Ameen Qudir

Published:
2016-12-10 20:15:48 BdST

ভালোবাসার ঘর :ছবিটা শেষে এমন থাকে কি!


ছবিটা শেষে এমন থাকে কি!____________________

 


কৃষ্ণা মান্না
______________________

বিভাদেবীর মন আজ ভীষণ ভারাক্রান্ত। দুবছর আগে আজকের দিনে তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন। ছেলে সমীরকে কত করে বললেন অফিসের কাজে একদিন পরে বাইরে যেতে কিন্তু শুনল না, বৌমা নীরাকেও বলেছিলেন কিছু মিষ্টি ফুল এনে দিতে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, সবার তাড়া, নানা অজুহাতে দেখিয়ে সেও চলে গেল অফিসে। মানুষ চলে গেলে কি এভাবেই ভুলে যেতে হয়? মানুষটা নেই তার ছবির সামনে দুদন্ড দাঁড়াবার সময় আজ ছেলের কাছে নেই। বিভাদেবী নিজেই চললেন স্বামীর জন্য ফুলের মালা আর মিষ্টি কিনতে। যেতে যেতে হঠাৎ একটা গাড়ী বিভাদেবীর কাছে এসে দাঁড়াতেই গাড়ী থেকে একটি ছেলে নেমে এসে বিভাদেবীকে প্রনাম করে কুশল জানতে চাইল। বিভাদেবী আশীর্বাদ করলেন কিন্তু চিনতে না পেরে নীরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি (হেসে) নিজেই বলল আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমি চন্দন চৌধুরী, স্যার আমাকে চাঁদু বলে ডাকতেন আর বন্ধুরা মজা করে চাচা ডাকত।

বিভাদেবী: হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, আজকাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। পড়তে এসে তোমাদের বায়না ছিল আমার হাতের তৈরি খাবারের। মনে পড়ছে। তুমি এখন কি কর?

চন্দন চৌধুরী (চাচা): আমি অনেক বছর বাঙ্গালোরে ছিলাম এখন স্পেন এ। মা থাকতে চান না বিদেশে তাই মাকে স্পেন দেখিয়ে আনলাম। স্যার আমাকে পড়াশুনা আর অর্থ দিয়ে সাহায্য না করলে আজ আমি এখানে পোঁছতেই পারতাম না। স্যার এর এই উপকার আমি কোনোদিন ভুলব না। আমাদের ওই পুরানো বাড়ীটাকে আমি গুছিয়ে নিয়ে একটা হোম খুলেছি মা এখন সেটাই দেখাশুনা করেন আর আমরাও আসি প্রতি বছর। আপনিতো আমাদের বাড়ি চেনেন চলুন মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসবেন।

 

 

বিভাদেবী: না না আজ নয় বাবা অন্যদিন যাব। আজ তোমাদের স্যার এর মৃত্যুদিন তাই মালা মিস্টি কিনতে এসেছিলাম।

চন্দন চৌধুরী (চাচা): হ্যাঁ, স্যার এর মৃত্যু সংবাদ আমি পেয়েছিলাম চলুন আমিও যাই আপনার সঙ্গে।

চন্দনই সমস্ত সামগ্রী কিনে স্যার এর ছেলের ফ্ল্যাটে এসে স্যার এর ছবিতে মালা ধুপ মিষ্টি দিয়ে কিছুক্ষন নীরব থেকে বিভাদেবীকে প্রনাম করে ফিরে গেল।

 

 

বিভাদেবী স্বামীর ছেড়ে যাওয়া ভিটেতেই থাকতে চেয়েছেন কিন্তু ছেলের নানা বাহানায় সেই বাড়ী, বাবার স্মৃতি বিজড়িত সমস্ত জিনিস বেচে দিয়ে শুধু স্বামীর ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। এত ছোট জায়গায় চলাফেরার অনভ্যাসের ফলে কিছু না কিছু জিনিসের ক্ষতি হত তাতে বৌমা মুখে কিছু বলত না কারন তার যে এখন ভীষণ প্রয়োজন এই মানুষটিকে। অফিসে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাজের দায়িত্ব বেড়ে যাওয়াতে সময়মত বাড়ী এসে ছোট মেয়েটিকে ঠিকমত দেখা হয়না তাই ঘরের সমস্ত দায়িত্ব এক প্রকার শাশুড়ির হাতে ছেড়ে দেওয়ার দরুন সামান্য ক্ষতি গুলো মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। বিভাদেবীও মিষ্টি নাতনির মায়ার বাঁধনে সব কিছু ভুলেই ছিলেন। এইভাবে দু তিন বছর যাবার পর একদিন ছেলে মাকে বলল –

ছেলে: এই ফ্ল্যাটটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ছোট। নীরার অফিস থেকে বড় ফ্ল্যাট দেবে, আমাদের দুজনারই অফিসের খুব কাছাকাছি হবে আর ওখানে মেয়ের জন্য ভাল স্কুল গুলোও খুব কাছে হবে কিন্তু ফ্ল্যাটের জন্য বেশ কিছু টাকা আমাদের দিতে হবে তাই বলছিলাম তোমার নামে বাবা যে জমিটা কিনে রেখেছে সেটা যদি তুমি বেচে দেওয়ার অনুমতি দাও তাহলে ফ্ল্যাটটা নিতে সুবিধা হয়।

বিভাদেবী: তোমাদের সব সুবিধার কথাতো শুনলাম কিন্তু আমার সুবিধার কথাতো একবারও বললে না।

ছেলে: (খুব উৎসাহ নিয়ে বলল) তোমার জন্য একটা আলাদা ঠাকুর ঘর আর তোমার মনের মত আসবাব পত্র দিয়ে সাজানো আলাদা শোবার ঘরও থাকবে।

 

 

বিভাদেবী: (ছেলের কথায় চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে) হ্যাঁ এই ফ্ল্যাটে শোবার ঘরতো পাইনি যদি ওইখানে আলাদা ঘর পাই তাহলে আমার ঘর সাজিয়ে দিস। তোর বাবা যে টেবিল চেয়ারে বসে তোকে আর ছাত্রদের পড়াত, যে হেলান দেওয়া চেয়ারে বসে তোর বাবা রোজ বারান্দায় সকালবেলা চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ পড়ত, যে খাটে তোর ছেলেবেলার গন্ধ মাখা আছে, পারবি খোকা সাজিয়ে দিতে আমার মনের মত সেইসব জিনিস দিয়ে? যদি পারিস খোকা আমি এখুনি সই করে দেব, যেখানে বলবি যখন বলবি তোর সব কথা আমি রাখব তুই শুধু আমার এই কথাটা রাখ।

মায়ের কথার কোনো উত্তর সমীর দিতে পারেনি নীরব থেকে শুধু শুনে গেছে। সত্যিই তো সমীর যে কোনো স্মৃতিই বাঁচিয়ে রাখিনি। নতুন ফ্ল্যাটে আসার তাগিদে পুরানো সব জিনিসই তখন ছিল বেমানান। সমস্ত স্মৃতিই যে পাঁচ বছর আগে ন্যায্য মূল্যে বেচে দিয়েছে।

 

 

এরপর প্রায় ছমাস কেটে গেছে সমীর জমি নিয়ে আর কোনো কথা তোলেনি। বিভাদেবীও আগের থেকে আরও মনমরা হয়ে গেছে। নাতনিও এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে তাই বেশ কিছুটা সময় বিভাদেবী একদম একা হয়ে যান। সমীরের আলাদা করে ট্যুরে যাবার সময় নেই তাই কাজের ফাঁকে কিছুটা বেড়ানোও হবে এইভেবে সাত দিনের অফিস ট্যুরে যাবার সময় মেয়ে আর নীরাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। বিভাদেবী ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন। সাতদিন বাদে ফিরে এসে কলিং বেল বাজিয়েও কোনো সাড়া না পেয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে সমীর কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে মাকে না পেয়ে মায়ের লেখা একটি চিঠি পায় আর খামের মধ্যে নিজের নামে একটা মোটা অঙ্কের চেক। চিঠিতে লেখা – “খোকা তোর বাবার দেওয়া জমি তোরই বাবার এক ছাত্র বাজার দামের বেশী মূল্য দিয়েই কিনে নিয়েছে। তোকে আমার জন্য আর আলাদা ঘরের চিন্তা করতে হবে না। সাজানো ঘর আমি খুঁজে পেয়েছি। সেই ছাত্রের তৈরি হোমই এখন আমার ভালোবাসার ঘর। তোরা ভালো থাকিস, সুখে থাকিস – ইতি মা”।

 

 

সমীর সোফায় বসে মায়ের চিঠির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিল, এমন সময় সমীরের মেয়ে ধীর পায়ে এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো চুমোয় ভরিয়ে দিতেই সমীর মেয়েকে জড়িয়ে নীরব কান্নায় মুখ লুকিয়ে নিল।
______________________________

 


লেখক কৃষ্ণা মান্না। সুলেখক । বিবেকানন্দ মহিলা কলেজের সাবেক ছাত্রী। থাকেন কলকাতায়। লেখেন মানুষের শুভ মনোজগত নিয়ে।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়