দিলেন উপজেলা সদরের জেনারেল হাসপাতালে নিতে। মারা যাওয়ার পরও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কেন সে ধরনের প্রশ্ন অবশ্য কেউ করল না।
হাসপাতালের বারান্দায় লোহার টেবিলে ছকুকে শোয়ানো হয়েছে। কিছু সময় পরীক্ষার পর ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে বললেন, "স্যরি, রোগী অনেক আগেই মারা গেছেন। আপনারা আগে নিয়ে এলেন না কেন? বডি পোষ্টমর্টেম হবে"

মালতী আলুথালু বেশে ছকুর শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র একটা রাত, তাতেই মালতীর শরীর ভেঙে দিয়েছে। এতক্ষণে ছকু তার তিন বছরের ছেলে রাজনকে দেখতে পেল। জগু তাকে কোলে নিয়ে ছকুকে দেখায়, "ওই দেখ, তোমার বাবা। ভালো করে শেষবারের মতো দেখে নাও "। রাজন কী বুঝল কে জানে। সে খলখল করে হেসে বলল, "বাবা ঘুমায়"।ছকুর মন খুব ভারাক্রান্ত হচ্ছে এসব দেখে। সবকিছু সে দেখতে পাচ্ছে কেন, সেটাও বুঝতে পারছে না। তাহলে কি সে আসলেই বেঁচে আছে?

ছকুকে পোষ্টমর্টেমের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ছকুর এখন ঘুম পাচ্ছে। প্রচণ্ড ঘুম । ঘুমিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে ছকু দেখতে পায়, কেউটে সাপটি তার সমান্তরালে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছে।

__________________________________

অধ্যাপক ডা.অনির্বাণ বিশ্বাস । কবি। শুভচিন্তক। কলকাতার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়