Ameen Qudir

Published:
2018-05-29 16:10:43 BdST

"অসুস্থ হলেই বুঝি দেশে ১২৫ কোটি লোকই চিকিৎসক "





অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
______________________________

 

কিছুই ভালো লাগছে না।এমনিতেই আমি পেসিমিস্ট।এখন আবার শরীর খারাপ। ফলতঃ দুয়ে দুয়ে চার মিলে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। তেমন বড় কিছুতে না, বড় বড় রোগ আমি স্নেহ করে শরীরে পুষি। আমি আক্রান্ত হই সামান্য কিছুতে, যেমন প্রতি দু তিন মাস পরপর আমি পায়ে ব্যাথা পাই। এতে আমি দুদিন কাত, পুরো শুয়ে পরার অবস্থা। সব কিছুতেই অরুচি লাগে। রুগীদের সাথে ক্যাটক্যাট করি। পেন কিলার খাই, ভাত মাছে রুচি নেই। দু তিন দিন শেষ, পা নরমাল, আমিও নরমাল, সব চলবে আগের মতো। এরকম শুধু পায়ে ব্যাথা না, একদিনের জন্য ঘাড়ে ব্যাথা, চারদিনের জ্বর, ছয়দিনের ঠান্ডা লাগা ও মাথা ও গলা ব্যথা আরো অনেক গুলো প্যাকেজ আছে। যা বিভিন্ন মেয়াদ ঘুরে ফিরে ফিরে আসে।হাঁপানি নামক আমার বড় পোষ্যরোগ আস্তে আস্তে শ্বাসনালী ক্রমেই সংকুচিত করছে,বেশ বুঝি।আমার এই সামান্য অসুখবিসুখকে বাড়ির মানুষ অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়। এই সময় নিজেকে রাজা মনে হয়।তবে ঐ সেবা যত্ন প্রায়শঃই অত্যাচার হয়ে পরে।


লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এইসব কথাতো নতুন নয় ! সব মানুষের এমন রোগজ্বালা হয়। তবে আমি অসুস্থ হলে রুগীরা ভাবে আমি অভিনয় করছি। কারন আমি ডাক্তার।আমার রোগ কেন হবে? সারাবছর আমি রুগীদের ডায়লগ মেরে বেড়াই, রোগে শোকে শুয়ে থাকাকে তিরস্কার করি।
সেদিন এক রুগি আমার দিকে তাকিয়ে খুব হাসছিল।বললে,’ডাক্তার বাবু,আপনার চুল পেকে গেছে ‘
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি ‘এতে হাসির কি হল?’
রুগী আরও হাসে,বলে ‘ আপনি ডক্তারবাবু,আপনার চুল পাকবে কেন?’ আমি হতবাক।বোঝ ব্যাপার।

তাই আমি অসুস্থ হলেও আমি বের হই,চেম্বারে জোর করে দাঁত বের করে ভালো লাগার চেষ্টা করি। টিকতে না পারলেই বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে এলেই উদ্বিগ্ন স্ত্রীর ছোটাছুটি শুরু হয়।তাঁর কাছে হিতোপদেশ ও আমার লাইফ স্টাইল নিয়ে অনেক জ্ঞান প্রাপ্তি ঘটে। বাবা তার ঘর থেকে জানান, কোন ট্যাবলেট খেলে এই অসুখের সমাধান।তৎক্ষনাৎ সেই ওষুধ নিয়ে বধূমাতা আমাকে খাওয়ানোর তুমুল প্রচেষ্টা শুরু করেন।আমার কোন কথাই শোনা হয় না।চতু্র্দিকে রাষ্ট্র হয় আমার অসুস্থতা।ফোনে ডাক্তার মোক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক সরকারি কর্মচারী কবি সাহিত্যিক ,সবাই কিছু না কিছু উপদেশ দেন। আগে জানতাম দেশে মাথাপিছু ডাক্তারের হার কত কম! অসুস্থ হলেই বুঝি দেশে ১২৫ কোটি লোকই চিকিৎসক। বুজুর্গদের কথাও ভাবি।তাঁরা কেউ স্ত্রীকে বলেন ‘অনির্বাণ অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার..কাজেই ও এলোপাথাড়ি চিকিৎসা করবে’।তাঁরা হোমিওপ্যাথিতে নিদান দেন।আরও পুরনোরা কালোজিরের সাথে মধু মিশিয়ে খাওয়াতে বলেন।

এই সময়ে ভাবি এক কমেডি সিনেমা বানাবো, যেখানে শেষ সিনে দেখানো হবে, নায়িকা নায়ককে ঠেসে কালোজিরে খাওয়াচ্ছে। পুরো অস্থির !


ডকিন্সের দ্যা গড ডিলিউশান পড়ছি। বইটা একজন দিলো। ইংরেজী পড়া বাংলার মতো প্রশান্তির নয়। কিন্তু ভালো বাংলা বই পড়ার পাচ্ছি না, তাই ইংরেজী এখন ভরসা। আমি শেষ করলাম বইটি। ভালোই লাগলো। তবে সবার মত বেশী বেশী মুগ্ধতা নেই। বাংলা অনেক উপন্যাস আছে এরচেয়ে আমাকে বেশী মুগ্ধ করেছে।

‘The Hindu’তে একটি খবর চোখে পড়লো। সাংবাদিক মশাই ভালই উপস্থাপিত করেছেন খবরটি। স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ শুনে আসার পথে স্বামীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। লেখাটা পড়ে আমি দুঃখিত হবার বদলে আশাবাদী হলাম। যাক এই পাথরের পৃথিবীতে এরকম হীরের টুকরো হৃদয়, সত্যিই অমুল্য। প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের শোকাতুর করে তোলে। দু চারদিন কাঁদলেই অনেকে ঠিক হয়ে যায়। কেউ কেউ আছে এরকম অসাধারণ। প্রিয়জনকে একা রেখে আসেন না।

আমার এক বন্ধু এসেছিলো বাড়িতে। সে খুবই উচ্চমানের নেগেটিভ মানুষ(আমার থেকেও)। খুব কম ব্যাপার নিয়েই সে ইতিবাচক।তার জুতো হারানোর কারনে মেজাজ খারাপ । হুট করেই সে বললো, 'যাক যা গেছে গেছে। কত জায়গায় যাই, একটা এক্সিডেন্টে যদি পায়ের কিছু হতো তাহলে জুতো দিয়ে কি করতাম'। এটাই মানুষ, মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে। প্রথমে হারানোর বেদনায় ধাক্কা খায়, পরে সামলে ওঠে।

‘উঠে পরো,এটা খাও।‘ ধরমড় করে উঠি।প্রানেশ্বরী একটি বড় চামচে ,মধু ও কালোজিরে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
_______________________________

- অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস । কবি; চিন্তক। লোকসেবী চিকিৎসক। কলকাতায় থাকেন।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়