Ameen Qudir
Published:2018-07-18 19:41:11 BdST
রোগী কথন এনেনকেফালিঃ ব্যাঙ বাচ্চার মিথ এবং কোন এক মাকে
ছবি লেখকের সৌজন্যে পাওয়া।
ডা. ছাবিকুন নাহার
___________________________
আমি তখন এইট কিংবা নাইনে পড়ি। একদিন সকাল বেলা গ্রামে কি একটা কানাকানি ফিসফিস টাইপ ব্যাপার ঘটল। সবার মধ্যেই চাপা উত্তেজনা এবং উৎসুক থই থই করছে। সত্য মিথ্যা রিউমার মিলেমিশে রংধনুর মতো ঈশান কোনে ঝুলতে থাকল। জানার প্রবল আগ্রহ আর অবিশ্বাসের মতো বিপরীত দুটি ভিন্ন স্রোতের টক্কর লাগল বলে।
- এ্যাই আব্দুলালের ঘরে নাকি ব্যাঙ অইসে?
- ঘরে তো ব্যাঙ আইতেই পারে, অবাক হওনের কী আছে?
- আরে হেইডা না। ওর বউ পোয়াতি আছিল না? কালকা রাইতে ব্যাতা ওঠল। বাচ্চা নাকি অইসে এক্কেরে ব্যাঙের লাহান!
- যাহ্! মানুষের ঘরে আবার ব্যাঙ অয় নাকি!
- আরে হ। ফাতু বু কইসে। হেয় তো দাই আসিল। বাচ্চা ডেলিভারি হেয় তো করাইসে।
- কী জানি! খোদা, এ কী কলি কাল! পাপ! পাপ! পাপের ফল। নাইলে এমুন হয়? মানুষের পেটে ব্যাঙের বাচ্চা! এইডা আবার অয় নাকি?
উপরোক্ত কথাবার্তা একটা শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং তার রিউমারের ডালপালার ইতিকথা। তখন আমি ডাক্তারি বিদ্যার ড ও জানিনা। তারপরও মনে হচ্ছিলো কোথাও বড় একটা ভুল হচ্ছে। মানুষের ঘরে ব্যাঙ হতে পারেনা। তাই রহস্যময়তা আমাকেও কিছুটা উৎসুক করে তুলেছিলো বললে ভুল হবে না। 
তাদের সেদিনের কথার প্রতিউত্তর আজকের ডাক্তার আমার,
- হয় রে ভাই হয়। ব্যাঙ না, মানুষের বাচ্চাই হয়। তবে দেখতে কিছুটা ব্যাঙের মতো
আমার কথা শুনে চোখ গোল গোল করে ফেললেন দেখি! বুঝছি আপনাদেরকে আরেকটু বুঝিয়ে বলতে হবে। এখন তো একটু কপাল থেকে চোখটা নামান।
বলছিলাম এনেনকেফালির কথা। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এনেনসেফালি। আচ্ছা যা বলছিলাম, আসুন জানি ঘটণা কি।
* এনেনকেফালি কি?
এটা একটা জন্মগত ত্রুটি। এখানে বাচ্চার মাথার খুলি থাকে না। শুধু তাই না, মাথার সামনের অংশের মগজও থাকেনা। তবে মুখমন্ডল থাকে। কমেন্টে ছবি দিলাম। দেখে মিলিয়ে নিন।
*ইন্সিডেন্স কত?
প্রতি হাজার জন্মে একজন।
* এনেনকেফালির সাথে ব্যাঙের সম্পর্ক কি?
আছে কিছুটা। তার আগে কপাল, মাথার খুলি ছাড়া একটা বাচ্চার চেহারা কল্পনা করেন তো। কি মনে হচ্ছে না, ব্যাঙের চোখের মতো দেখতে বাচ্চার চোখগুলো? বাইরে বের হওয়া। আল্ট্রাসনোগ্রামে কিন্তু আমরা এই বাচ্চার চোখকে 'ফ্রগ আই' বলে থাকি।
* কেনো এমন হয়?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন কারণ জানা যায় না। তবে ফলিক এসিডের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, টক্সিন এবং পরিবেশগত কারণ উল্লেখযোগ্য।
*প্রতিরোধ কিভাবে করা যায়?
বাচ্চা নেয়ার আগে ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়ে রিস্ক ফ্যাক্টর আইডেন্টিফাই করা। সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়া এবং অতি অবশ্যই গর্ভধারনের তিন মাস আগে থেকেই ফলিক এসিড সেবন করা।
*চিকিৎসা কি?
এই বাচ্চারা সাধারণত বাঁচে না। জন্মের পরপরই মারা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আধঘন্টার মধ্যেই। কাজেই ডায়াগনোসিস হলেই রোগীদের কাউন্সিলিং করা হয় ডেলিভারি করে ফেলতে। এছাড়া উপায় ই বা কি? এর সাথে আরো অনেক সমস্যাদি থাকে। কাজেই সারভাইভাল ফর ফিটেস্ট এর ল মানতেই হয়।
আমি বলছিলাম কি, এনেনকেফালি হলেই বোধহয় ভালো ছিলো। অন্তত মস্তিকের অপব্যাবহার তো হতো না। সৃষ্টির সেরা বলি নিজেদের আর কাজ করি উল্টা! কী নির্লজ্জ অবিবেচক যে আমরা, মস্তক সম্বলিত মানুষেরা!
একটা জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ বাচ্চার জন্ম কি পরিমান রিউমার এবং আতঙ্ক যে ছড়িয়েছিলো, কী বলব! মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে! বাচ্চার মায়ের করুণ মুখ, ভেজা চোখ এখনো আমাকে বলে যেনো, এটা নিয়ে কেনো লিখছ না? মা আপনার জন্য আমার আজকের এ লেখা।
_______________________________

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       