Ameen Qudir

Published:
2018-05-08 23:35:26 BdST

সমাচার   'দ্বিতীয় বিবাহ'


প্রতিকী ছবি।

 

ডা. নাসিমুন নাহার মিমমি

___________________________

বয়স যখন চব্বিশ তখন রুবার ডিভোর্স হয়। উনিশে পরিচয় ওদের দুজনের ।দু’বছর অসাধারন মায়াভরা স্বপ্নের মতো ভালোবাসাময় সময় কাটিয়ে বহু চড়াই উতরাই পারি দিয়ে একুশে বিয়ে।বহু স্বপভঙ্গ সাথে নিয়েই তেইশে মা হওয়া। অতঃপর ভয়বহ দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি নিয়ে, দুবার সুইসাইড করার এটেম্পের অভিজ্ঞতাসহ, বাচ্চা বুকে জড়িয়ে রুবার এই এত বড় পৃথিবীতে একদম একা হয়ে যাওয়া।

বছরখানেক পরে আরেকবার নতুন করে রুবাকে বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় বাসা থেকে।
প্রথমে না বললেও পরে বাবা মা, আত্মীয় স্বজন সবাই বুঝালো- একা কেউ থাকতে পারে না, হাজারো সমস্যা হবে,এখন বয়স কম ভালো ছেলে খুঁজলে পাওয়া যাবে , আর কিছুদিন গেলে তাও সম্ভব হবে না।তাছাড়া বাচ্চাটার জন্যও একজন বাবার প্রয়োজন আছে।

সত্যি বলতে কি বিয়ের ব্যাপারে রুবার কোন আগ্রহ আর ছিল না।বিয়ের শখ তার মিটে গেছে বহু আগেই।বিয়ে মানেই তার কাছে এখন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।নিজে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে তখন।কিন্তু বাসা এবং আশেপাশের সবাই সারাক্ষন তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেল -- সে একজন অচ্ছুৎ ! তার জন্য পরিবারের সবাই সমাজে ছোট হচ্ছে।সে এখন তার বাসার বোঝা।নিত্যই মায়ের সাথে ভাইয়ের বৌদের সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল।বাসার পরিবেশ অসহনীয় হয়ে যাচ্ছিল।
সবার জোরাজুরি তে একজন ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে যেতে হয় ওকে একটা কফি শপে।বাচ্চা কে মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিল।

ভদ্রলোক আসলেই যথেষ্ট ভদ্রলোকই ছিলেন। প্রথমেই বললেন বাবুকে সাথে নিয়ে আসতে পারতেন।ব্যাপারটা ভালো লাগলো রুবার।মা বলে কথা।এরপর টুকটাক ফরমাল কথাবার্তা।ভদ্রলোকের আগের ওয়াইফ টিভি আর্টিস্ট।খুব ক্যারিয়ার কনশসাস।বাচ্চা নিতে রাজি ছিল না।মাসের মধ্যে পনের ষোল দিন আউট ডোরে থাকতে হতো।মূলতঃ এসব কারনেই নাকি তাদের আলাদা হয়ে যাওয়া।

ভদ্রলোক রুবার থেকে প্রায় চৌদ্দ পনের বছরের বড় হলেও দেখে বোঝা যাচ্ছিল না।রুবার অনুপাতে খুবই বেশি স্মার্ট আউটলুকিং এ।রুবা বরাবরই সাদামাটা।আর এখন তো নিজের যত্নই নেয়া হয় না তেমন করে।খানিকটা অবাক লাগছিল ওর এটা ভেবে ওনার মত একজন হাই কর্পোরেট ব্যক্তি ইচ্ছে করলেই আনম্যারিড মেয়ে বিয়ে করতে পারেন এখনও সহজে অথচ উনি নাকি রুবার সবকিছু জেনেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।ব্যাপারটা কেমন যেন মনে হলো রুবার।এই বিয়ের ব্যাপারে রুবার একটাই কথা ছিল ---- তোমাদের যার সাথে ইচ্ছে বিয়ে দিয়ে দাও। আমার বলার কিছু নেই।শুধ আমার মেয়েটাকে আমার সাথে থাকতে দিলেই হবে।

রুবা একটু পর পর বাবুর খবর নিচ্ছিল মোবাইলে।মা খুব বিরক্ত হয়ে বলল--বাবু ভালো আছে।লোকটা কি ভাববে বারবার এভাবে ফোন দিলে।কথা বল ভালো করে ওনার সাথে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল --ঘাড়ের থেকে বোঝা নামানোর জন্য ব্যস্ত সবাই.......

ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরল রুবা। সবাইতো অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে শক্ত করে রুবা বলল-- ঐ লোক যদি রাজী থাকে বাবুকেসহ আমাকে একসেপ্ট করতে তাহলে আমার আপত্তি নেই।

রাতে রুবার এক বান্ধবীর সাথে কথা হলো । ও অনেকদিন ধরে একটা নামী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে জব করছে।বান্ধবী বলল--- দেখ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কোথাও কোন একটা গোলমাল আছে। এই লোককে আমি চিনি।সে যে কর্পোরেট হাউজে জব করে আমি ইন্টার্ন ছিলাম সেখানে। ভদ্রলোক সেই হ্যান্ডসাম, বহু ফার্স্ট লাইভ লীড করে,হাই প্রোফাইল তার।
তোকেও আমি সেই স্কুল লাইফ থেকে চিনি। টোটালী মিস ম্যাচ।তুই হচ্ছিস দীঘির জল- শান্ত গভীর টলটলে স্বচ্ছ।আর ঐ লোক হচ্ছে সমুদ্রের মতো। জোয়ার ভাটা লেগেই আছে। গভীরতা স্থিরতা কম তার।বুঝতে পারছিস তো আমি কি বলছি ? ভালো করে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবি দোস্ত।তার যেই হাই প্রোফাইল মডেল টাইপ মেয়ে থেকে শুরু করে বহু আন ম্যারিড মেয়ে ছুটে আসে তার এক ইশারায়।
আর সে কিনা বাচ্চাসহ একজনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে।ব্যাপারটা অবশ্যই গোলমেলে !

হুমমম ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল রুবা। পরদিন সকালে বাসায় এ কথাগুলো বলতেই রীতিমত ঝড় বয়ে গেল।রুবার ই সমস্যা।সবকিছুতে খালি নেগেটিভ দিক দেখতে পায়।একজন মানুষের মনে মায়া আসতে পারে না একজন অসহায় মেয়ে আর তার বাচ্চার জন্য? আর রুবা কি ফেলনা নাকি ? একটা ওয়েল ফ্যামিলি বিলং করে। উচ্চ শিক্ষিত।কলেজের লেকচারার।
মানুষের কি দ্বিতীয় বিয়ে হয় না ? সমস্যা শুধু একটা বাচ্চা আছে ওর।এছাড়া ঐ লোক আর রুবার মধ্যে পার্থক্য কি ???

বোঝাতে ব্যর্থ হল রুবা --- পার্থক্য আছে। ওনার আর রুবার লাইফ স্টাইলটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন।আর এ কারনে যদি পরবর্তীতে কোন সমস্যা হয় ওদের মাঝে ওনার থেকে অনেক বেশি ভুগতে হবে রুবাকে।কারন রুবা বাচ্চা নিয়ে সংসার শুরু করবে ওনার সাথে।ব্যাপারটা রুবার সন্তানের বেড়ে ওঠার সাথে জড়িত।এই ইস্যুতে একজন একা মা কিভাবে রিষ্ক নিতে পারে ??

যাহোক বাসার চাপাচাপি আর ঐ ভদ্রলোকের অতি আগ্রহে শুরু হলো বিয়ের প্রস্তুতি।রুবার মন নেই বিয়েতে।ভালোবেসে নিজের সবটুকু দিয়ে বৌ সেজেছিল সে একদিন---- ঐ দিনটাই ছিল তার জীবনে বিয়ের দিন।সেই মানুষটিকেই যখন ধরে রাখা যায়নি তখন ভালোবাসাহীন এই লোক দেখানো বিয়ের কি মূল্য !
ভদ্রলোক কে রুবা এই কথাটা বলেছেও।উনি বলেছেন -- বিয়ে একটা সামাজিক রীতি।
সমাজে বসবাস করতে হলে নিজের জন্য নাহলেও এমন অনেক কাজ আছে যা আমাদেরকে করতে হয় শুধুমাত্র সামাজিক জীব হিসেবে।সো টেক ইট ইজি।

একেবারেই ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হলো।বিয়ে পড়ানো শেষ হলে সবাই যখন ওদের দুজনকে একটা রুমে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ দিল ভদ্রলোক তখন বলল-আমার কাল মালয়েশিয়া তে কনফারেন্স আছে।রাতে ফ্লাইট।সপ্তাহ খানেক পরে ফিরব।তুমি চাইলে এ কদিন তোমাদের বাসায় থাকতে পার।কিংবা আমার ফ্ল্যাটেও থাকতে পার।চাবি দিয়ে যাব তোমাকে।

রুবা একটু চমকে উঠল।গত চার পাঁচ দিন ধরে দিনে অনেকবারই কথা হয়েছে ভদ্রলোকের সাথে।কই তখন তো সে কনফারেন্সের কথা কিছু বলেনি।আর এটা কেমন কথা ? আজ বিয়ে করে কালই বাইরে যাবে ! রুবাকেও তো সাথে নিতে পারত ! অনেক কিছুই মনে হতে থাকলো।

রুবাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক বলল-- দেখ এত অবাক হবার কিছু নেই।এটা আমাদের প্রথম বিয়ে না। বি প্রাকটিক্যাল।তুমি জব কর।বাচ্চা আছে।এসব নিয়ে ব্যস্ত থাক।আমাকে আমার লাইফে থাকতে দাও।কেউ কাউকে আমরা বিরক্ত না করি।টিপিক্যাল স্বামী স্ত্রী হওয়া সম্ভব না আমাদের। আর আমার পক্ষে একচল্লিশ বছর বয়সে বৌ বিয়ে নিয়ে ছেলে মানুষী মানায় না।

রুবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।সে আগে ই ধারনা করেছিল অবশ্যই একটা গোলমাল আছে কোথাও।আবারও সম্ভবতঃ ভুল বিয়ের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে ! পাঁচ বছরের ভুলে ভরা বিয়ের স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।
বহু কষ্টে নার্ভ শক্ত করে সে বলল -- আজ রাতে আমি কোথায় থাকব ? ভদ্রলোক বললেন -- তোমার ইচ্ছে।রাতে কোথায় থাকবে এটা এত গুরুত্ব পূর্ণ কিছু না যে এত টেনসড হতে হবে।

রুবা এবার বেশ সহজ গলায় মাথার ঘোমটা ফেলে ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল --- আসল কথাটা দয়া করে বলুন।এত আগ্রহ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন, প্রথম রাতের কোন গুরুত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না, এত এত মেয়ে থাকতে আমার মত একেবারেই সাধারণ মেয়ে কে তাও বাচ্চা সহ বিয়ে করার পেছনের রহস্য টা এখন বলুন।জীবনে একবার ভুল করেছি আমি।তার মাশুল আজও দিচ্ছি।বহু বছর ধরে ঐ ভুলের ঘানি টেনে যাচ্ছি।তখন বয়স কম ছিল বিধায় সবকিছু বুঝে উঠতে সময় লেগে গিয়েছিল।কিন্তু এবার আর তা হবে না।পরিষ্কার করে বলুন আপনি কেন বিয়ে করেছেন আমাকে ?

ভদ্রলোক যেন কিঞ্চিৎ বিরক্ত।ভ্রু কুঁচকে বললেন--দেখ এত হৈ চৈয়ের কিছু নেই ।আমি কাজের মানুষ।কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।তারপরও লোকের নানা কথার উত্তর দেবার জন্যই এই বিয়ে।আমরা সমাজের চোখে স্বামী স্ত্রী হিসেবে থাকব।আমার পক্ষে তোমার সাথে কোন রকম intimacy সম্ভব না।তুমি চাইলে অন্য কারো সাথে রিলেশনসিপে যেতে পার।আমার সমস্যা নেই।

রাগে গা কাঁপতে লাগল রুবার।দাঁতে দাঁত চেপে বলল -- আপনি তো দেখি বিরাট মহা পুরুষ ! সাতাশ আঠাশ বছরের মেয়ে বিয়ে করে নিজেই বৌকে পারমিশন দিচ্ছেন পরকীয়া করার ! ঝেড়ে কাশেন তো।এতখানি উদারতার পেছনের কারন বলেন।এনাফ ইজ এনাফ।

ভদ্রলোক চুপ করে আছেন।

রুবা বলল -- ওকে ফাইন আমি বলছি আপনি শুনুন।আপনার ডায়াবেটিস হাই প্রেসারসহ আরো কিছু শারিরীক সমস্যার জন্য একজন স্বামী হিসেবে আপনি রিজেক্টটেড হয়েছিলেন আগের ওয়াইফের কাছে বিয়ের ন মাসের মাথায়।কিন্তু অফিস থেকে বাসা সব জায়গায় নিজের অসুস্থতা লুকিয়ে বলেছেন মেয়েটির সমস্যা ছিল।আমি গতকাল জেনেছি সত্যটা। জেনেও বিয়েতে মত দিয়েছিলাম।কারন শারীরিক সম্পর্ক ই তো আর সবকিছু না বিয়েতে।আপনি বাচ্চাসহ আমাকে বিয়ে করছেন এটা নিয়ে আমার পরিবারসহ আমার কাছেও আপনি মহাপুরুষ হয়ে বসে আছেন !

কিন্তু আজ আপনি যে কথা বললেন --- অন্য ছেলের সাথে আমি সম্পর্ক করতে পারি আপনার তাতে কোন হেডেক নেই।এ কথা জানার পরে আর এক মিনিটও আমি আপনার সাথে থাকছি না।আপনি হচ্ছেন মহাপুরুষ সাজার লোভে আসক্ত একজন ধুরন্ধর পুরুষ।অসুখ মানুষের থাকতেই পারে।কিন্তু নিজের অসুখকে লুকানোর জন্য যে জঘন্য ফন্দি আপনি করেছেন আর ভেবেছেন বাচ্চা আছে এবং খুব সাধারন মেয়ে বলে এই অন্যায় আমি মেনে নিব। তা খুব ভুল ভেবেছেন।
মেয়েদেরকে সস্তা আর বোঝা ভাবা কবে বন্ধ করবে এই উম্মাদ সমাজ ?

----একটানা কথাগুলো বলে থামল রুবা।
তারপর একটু হেসে বেশ জোরেই বলল যেন বন্ধ দরজার ওপাশে থাকা মানুষগুলোও শুনতে পায় কথাগুলো---- আপনি এখন আসতে পারেন।
আপনার সাথে লোক দেখানো সামাজিক খেলাটি আমি খেলতে পারলাম না।সরি।তবে আপনাকে ধন্যবাদও।সেই উনিশ বছর থেকে ভাগ্য এবং সমাজ আমাকে নিয়ে খেলেছে।আজ থেকে আমিই সমাজকে নিয়ে খেলব এবং কারো ঘাড়ের বোঝা না হয়ে শুধুই একা খেলব আমি।
__________________________

ডা. নাসিমুন নাহার মিমমি। সুলেখক।

 

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়