Ameen Qudir

Published:
2018-07-18 19:26:26 BdST

ডাক্তার হওয়াকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে সম্ভবত হরলাল রায়ই ঝামেলাটা তৈরি করে গেছেন


 

 


অনির্বাণ সরকার
_______________________

সম্ভবত হরলাল রায়ই ঝামেলাটা তৈরি করে গেছেন। তাঁর 'বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা' বইয়ের রচনাংশে 'আমার জীবনের লক্ষ্য' শীর্ষক রচনায় ডাক্তার হওয়াকেই লক্ষ্য বানিয়ে রচনা লেখা। হরলাল রায়ের এই বইয়ের প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী, পরবর্তীতে বহু খ্যাত ও অখ্যাত বইয়ের রচনাও হরলাল রায়ের বই থেকে নেয়া, কখনও বাক্যের পর বাক্যে আশ্চর্য মিল, কখনও বা ভাবচুরি।
হরলাল রায় যেসময় এই বই লিখেছিলেন, তখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় 'একটি পয়সার আত্মকাহিনী', 'একজন চোরের আত্মকাহিনী', 'একটি আংটির আত্মকাহিনী' এইসব রচনা আসতো। ( হ্যাঁ, 'একটি আংটির আত্মকাহিনী'র শিহরণজাগানো রোম্যান্স, যেটা এই বইয়ে ছিলো, তা আজও ভুলতে পারিনি)।
'আমার জীবনের লক্ষ্য' বিষয়ক হরলালীয় আদর্শ অনুসৃত হয়েছে বাংলার গ্রামীণ বিদ্যালয় থেকে শহুরে বিদ্যালয়ে, এমনও হয়েছে ডাক্তার ব্যতীত অন্য পেশাকে জীবনের লক্ষ্য ধরে রচনা লিখলে নম্বর পাওয়া যেতো কম।
সাহিত্যপ্রেমী বাঙালীর একটা বড় অংশের কাছেই দেশভাগের আগেপরে ডাক্তার মানেই ছিলেন বনফুল, যিনি স্বীয় হস্তে একাদিক্রমে ধারণ করতেন ডাক্তারি অস্ত্র আর সাহিত্যিক লেখনী। পরে নাম ছড়িয়েছে বিধানচন্দ্র রায়ের, বস্তুত জনমানসে এঁরাই কিংবদন্তী।
আমাদের অন্যান্য নমস্য চিকিৎসকবৃন্দ বাস্তব কারণেই তাঁদের অর্জিত জ্ঞান নিয়ে জীবনের কর্মক্ষম সময়টা গ্রামে কাটাননি, বড় শহরে বসেই চিকিৎসা দিয়েছেন৷ দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার অজস্র উদাহরণ রেখে গেছেন তাঁরা।
হরলালীয় আদর্শে ডাক্তারি পাশ করার পর কোনো উচ্চশিক্ষার দরকার নেই, পিঠ দিয়ে পড়ে থাকো গ্রামে ( Back to the village- এর আক্ষরিক অনুবাদ)। তুমি কি খাইয়া বাঁচিবে, কি পরিয়া লজ্জা নিবারণ করিবে, তাহা হরলালবাবু ভাবেন নাই। সেবা, সেবা আর সেবা। সেবার পরেও সেবা। মরে যাই!
অগ্রদূতের 'পথে হল দেরী' তে উত্তমকুমার বলছেন- "একজন এমবিবিএস ডাক্তারের আর কতটুকুই বা জ্ঞান?" এই কথা সিনেমাপ্রেমী বাঙালী সেই ১৯৫৭ সাল থেকেই (ছবি মুক্তির বছর) লুফে নিয়েছে, হরলালীয় আদর্শের বাইরে গিয়েও যে ডাক্তারেরা দেখাতে পারে রোমান্টিকতার পরাকাষ্ঠা, পরপর 'হাসপাতাল', 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী'তেও তা অক্ষয় হয়ে রইলো।
হ্যাঁ, রোমান্টিকতাও চলবে, তবে অর্থসঞ্চয় নয়, জীবনের মানোন্নয়ন নয়। চিকিৎসা অতঃপর সেবা হয়েই রইলো।
'পেশাদারিত্ব' কথাটা শুনলে আজও অনেক শিক্ষিত বাঙালী আঁতকে ওঠে। এর মাধ্যমেই যে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করা যায়, তার ধারণাই অনেকের নেই। চিকিৎসাদাতা এবং চিকিৎসাগ্রহীতার পারস্পরিক অবিশ্বাসের মূল কারণ পেশাদারিত্বের অভাব। রোগীকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করাও পেশাদারিত্ব, তা-ই বা কজন বোঝে? আর 'সেবা' বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে থাকলে পদে পদে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। সেটাও সত্যি।
_____________________________

অনির্বাণ সরকার, সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়