Ameen Qudir

Published:
2018-06-07 16:26:42 BdST

মা চলে গেছেন গ্রামে , মনখারাপ : দশ পয়সার পোস্ট কার্ড কিনে মাকে চিঠি লিখলাম


মাকে লেখা ১৪৬ বছর পুরনো একটি চিঠি। প্রতিকী ছবি___________________


দেবব্রত তরফদার
__________________________

প্রথম চিঠিটা লিখেছিলাম মাকে।তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি । মা চলে গেছেন গ্রামে , মনখারাপ কাজেই দশ পয়সার পোস্ট কার্ড কিনে মাকে চিঠি লিখলাম । এমনই বোকা ছিলাম যে মাকে লেখা চিঠিতে ছিল কান্না , দুঃখ , বিষাদ । সেটা যে মাকে কষ্ট দেবে কখনই ভাবিনি । প্রথম কয়েক বছর শুধু মাকেই চিঠি লিখেছি।বাবাকে কোন চিঠি লিখেছি কিনা মনেই পড়েনা। লেখার তাগিদও অনুভব করিনি কখনো। আর দু একটা চিঠি লিখেছি মেজদিকে । ছোট্ট ভাগ্নিটার জন্য মন কেমন করতো তাই চিঠি লিখতাম। মেজদির চিঠিতে শুধু ভাগ্নির কথায় থাকতো সেটা পড়ে আরো মনখারাপ করতো। দিদির বন্ধু ছিল কল্যাণদা , কলকাতার ছেলে তাকে চিঠি লিখেছি অনেক । কল্যাণদার চিঠিগুলো ছিল দারুন সাধারণ চিঠির মত নয় । আমি পরে কল্যাণদার মত চিঠি লেখার চেষ্টা করতাম।
কোন বন্ধুকে প্রথম চিঠি লিখেছি তা মনে নেই তবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর এক বছর নির্বাসনে ছিলাম গ্রামে , তখন চিঠি লেখা ছিল নিয়মমাফিক
। সারাদিন ব্যস্ত থাকতাম চাষবাস , দোকানের কাজে । রাত্রিটা ছিল আমার নিজস্ব সময়। মাটির ঘরের দাওয়ায় তক্তাপোষে শুতাম , বাঁশের চাটাইএর বেড়ার ব্যারিকেড ,তার ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকতো সুচের মত তীব্র নদীর বাতাস , গরমকালে আরামদায়ক কিন্তু শীতকালে লেপকাঁথা সব ঠান্ডা জল করে দিত । আর আমার সেইসব লেখা চিঠিগুলো ছড়িয়ে যেত কৃষ্ণনগর , কলকাতা , বেথুয়াডহরি , শান্তিপুর । উচ্চমাধ্যমিকের পর বন্ধুরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল আর আমি চলে গেলাম সব রকম সীমানার বাইরে। লেখাপড়া নেই , লিটিল ম্যাগাজিনের কাজ নেই , ঋত্বিক , সত্যজিৎ মৃনাল সেন কে ফেলে এসেছি। এখন জমি , মুনিশ , ফসল , মাছধরা দোকান এই হল জীবন। মনের জানলা ছিল চিঠি লেখা আর চিঠি পাওয়া। আমাদের ভ্রাম্যমাণ পোস্ট অফিসের পোষ্ট মাস্টার স্বপন কর্মকার । নটা গ্রামের একটা পোষ্ট অফিস । ডাকপিওন দুজন । একজন আমাদের সেই পুরোনো কেষ্টদা যার মিষ্টির দোকান ছিল আর একজন নটরাজদা।তা যাইহোক চিঠি বিলি করতে দূরের গ্রামগুলোতে যেত চিঠি জমলে। মাসে চার পাঁচ দিন। পোষ্ট মাস্টার স্বপনকর্মকার , আবার হাতুড়ে ডাক্তারি করতো । থানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মানে রফাটফা সব তার মাধ্যমেই হত। লোকটার খুব একটা সুনাম ছিল না ।তার আর একটি গুন ছিল ছিল চিঠি খুলে পড়া । প্রথম প্রথম মেয়ে বন্ধুদের চিঠি নিজে পড়ার আগেই খুলে পড়তে দিতাম।একদিন একটুখানি দেখেই দিয়ে দিয়েছিল। এই লোকের অনেক দুর্নাম থাকলেও আমাকে দারুন ভালোবাসতো, একদম খাঁটি ভালোবাসা।

আসলে বয়স হচ্ছে তো তাই প্রসংগান্তরে চলে গেছিলাম।চিনি না এমন জনকে প্রথমে চিঠি দিয়েছি সে ধর্মদার উৎপল দে। আমাদের লিটিল ম্যাগ অশ্বারোহির কল্যানে রঞ্জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল উৎপলের সঙ্গে । তারপর বন্ধুত্ব, কত চিঠির আদানপ্রদান হয়েছে তার ঠিক নেই ।সে বন্ধুত্ব এখনো রয়েছে। এক বছরে রেকর্ড পরিমান চিঠি লিখেছি। তারপর আবার কলেজে ভর্তি হলাম । নতুন বিষয় , নতুন বন্ধু ।পুরোনো সম্পর্কের সুতো গুলো ক্ষীণ হতে থাকলো আর চিঠি লেখাও গেল কমে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । এখানে নতুন বন্ধুদের প্রথমে পুজোর ছুটিতে চিঠি লিখলাম। তারপর তাদের চাপে সেই লেখা জারি থাকলো সারাবছর । দেখা হলেও চিঠি লিখতে হত। কি লিখতাম এত ? এখন ফেসবুক পেজে যেমন লিখি তেমনই সব আবোলতাবোল। যা নাকি তাদের খুব প্রিয় ছিল। আর আমার বন্ধু আব্দার যে ছোট বেলা থেকে প্রথমে মুম্বাই তারপর বিদেশে তাকে লেখার জন্য এয়ারমেল এনভেলাপ কিনতে হত ঘন ঘন । আর ছিল একজন ,যারসঙ্গে দেখা হত কালেভদ্রে, তাকে চিঠি লিখতে হত প্রতিদিন ।হাস্যকর রকমের বড় চিঠি , দিতেই লজ্জা করতো। কিন্তু দায়বদ্ধ ছিলাম। বন্ধুদের চিঠির ব্যাপারটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হবার পরও কিছুদিন ছিল। আর বিশেষ দীর্ঘ চিঠি লেখার কষ্টও বেশিদিন করতে হলো না। এরপর মা বাবা চলে আসলো আর চিঠি লেখাও বন্ধ । তখন শুধু জারি থাকলো প্রাত্যহিকী তে নিয়মিত লেখা।

এখনকার প্রজন্ম ভাববে কি বোকাই না ছিলাম আমরা। পোস্টকার্ড , ইংল্যান্ড , এনভেলাপ , ফাউন্টেন পেন , হ্যান্ডমেড পেপারের লেখার প্যাড । সেসব ছিল অন্য এক ব্যাপার। এখন নিমেষের মধ্যে পৌঁছে যায় সবকিছু । কিন্তু চিঠির জন্য অপেক্ষা আর হটাৎ চিঠি পাবার মজা এখনকার প্রজন্ম পেলনা । আর পুরোনো চিঠি বার করে পড়া আর পড়তে পড়তে অতীতে ফিরে যাওয়া এমন হরষেবিষাদ আর কিসে আছে।
_________________________

দেবব্রত তরফদার। বিপুল পাঠকের ভালবাসাধন্য কথাশিল্পী। মানবতাবাদী।

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়