Ameen Qudir

Published:
2018-08-01 17:11:50 BdST

মধ্যরাতে প্রফেসরের শয়নকক্ষে এক পয়ত্রিশোর্ধ নারী বসে আছেন:অস্বাভাবিক দৃশ্য.......




ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
________________________________

___ মধ্যরাতে প্রফেসরের শয়নকক্ষে এক পয়ত্রিশোর্ধ নারী বসে আছেন।অস্বাভাবিক দৃশ্য।ব্যাপারট চট করে চোখে পড়লে যেকোন সাহসী মানুষও বিভ্রান্ত হবে। প্রফেসর নিজেও বিভ্রান্ত হয়েছেন। তিনি খানিকক্ষণ যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন। কেন এসেছে, ধরার চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। উল্টো নিউরনে জট পাকিয়ে গেল। তিনি নিরুপায় হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন,
‘এ নারীর পরিচয় কী?’
প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। তিনি এবার মহিলাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
‘আপনি কেন এসেছেন?’
মহিলা জবাব দিল না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রফেসর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
‘আপনি কী করেন?’
মহিলা এবারও জবাব দিল না। আগের মত চোখের দিকে তাকাল না। তাকালো ঘরের দেয়ালের দিকে। দেয়ালে কিছু নেই। এরপর টেবিলের দিকে তাকাল। টেবিলেও তেমন কিছু নেই। কিছু এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজ। দুটো বলপেন। একটা কালো। একটা লাল। অপছন্দের কথাবার্তা তিনি লাল কালিতে মার্ক করে রাখেন।
উত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রফেসর খানিকটা বিরক্ত হলেন। বিরক্তি নিয়েই তিনি পরবর্তী ধাপে চলে গেলেন।
সায়েন্স অফ ডিডাকশন।
আচরণ, পোশাক ও সূক্ষ্মতম শারিরীক অস্বাভাবিকতার সুত্র ধরে রহস্যের সমাধান করা। প্রশ্নের উত্তর বের করা।
ডিডাকশনের প্রথম শর্ত হলঃ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো।খড়ের গাদার সুঁচটাকে আগে খুঁজে বের কর। গাদা যত বড়ই হোক, সময়ক্ষেপণ বা দুঃসাধ্য বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।
তিনি খড়ের গাদা খুঁজলেন। বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য পেলেন। বিচ্ছিন্ন তথ্যগুলো পরপর সাজিয়ে ফেললেন।
তথ্যঃ ১ মহিলা রুপবতী।
হুলস্থুল ধরণের না। এই চলে-টাইপের রুপ। ত্বক রোদে পোড়া। তিনি কী রোদে থাকেন?
অথবা কার্যসুত্রে তাকে রোদে যেতে হয়?
কী এমন কাজ?
তথ্যঃ ২ পরনে সবুজ রঙের শাড়ি। কচুপাতার মত সবুজ। গাঢ় সবুজের মাঝে হালকা সবুজের পানপাতার মত ফুল ফুটে আছে। শাড়িতে ভদ্রমহিলা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। কিছুক্ষণ পরপর পেছন থেকে আঁচল টেনে সামনে আনছেন। আবার ছেড়ে দিচ্ছেন।
কেন?
তার পেশায় কী শাড়ি পরতে হয় না?
তথ্যঃ ৩ পায়ে পাতলা সোলের ফ্লাট জুতো। শারিরীক উচ্চতা ও শাড়ির সাথে পাতলা সোল মিলছে না। উঁচু হিল পরলেই খানিকটা স্বাভাবিক লাগত। কী কারণে হিল পরেনি?
অভ্যাস নেই?
কেন?
প্রফেসর দ্বিতীয়বার নিজেকে প্রশ্ন করলেন,
‘এ নারীর পরিচয় কী?’

রুপবতী ও ক্ষমতাশালী নারীদের আচরণে ত্রুটি থাকে। তারা অকারণে হিমশীতল আচরণ করে পারিপার্শ্বের সাথে নিজের সূক্ষ্ম পার্থক্য ফুটিয়ে তোলেন। এসময় অধিকাংশই আচরণই হবে হাস্যকর ও উদ্ভট শ্রেণীর। ইনি তেমন উদ্ভট কিছু করছেন না। এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক। প্রফেসর সিদ্ধান্ত নিলেন, এই মহিলা কড়া ধরণের মানুষ। গরম তাওয়ার মত। পানি পড়লেই ছ্যাঁত করে ওঠে।
সিদ্ধান্ত নেবার পর যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল না। মহিলা উদ্ভট আচরণ শুরু করলেন। জুতোসহ পা দোলাতে লাগলেন। দুলুনিতে জুতোর তলা পায়ের তলায় লেগে ফটফট করে আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজ থামিয়ে মহিলা কড়া গলায় বললেন,
‘আপনি কি বিরক্ত?’
প্রফেসর স্পষ্ট শব্দে জবাব দিলেন,
‘না।’
‘কেউ বিরক্ত হলে চোখ ছোট হয়ে যায়। আপনার চোখও ছোট হয়েছে।’
‘আমার হাইপারমেট্রোপিয়া আছে। কাছের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়। চোখ ছোট করে ফোকাস করার চেষ্টা করি।’
‘আমাকে দেখতে আপনার কষ্ট করতে হচ্ছে? মাত্র তো আড়াই হাত দূরে আছি।’
‘আপনাকে দেখছি না।’
‘কী দেখছেন?’
‘আপনার শাড়ি। বারোহাতি উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাড়ি। মানব চক্ষুর স্বাভাবিক আচরণ হল- উজ্জ্বল আলো ও অস্পষ্ট জিনিস দেখার সময় চোখ ছোট করে ফেলে। দেখার সুবিধার জন্য। স্বাভাবিক চোখের কাছে আলোর তীব্রতা বা আলোকস্বল্পতা কোনটিই সহনীয় নয়। রিফ্লেক্সে চোখ ছোট-বড় হয়ে যায়। কমন ফেনোমেনন।’
‘বুঝলাম।’
‘আপনার নাম কী?’
মহিলা নাম বলল না।
আবার পা দোলানো শুরু করলেন। চক্রীয়ভাবে ফটফট শব্দ ফিরে আসছে। বিরক্তিকর শব্দ। পা দোলানো দেখে মনে হচ্ছে, সিম্পল পেণ্ডুলামের মত। বাহ্যিক ক্রিয়া অনুপস্থিত। দোলক থামবে না। আজীবন দুলুনি চলতেই থাকবে। দুলুনির সাথে পাল্লা দিয়ে ফটফট শব্দ বাড়তে থাকবে।
প্রফেসর প্রবল বিরক্তি নিয়ে শব্দের উৎস থেকে চোখ ফেরালেন। শব্দকে অবহেলা করতে হবে। যে মস্তিষ্কে জুতোর ফটফট শব্দ প্রবেশ করবে সে মস্তিষ্ক কাজ করবে না। অতি স্বাভাবিক থিওরী।
চোখ ফেরানোর সুবিধা থাকলেও কান ফেরানো গেল না। ফটফট শব্দ কানে ধাক্কা দিচ্ছে। বিরক্তি বাড়ছে। কানের পীড়া কমানোর কিছু বেসিক নিয়ম আছে। চিন্তাকে বিচ্যুত করতে হবে। পায়ের শব্দ থেকে থেকে সরিয়ে অন্য কিছুতে নিবদ্ধ করতে হবে। শব্দ কমতে কমতে একসময় শুন্যের কোঠায় যাবে। শব্দ হবে কিন্তু কান শব্দকে ধরবে না।
প্রফেসর চিন্তাকে বিচ্যুত করলেন।
তার বর্তমান চিন্তাবিন্দু-সাজসজ্জা।
মহিলার হাতে বৈচিত্র্যময় চুড়ি।লাল, কালো ও হলুদ রঙের মিশ্রণ।তিনটি পরস্পর বিপরীত রঙ্গের বিচিত্র সন্নিবেশ। সৌন্দর্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞানবোধ থাকা ব্যক্তিও চট করে ধরে ফেলবে, সামনে বসে থাকার মহিলা দরকারে কিংবা অদরকারে চুড়ি পরেন না। পরলেও দীর্ঘ বিরতিতে। ধারনা করা যায়, তার জীবনযাত্রায় সাজসজ্জার ব্যাপারটি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতে হয় না।
কেন ঘামাতে হয় না?
এই তথ্য নিয়ে কী বিস্তৃত চিন্তা করা যায়?
যায় না।
অপ্রয়োজনীয় তথ্য এইমুহুর্তে মাথায় ঢোকানো উচিৎ হবে না। প্রয়োজনীয় তথ্যরা চাপ সহ্য করবে না। মেমোরী সেল থেকে জায়গা হারাতে শুরু করবে।
প্রফেসরের মাথাভর্তি বিচিত্র সব তথ্য গিজগিজ করছে। সিরিয়াল কিলারদের আচরণ ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে তথ্য। প্রতিটাই গুরুত্বপুর্ণ। তথ্য উগরে দিয়ে তিনি বই লিখছেন। বইয়ের নাম-
Insights of a serial Killer.
লেখা আগাচ্ছে না। এক জায়গায় তব্দা মেরে থেমে আছে। এমন হবার কথা নয়।টানা দু’বছর দেশের সব লাইব্রেরী ঘেটে একঝাঁক বই সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশ বিদেশের সাইকিয়াট্রির জার্নাল স্তূপাকারে জমানো হয়েছে। তবুও সব যেন থমকে আছে। লিখতে হলে শান্ত, শীতল ও নিরবিচ্ছিন্ন নদীর মত মস্তিষ্ক দরকার। তিনি শান্ত নদীর খোঁজে ঢাকা ছেড়েছেন। লালমনিরহাট এসেছেন। এখানকার স্থানীয় খ্রিষ্টান মিশন ‘চার্চ অফ গড’ এর পুরো একটা দালান ভাড়া করেছেন। চার্চের কর্মচারীদের প্রতি তার কড়া নির্দেশ কেউ যেন তাকে না ঘাটায়।
কেউ ঘাটাচ্ছে না। সারারাত লিখছেন। ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙ্গে মধ্যরাতে। বিছানা ছেড়ে শহরে যান। এত রাতে শহরে রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে না। যেগুল থাকে সেখানে ফ্রীজ নেই। তিনি বাসি খাবার খেয়ে ফিরে আসেন।
প্রাচীন দালান।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি। কাঠের প্যাঁচানো সিঁড়ি। উঠার সময় সিড়িতে কচকচ শব্দ হয়। তিনি আনন্দচিত্তে কচকচ শব্দ উপভোগ করেন।
দু’দিন হল একটানা লিখছেন। ভুলভ্রান্তির দিকে তেমন খেয়াল করছেন না। মাথায় যা আসছে তাই সাদা পাতায় লিখছেন। আজকের কয়েক লাইন হল,
‘সিরিয়াল কিলাররা জন্ম নেন না। তাদের পিতা নেই, মাতা নেই। তারা শূন্য থেকেই তৈরি হন। কাঁচামাল আসে পরিবেশ থেকে।
পারিপার্শ্ব নিজ দায়ে সিরিয়াল কিলারদের তৈরি করে। দীর্ঘদিনের প্রবল অপ্রাপ্তি ও অসহনীয় যন্ত্রণা একজন অতি স্বাভাবিক ও ভদ্রলোককেও কিলারে পরিনত করে।
প্রথম খুনে তারা পৈশাচিক আনন্দ পান। প্রথমবার মদ খেলে ঘোর লাগা স্থায়ী নেশা হয় না। মানুষ হত্যায় হয়। সিরিয়াল কিলাররা প্রবল ঘোরের মাঝেই দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করে। একসময় প্রত্যাহিক কার্যের মত হত্যাকাণ্ডও তাদের কাছে রুটিনবদ্ধ হয়ে যায়।
নেশা না করলে মানুষজন উন্মত্ত হয়ে যায়। সিরিয়াল কিলাররা উন্মত্ত হয় না। তারা শীতল হয়ে যায়। তাদের মস্তিষ্ক আরো ধারালো ও সূক্ষ্ম হয়ে যায়। নতুন করে ছক কাটে। দাবার মত। কোনো ভুল চাল দেওয়া যাবে না। চাল হবে নিখুঁত।’

এতদুর লেখার পর প্রফেসর ভাবলেন, সব কথা ঠিক হল না। তিনি লেখার মাঝে খানিকটা মায়া কাজ করেছে। সিরিয়াল কিলারদের জন্য কেন মায়া কাজ করবে?
রহস্যটা কী?
প্রফেসর বুঝে ফেললেন, তিনি পালসটা ধরতেই পারছেন না। ধারাবাহিক খুনিরা অন্য জিনিস। বই বা জার্নাল পড়ে তাদের চিন্তাজগত ধরা মুশকিল। বাস্ত্বব অভিজ্ঞতা লাগে। তিনি দীর্ঘদিন সিরিয়াল কিলারের খোঁজখবর করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল দেশে এখন পর্যন্ত কোন সিরিয়াল কিলারের দেখা মেলেনি। অল্পকিছু কানাঘুষা শুনতে পেয়েছেন। অধিকাংশই ফ্যান্টাসী কিলার। আনাড়ি। খুনের পরই ধরা পড়ছে। ভীতমুখে সব স্বীকার করেছে। সিরিয়াল কিলাররা ভীতু নয়। তাদের আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। তাদের আত্মবিশ্বাস হবে আকাশছোঁয়া।
প্রফেসর আরও কিছু বিদেশী জার্নাল, বই এবং পুলিশ হিস্ট্রি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ছাত্র মারুফ আমেরিকা থেকে বই পাঠাবে বলে আশ্বস্থ করেছেন। শুধু বই পাবার অপেক্ষা।
সমস্যা হল, বই পাবার আগেই নতুন করে তিনি জড়িয়ে পড়লেন। তিনি জানেন, কোন অপরিচিত ও রহস্যময় মানুষ যোগাযোগ করার অর্থ ব্যক্তিগত কাজের সাময়িক বিরতি টানা। তিনি বিরক্ত বোধ করছেন।
মহিলা কথা শুরু করল।
হাত নেড়েনেড়ে কথা বলার সময় একঝাঁক চুড়ি ঝনঝন করে বাজছে। মাথার চুল ছেড়ে দেওয়া। ফ্যানের বাতাসে কাশবনের মত উড়ছে। প্রাকৃতিকভাবেই ভদ্রমহিলার অভিব্যক্তির মাঝে খানিকটা মোহনীয়তা চলে আসার কথা। বিচিত্র কারণে আসছে না। কোন একটি অজানা রহস্যে এসে সব ধরণের সাজগোছ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। রহস্যটা কী হতে পারে?
কারণ খোঁজার যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল না। তার আগেই মহিলা ভরাট গলায় বললেন,
‘আপনিই নাজিব সাহেব?’
‘জ্বি।’
‘আপনার তো ঢাকায় থাকার কথা।’
‘আমি স্বাধীন মানুষ। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের জন্য কোন ধরণের চুক্তি করিনি। কাউকে কথাও দেইনি।’
মহিলা খানিকটা ভ্রূ কুঁচকালেন। পায়ের ফটফট আওয়াজ থেমে গেল। সম্ভবত কড়া ধরণের কথাবার্তায় তিনি অভ্যস্ত নন। তার জীবন কাটে বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর মত। পরিধি বরাবর একঝাঁক লিয়াজো করে চলা মানুষ। যারা শীতল ভাষায় কথা বলে। মাথা নিচু করে প্রতি বাক্যে হা-হু করে।
মহিলা ভ্রূ স্বাভাবিক করলেন। বেশ শান্ত গলায় বললেন,
‘আপনার সাথে দেখা করতে তিনবার লোক পাঠিয়েছি। ঘরে তালা ঝুলানো। বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। উনি জানালেন, আপনি কোথায় আছেন, তিনি জানেন না। কাউকে না জানিয়ে উধাও হবার এক ধরণের রোগ আপনার আছে।’
‘বাড়িওয়ালা সত্য বলেছে।’
‘আপনি কি সত্যিই কাউকে জানান না?’
‘না।’
‘কারণ কী?’
‘কারণ নেই। এটা এক ধরণের হাস্যকর ফ্যান্টাসী বলতে পারেন।’
‘তবুও তো জানানো উচিৎ। যাই হোক। আপনাকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
‘আমাদের? এই শব্দের অর্থ কী? আপনারা কি আমাকে দলবেধে খুঁজছেন?
তিনি বিব্রত হবার মত বললেন,
‘ব্যাপারটা তেমন নয়।’
‘ব্যাপারটা কেমন?’
মহিলা জবাব দিলেন না। শাড়ির গোছা হাত দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছেন। গলদঘর্ম হচ্ছেন।
প্রফেসর ভাবতে শুরু করলেন।
ভদ্রমহিলা ‘আমাদের’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার অর্থ তিনি একা নন। সাথে আরো কেউ আছে। ঘর থেকে বাইরে বের হলে ব্যাপারটা ধরা যেত। সমস্যা হল একবার চেয়ারে আরাম করে বসলে উঠতে ইচ্ছা করে না। প্রফেসর বললেন,
‘আমার কাছে কেন এসেছেন?’
মহিলা হাসলেন। ঠোঁটের বামকোনে পাতলা হাসি। হাসি ধরে রেখেই বললেন,
‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে পাঠানো হয়েছে।’
‘আপনি কি পুলিশ?’
এবার ভদ্রমহিলা অল্পস্বল্প ধাক্কা খেলেন।
ঠোঁটের পাতলা হাসি উধাও। চোখেমুখে খানিকটা অবিশ্বাস। বুদ্ধিমান মানুষরা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না। অভিব্যক্তির আড়ালে মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা প্রকাশ পেয়ে যায়। তাই চেপে রাখেন। তিনিও চেষ্টা করলেন চেপে রাখতে। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
‘আমাকে পুলিশ ভাবার কারন কী?’
প্রফেসর নাজিব গম্ভীরমুখে জবাব দিলেন।
‘কারণের স্বপক্ষে বেশকিছু যুক্তি আছে। যেমনঃ
১। আপনি সীনা টান করে বসে আছেন।
ব্যাপারটা জন্মগত নয়। একোয়ার্ড। পেশাগত। দীর্ঘসময় উর্ধতন কর্মকর্তা বা অফিসারদের সামনে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা অবচেতনভাবেই চলে আসছে।
২। যেভাবে বারবার শাড়ির গোছা সামলাচ্ছেন, দেখেই বোঝা যায় আপনি শাড়িতে অভ্যস্ত নন। মেয়ে মানুষ শাড়িতে অভ্যস্ত হবে না, এই ব্যাপারটা ভাবা যায় না। এর কারণ হতে পারে, আপনাকে শাড়িই পরতে হয় না। নিয়মিত ইউনিফর্ম পরেন।
৩। আপনার কপালে কিছু চুল উড়ছে। আপনি বারবার হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। চুল খোলা রাখার অভ্যাসও আপনার নেই।
৪। আপনার দুপায়ের গোড়ালির পাশে কালো দাগ। ফর্সা পায়ে কালো দাগের উৎস কী হতে পারে? অতি সম্ভব দীর্ঘসময় বুট পরে থাকেন। বুটের ঘর্ষনে পায়ে কড়া পড়েছে।
মহিলা হেসে বললেন,
‘খানিকটা মুগ্ধ হলাম। তবে একই যুক্তিতে পুলিশ ছাড়াও তো অন্য বাহিনীর লোক হতে পারি।’
‘পারেন।’
‘আর কিছু বোঝা যায়?
‘যায়। আপনি বেশ ক্ষমতাবান পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছেন। লালমনিরহাট ঢাকা থেকে মোটামুটি চারশ কিলোমিটার দূর। মাইলের হিসেবে আড়াইশ মাইল। বড় দুরত্ব অতিক্রম করার উদ্দেশ্য সময়ই বড় হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে অতিথি পাখিরা হাজার মাইল পাড়ি দেয়।’
‘আমি অতিথি পাখি না। বাঁচামরার মতো এমন অবস্থাও নয়।’
‘হয়তো। আমি কাউকে না জানিয়েই এখানে এসেছি। নিভৃতে থাকতে পুরো একটা বাসা ভাড়া করেছি। চার্চের এন্ট্রিতেও ছদ্মনাম লেখা আছে। প্রযুক্তির দশ হাত দূরে আছি। লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত। আমাকে খুঁজে বের করা মুশকিল।’
‘অসম্ভব তো নয়।’
‘হ্যা অসম্ভব নয়। আমার মোবাইলফোন খোলা থাকে। জরুরী প্রয়োজনে কথা বলতে হয়। অতি সম্ভব ফোন ট্র্যাক করেছেন। এই ক্ষমতা থাকে ক্ষমতাবানদের। ক্ষমতাবানরা নিজের পরিচয় যেচে দেন না। তাদের ধারণা থাকে, মানুষজন তাকে এমনিতেই চিনে ফেলবে। আপনি এখনো আপনার নাম বলেননি। অনেকবার প্রশ্ন করার পরেও পরিচয় দেননি।
আপনার গলার স্বর মোটা। খানিকটা রুঢ়। অতি সম্ভব আপনি বড় অফিসার। আপনার বিশাল সংখ্যার অধস্তন কর্মচারী আছে। দিনের অধিকাংশ সময় অধস্তন কর্মচারীদের সাথে রুঢ়ভাবে কথা বলেন।
আপনি একা আসেননি।
অধস্তন কর্মচারীসহ সদলবলে এসেছেন। আপনার গাড়ি বাইরে দাড় করা। প্রবল বৃষ্টির মাঝেও আমি গাড়ির শব্দ পেয়েছি। বাইরে গাড়ি রেখে ঘরে প্রবেশ করতে ঘাসের দীর্ঘ লন পার হয়ে আসতে হয়। এসময় আপনার বৃষ্টিতে ভেজার কথা ছিল। ভেজেননি। আপনার হাতে ছাতাও নেই। আমি নিশ্চিত নিচতলায় গেলে দেখা যাবে কয়েকজন সিভিল ড্রেস-আপের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারাও পুলিশ। কোনো একজনের হাতে ছাতা ধরা।’
‘আপনার সব কথা মিলে গেছে।’
‘বৃষ্টি হচ্ছে। উনারা কি ভিজছেন?’
‘হুম।’
‘আপনি কি অনেক ক্ষমতাধর?’
‘হ্যা।’
‘ক্ষমতার উৎস কী?’
‘উৎসের কথা বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না।’
‘আমি বিব্রত হব না। আপনি পরিচয় দিন।’
‘আমি ডিএমপিতে আছি। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। তবে আমার পেছনে এর থেকেও ক্ষমতাধর মানুষ আছেন। তাঁর কড়া নির্দেশ, আমি যেন কোনোভাবেই তার কথা প্রকাশ করে আপনাকে বিরক্ত করি।’
‘আমি বিরক্ত নই।’
‘জেনে স্বস্তি পেলাম। আমি একটি সমস্যা নিয়ে এসেছি। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সমস্যাটা অনেক বড়।’
‘বুঝতে পারছি। আপনার সমস্যাটা কী বলুন। তার আগে আপনার নাম বলুন।’
‘মিতালি চ্যাটার্জি। সংক্ষেপে মিতা।’
‘আপনি হিন্দু?’
‘জ্বি।’
‘মিতা, আপনাকে কে পাঠিয়েছেন?’
‘খন্দকার আজমল চৌধুরী।’
‘পরিচিত নাম মনে হচ্ছে। ইনি কে?’
‘উনি আমাদের রাষ্ট্রপতি। আপনার তো চেনার কথা ছিল।’
‘আমি দুঃখিত।’
‘আপনি দুঃখিত না হলেও চলবে। স্যারের নির্দেশনা হল-আপনি যেন কোনোভাবেই বিরক্ত না হোন।’
‘একই কথা বারবার বলতে হবে না। রাষ্ট্রপতি একজন চমৎকার মানুষ। তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন জেনে ভালো লাগছে। এবার বলুন, আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য কী?’
‘দেশে বড় ধরণের একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। জানেন কিছু?’
‘না। আমি পত্রিকা পড়ি না।’
‘পত্রিকা পড়লেও জানবেন না। ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছে।’
‘কেন? সরকারের কেউ জড়িত?’
‘না। তেমন না। সরকারের লোকজন ভিক্টিম। তদন্ত শুরু হয়েছে কিন্তু আগানো যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্টের পরিবারের একজন সরাসরি ভিকটিম।’
প্রফেসর নাজিব নড়েচড়ে বসলেন। আরাম করে। ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। তার চোখ বন্ধ কিন্তু কান খোলা।
‘বারোজন মারা গেছেন। মৃত্যুগুলো বেশ অস্বাভাবিক।’
‘কীভাবে মারা গেল?’
‘সেটা এখনো রহস্য।’
‘কোন সুত্র তো আছে।’
মিতা থতমত খেয়ে বলল,
‘আছে। কিন্তু মেলানো যাচ্ছে না। বারো পরিবারে বারোজন মারা গেছে। প্রতিটা পরিবারে মৃত্যুর আগেরদিন একটা করে অদ্ভুত কুরিয়ার আসে।
‘কী কুরিয়ার?’
‘ফুলের টব।’
প্রফেসর চোখ খুললেন। ব্যাপারটা বেশ জটিল। রহস্যময়। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন,
‘পুরো ব্যাপারটা বলুন। আমি শুনছি।’
মিতা খানিকটা সন্ত্রস্থ গলায় বলল,
‘টব পলিথিনে প্যাঁচানো অবস্থায় থাকত। পুরো সিলড। কুরিয়ার হোম ডেলিভারি। রিসিভ করার পর যে পলিথিন খুলত সেই মারা যেত। কোন পরিবারে কর্তাব্যক্তি খুলেছেন। আবার কোন পরিবারে বাড়ির ছোট মেয়ে খুলেছে। কাজের লোকও ছিল। সবাই মারা যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল পরিবারের বাকীরা সবাই সুস্থ্য।’
‘কীভাবে মারা যায়? মৃত্যুর আগে কোন লক্ষণ?’
‘ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। ভয়ংকর। প্রথমে হাতে ঘা হত। ফুসকুড়ি টাইপের। এরপর সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত। ঘায়ের মত। প্রবল জ্বর নিয়ে পরদিন মারা যায়।’
প্রফেসর বললেন,
‘ঠিক আছে। আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি কয়েকটা প্রশ্ন করছি। উত্তর দিলেই চলবে।’
মিতা চোখ বড়বড় করে বলল,
‘অবশ্যই প্রশ্ন করবেন। আজ ভোর হবার আগ পর্যন্ত আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য।’
‘টবে কোন ফুলগাছ ছিল?’
‘হুম। কালো গোলাপ।’
‘টব কীসের ছিল? মাটির?’
‘না। টিনের কৌটা। বিস্কুটের বৈয়াম সাইজের টব।’
‘টবে মাটি ছিল?’
‘জ্বি।’
‘মাটির রঙ কী?’
‘কালো।’
‘টবগুলো আছে?’
‘আছে। ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আপনি কি দেখতে চান?’
‘না। আমি দেখে ফেলেছি।’
‘কীভাবে?’
‘আপনার চোখ দিয়ে। প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব পেলে আরেকজনের চোখ দিয়েও দেখা যায়।’
মিতা হাতে সাদা রঙের চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘বারোজন মানুষ হত্যাকাণ্ডের পর একটা চিঠি আসে। কোডেড মেসেজের মত। সম্ভবত খুনি নিজেই পাঠিয়েছে। আপনি দেখতে চান?’
‘টেবিলে রাখুন। আমি পরে দেখব।’
মিতার চোখ বদলে গেল। চোখের উপরের পাতা আরো খানিকটা উপরে উঠল। সেখানে বিস্ময়। রাষ্ট্রপতির সরাসরি রেফারেন্সের পরও একজন মানুষ নিস্পৃহ হতে পারে, তার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

বৃষ্টি বাড়ছে।
বাড়ন্ত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মিতালি চ্যাটার্জি চলে গেল। বৃষ্টির ঝুম শব্দে কাঠের সিঁড়ির কচকচ আওয়াজ শোনা গেল না।
প্রফেসর চেয়ার ছাড়লেন। দোতলার জানালায় দাঁড়ালেন। বাইরে সরকারি জীপের সারি। কালো রঙের। অন্ধকারে হালকা আলোতে কালো রঙ চকচক করছে। মাঝের গাড়ির কাচ নামানো। মিতালি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভেতর কারো কথা বলছে।লম্বামত এক মানুষ মিতালির মাথায় ছাতা ধরে আছে। তার পরনে সাদা শার্ট।
গাড়ির ভেতরে একজন মানুষ। মুখ দেখা যাচ্ছে। আলো আঁধার। তবুও বেশ স্পষ্ট। এই মানুষটাকে প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়। নিরহংকার। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। দেশের সব ধরণের সমাবর্তনে তাকে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়।
প্রফেসর জানালা ছাড়লেন। চেয়ারে আরাম করে বসলেন। টেবিল থেকে ছোট চিরকুটটা খুললেন। চিরকুটে স্পষ্ট বর্ণে হাতেলেখা-
8 8 0 call HIM in your silence 3 4 8
প্রফেসর নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘চিরকুটের হাবিজাবি শব্দের অর্থ কী?’


[চলবে]
.
.

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার, কথাশিল্পী। ঢাকা বইমেলার অন্যতমবেস্ট সেলার লেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়